স্বাদহীনতার কাহিনী বলতে গিয়ে আমার মতো, আমাদের মতো স্বাস্থ্য বিভাগের তৃণমূল স্তরের কিছু কর্মীর স্বাধীনতার স্বাদহীনতাকেই বেছে নিলাম।
স্বাধীনতাও যে স্বাদহীন হয় স্বাধীনতার এতো বছর পরেও বা Covid-19 এর উপসর্গের মতো মাঝে মাঝেই তার মিষ্টি গন্ধটাও যে দম বন্ধ করা হয়; উবে যায়, সে বিষয়েই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দু'চার কথা...
"স্বাধীনতার স্বাদহীনতা" শব্দটাকে আমি আপাতভাবে তিনটি ভাগ করে নিলাম...
১)পারিবারিক স্বাধীনতার স্বাদহীনতা
২)সামাজিক স্বাধীনতার স্বাদহীনতা
৩)কর্মক্ষেত্রের স্বাধীনতার স্বাদহীনতা
কর্মক্ষেত্রের যে স্বাদহীনতা, তা নিয়েই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করছি আজ। যদিও এই ক্ষেত্রটাতে পদার্পণ করতে হলেও আমার মতো মধ্যবিত্ত ঘরের বাঙালি নারীদের প্রথম দুই ক্ষেত্রের প্রাথমিক পরাধীনতা কাটিয়ে যৎসামান্য স্বাধীনচেতা হতেই হয়, স্বভাবতই কিছুটা স্বাদহীন হয়ে ওঠে পারিবারিক - সামাজিক জীবন ও সম্পর্কগুলো।
তারপর যেটা হয় সেটা আরও কঠিন, বড়োই বে-আস্বাদের। সামনে তখন প্রত্যক্ষ স্বাধীনতার স্বাদ ভর্তি খোলকের আড়ালে পরোক্ষ শৃঙ্খলিত তিক্ততায় মোড়া একটা জীবন। কোয়ালিটি সার্ভিসের অভিজ্ঞতা নিয়ে কোয়ান্টিটি সার্ভিসের পিছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হাঁপধরা মনটাকে টিকিয়ে রাখার একটা পরিসর।
আমি W.B Nursing Council থেকে পাশ করা NRHM নিযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এক অস্থায়ী ANM(R), নিজ এলাকার পঞ্চায়েত সংলগ্ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিযুক্ত আছি ANM 2 Designation নিয়ে, যদিও আমার কর্মের মেয়াদ ১০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।
চাকরী মানেই পরোক্ষে কম-বেশি একটা পরাধীন জীবন, নিয়মের বাইরেও বেনিয়মের একটা লম্বা হাতের অক্টোপাস বন্ধন।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে কর্মক্ষেত্রে ঢুকে একসময় একইসাথে দ্বৈত স্বাধীনতার স্বাদ হারিয়েছিলাম। দ্বৈত বললাম, তার কারণ একবার হারালাম সরকারী জায়গায় মাথা গুঁজে, একই সাথে হারালাম অস্থায়ী কর্মী হওয়ার সুবাদে। স্বভাবতই অনেক স্থায়ী কর্মীদের চোখে খানিকটা অচ্যুত হিসাবেই শুরু করেছিলাম নিজের কর্মজীবনটা।
প্রতিনিয়ত সমানতালে যোগ্যতার লড়াই লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়েছি, তবু শক্তি সঞ্চয় করেছি করছি নিজের মধ্যে, প্রতিনিয়ত সজীব করে তুলছি মনের টেস্টবারগুলোকে।
আমার উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে দু'জন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ANM(R) ও এলাকা ভিত্তিক প্রায় ১০০০-১৪০০ জনসংখ্যায় একজন করে মোট ছয় জন ASHA দিদি। খাতা কলমে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এলাকা ভাগ দুই ANM এর সমান সমান, জনসংখ্যাও, দায়িত্বও। স্থায়ী কর্মী হিসাবে ANM 1 Incharge হিসাবে গণ্য হন। তাঁর অনুপস্থিতিতে সমস্ত দায়িত্বই ANM 2 এর।
শুরু করি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিকাঠামো; পরিবেশ বা সেখান থেকে প্রাপ্ত বে-আস্বাদের অভিজ্ঞতা দিয়েই...
আগে পঞ্চায়েতের একটি ঘরে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাজ চলতো, বছর খানেক হলো জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের টাকাতেই পঞ্চায়েত সংলগ্ন একটি দ্বিতল গৃহ নির্মাণ হয়েছে, সেখানে এলাকার ৮৫০০ জন মানুষের জন্মের আগে থেকে মৃত্যুর পর অবধি বিভিন্ন রকমের পরিষেবা দিই আমরা মিলে মিশেই। অতিরিক্ত প্রায় ৬৫০০০ টাকা থাকা সত্ত্বেও; বহুবার আবেদন করার পরও বাইরে মাথার উপর একটা সেড, একটা নির্দিষ্ট নিরাপত্তা দেওয়া বাউন্ডারি পাইনি আমরা, ফলে কোনোদিন গিয়ে সরাই ভাঙা মদের বটল, কোনোদিন পরিষ্কার করি ফুচকার প্লাস্টিকের বাটি, কোনোদিন দেখি বাইরে বসানো সাবমার্সিবেলের ট্যাপ টাই উধাও...
