মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ সাধনের নাম শিক্ষা। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল জ্ঞানের বিকাশ। জ্ঞানের উন্মেষ না হলে চিত্তের বোধন হয় না। শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারেনা। সুশিক্ষিত লোকমাত্রেই স্বশিক্ষিত। তবুও কারও না কারও কাছ থেকে কিছু শিক্ষা তো নিতেই হয়। যিনি এই শিক্ষাদান করেন তিনিই হলেন শিক্ষক। শিক্ষক হতে পারেন মানুষ, শিক্ষক হতে পারে প্রকৃতি। প্রতিটি ঘটনা যা মননে রেখাপাত করে– তাই কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়– তাই হল শিক্ষা। শিক্ষা জিনিসটা কিন্তু জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন একটা কৃত্রিম জিনিস নয়।
শিক্ষক তিনিই যিনি কোন বিষয়বস্তুর উত্থাপন করবেন ছাত্রছাত্রীর নিকট নিতান্তই দায়িত্ব ও কর্তব্যের খাতিরে নয়, নেশায়–উদ্দাম নেশায়–পাগলের মতো। বিষয়বস্তুকে পরিবেশন করবেন শতভাবে, শতরূপে– আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, চরম রূঢ়তায় নয় – সুধাভরা পরম মমতার স্পর্শে। তাঁর সেই অতলস্পর্শী জ্ঞানভান্ডার উন্মুক্ত হবে ছাত্রের নিকট। ছাত্রের মনন অনুরণিত হবে শিক্ষক মহাশয়ের পাঠাস্বাদনে, তাঁর সাবলীল স্বতোৎসারিত জ্ঞানধারাবর্ষণে সিক্ত হবে যাবতীয় অনুসন্ধিৎসা, জারিত হবে হৃদয়, আসবে পরম প্রশান্তি।
শিক্ষক মহাশয় শুরু করবেন, কিন্তু শেষ হবেনা। এখন যাকে সিলেবাস বলি তাকে মান্যতা হয়তো তিনি দেবেন কিন্তু হবেন স্বাধীন, বাধা বন্ধনহীন, অর্গলবিহীন। তাঁর মন যে আরও কিছু দিতে চায়। তিনি থামবেন না। থামবেন কেন? এ যে অসীম ভান্ডার! সময়ের মাপকাঠিতে কি তাঁকে বেঁধে রাখা যায়? না, তিনি থামবেন না। তিনি যখন 'Ode to the west wind ' পড়াবেন তখন কি একবারও কালবৈশাখীর কথা বলবেন না? তিনি কি একবার বলবেন না 'এত যে ভীষণ, তবু তারে হেরি, ধরার ধরেনা হর্ষ...' ইত্যাদি। এই গুলোই তো সুর তোলে শ্রবণে, মননে, বিজনে, নির্জনে।
হ্যাঁ, একমাত্র শিক্ষকই পান স্বাধীনতা, পাবেনও। শ্রেণিকক্ষে তিনিই সর্বশক্তিমান। বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত কলেজে মেঘদূত, কুমারসম্ভব পড়াবার কালে প্রয়োজনবোধে পাণিনির ব্যাকরণ এর উল্লেখ করবেন কিনা তার জন্য তাঁকে কি কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হত? নিশ্চয়ই না। শিক্ষকের স্বাধীনতা যে অনন্ত! শিক্ষাদানের পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি একজন প্রকৃত শিক্ষকের কাছে আসে তখন, যখন তিনি পান অবাধ স্বাধীনতা। তাঁর জ্ঞান ভান্ডার ছাত্রের মনের উপর ঘন কালো মেঘের মতো আস্তরণ ফেলবে আর তার থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে বৃষ্টির মতো জ্ঞান ঝরে পড়বে, স্নিগ্ধ করবে, নির্মল করবে তার হৃদয়–দিবানিশি–এইতো শিক্ষক, এইতো শিক্ষা–এইতো স্বাধীনতা।
কিন্তু সুর তাল কেটে যায় যখন একটা বাঁধন আসে শিক্ষকের স্বাধীনতায়। তাঁকে সময়ের গণ্ডীতে, সিলেবাসের কাঁটাতারে বা অন্য কিছুর ভিত্তিতে আটকে দেওয়া হয়, যেদিন ছাত্রদের নিকট মনপ্রাণ ঢেলে তিনি কোন বিষয়ের উপস্থাপন করলেন প্রাঞ্জলভাবে, আর তা ছাত্রদের বোধগম্য হল, হৃদয়গ্রাহী মনোজ্ঞ হল সেদিন শিক্ষকের যে তৃপ্তি তা কোন পার্থিব বস্তু দিয়ে বিচার করা যায় না। তাঁর বেতন কম, না বেশি; বিনা পারিশ্রমিকে পাঠদান করছেন কিনা তা বিচার্য হবেনা–সে স্বাদ ভিন্ন –যিনি পেয়েছেন, তিনিই জানেন সে প্রাপ্তি কী!
শিক্ষকের এই মনে যদি কোন বাঁধ বেঁধে দেওয়া হয়, তা স্বতঃস্ফূর্ততা হারায়। জ্ঞান দান করবেন বটে– তবে তা হবে যান্ত্রিক। তরকারি মশলা থাকতে পারে কিন্তু সঠিক নির্বাচনের কিংবা সঠিক অনুপাতের অজ্ঞতায় তাতে স্বাদ আসেনা। শিক্ষক মহাশয়কে করতে হবে সর্ব বাধামুক্ত, অবাধ-গতিময় নদীর মতো; তবেই তো তার দু-কূল ছাপিয়ে প্লাবনের মতো উপচে পড়বে জ্ঞানরাশি; অজ্ঞানতা, কুসংস্কারকে ধুয়েমুছে সাফ করে নতুন জ্ঞানের ধারায় স্নাত হবে ছাত্রদের মন, সেটাই তো প্রাপ্তি, সর্বোচ্চ ধন।
শিক্ষক মহাশয়কে তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য আমাদের তো সম্মান জানাতেই হয়। কিন্তু তাঁকে যদি তা প্রদান না করা হয়, অথচ তা পাবার আশায় থাকতে হয়, তবে তা তো স্বাদহীনতা। কিন্তু কিছু এমন মাঝে মধ্যে যদি ঘটে যে তাঁর মনোবৃত্তিতে আঘাত আসে তবে তা স্বাদহীন তো হবেই–বিশেষত স্বাধীনতা হীনতায়। এটা তো স্বীকার করতেই হবে যে শিক্ষকের স্বাধীনতা টিকে থাকে বুলেটের জোরে নয়, বুকের জোরে। আর একথাটা চরম সত্য– পুরানো হলেও পুরানো হবার নয় যে–
'স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়?'