ইঞ্জেকশানের দিন গুলোতে তো রোদ জলে আধা পুড়ে-ভিজেই গর্ভবতী মা, সদ্যজাত শিশুকে থাকতে হয় সেন্টারের ভিতরের ছোট্ট একটু দুয়ারে। বর্তমানে এই কোভিড পরিস্থিতিতেও চালু আমাদের সমস্ত রকম পরিষেবা, দূরত্ব বজায় রাখতে গর্ভবতী মায়েদের সিঁড়ি ভেঙে পাঠাতে হয় দোতলার ঘরে। অনেকে ওঠেন, অনেকে ওঠেন না। নিরুপায় আমরা, তাই কঠোর হই মায়েদের উপর, বাধ্য করি উঠতে। সংক্রমণ এড়াতে পরোক্ষে অন্য বিপদে ফেলি আসন্নপ্রসবাদের।
সরকারি আদেশ অনুযায়ী প্রতিবার পরিষেবার পর সংক্রমণ মুক্ত করতে হবে সেই স্থান। কখনও যদি জানতে চাই- করবে কে? উত্তর আসবে আমরাই...
এতো বড়ো একটা ক্রাইসিসেও একটা স্বাস্থ্যকর্মীও নিয়মিত পরিপূর্ণ সুরক্ষার জিনিস পায়নি সেই মার্চ মাস থেকে। দাবীর পর দাবী করে করে যেটুকু পেয়েছি, সেটা নেহাতই তুচ্ছ আমাদের কাছে। যে আমরা কিনা প্রতিদিন ভিন রাজ্য থেকে আসা কমিউনিটির অজানা অচেনা পরীক্ষা না হওয়া মানুষদের ও তাদের পরিবারের পরিষেবা দিই, সেই কোভিড যোদ্ধাদের সুরক্ষা শুধুমাত্র ৫০ বার কাচা আর শুকনো করা দু একটা ডিসপোজাল গ্লাভস আর মাস্ক। একটা করে চাদর অবশ্য পেয়েছি সবাই, রোদ বৃষ্টি ঝড়ের নাকি ওটাই একমাত্র প্রতিরোধক। ANM দের জন্য কটন গাউন। তবু বলবো কম, খুব কম এগুলো প্রয়োজনের তুলনায়, উপযুক্ত সুরক্ষার জন্যও।
সুরক্ষার অভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, মরছেও কর্মীরা। ঠিক তখনই ফলাও করে ঢাক পেটানো কথাগুলো মিথ্যে প্রমাণিত হচ্ছে বারবার।আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পরও তারা তাদের উদ্দেশ্যে ঘোষিত বীমার আবেদন করতে পারছে না, অবহেলিত হচ্ছে, অপমান করা হচ্ছে ইচ্ছে মতো, সবশেষে অস্বীকারও করা হচ্ছে প্রথম সারির যোদ্ধা হিসাবে। এমনিতেই সুপ্রিমকোর্ট এর রায়ের পরেও এখনও জারি সম কাজে সম পারিশ্রমিকের বৈষম্য, ASHA দিদিদের উপযুক্ত সাম্মানিক নেই। মাঝে মাঝে ভাবনা আসে, আমরা জীবন বাজি রেখে লড়বো তবে কিসের জন্য? প্রশ্ন করলে হারাতে হবে কাজ, "পোষালে করো, না হলে ছাড়ো। "কাজের বেলায় কিন্তু এক চুলও কম নেয় না আমাদের থেকে, বরং বুঝে নেয় দ্বিগুন তিনগুণই। অথচ বাঁচিয়ে রাখার অনিহা প্রবল, নিরাপত্তার অভাব প্রকট। এবার আসি কর্মক্ষেত্রের মানুষজনের কথায়, যাদের জন্য আমরা জীবনের ঝুঁকি নিই, ঘরে ঘরে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে পরিষেবা দিই। দিন রাত সবসময়ের জন্য পাশে থাকার আশ্বাস দিই, সশরীরে, ফোনের মাধ্যমেও। অথচ কিছু ঘটনা ঘটলে ঠিক ভুল বিচার না করেই তারাই চড়াও হয় আমাদের উপর, আমাদের পরিবারের উপর। অপমান, কটু কথা, উপহাস, ভালোবাসা সবই পাই মানুষ বিশেষে, তবে খারাপের ভাগটাই বেশি। অনুরোধ করি, বোঝানোর চেষ্টা করি, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সঠিক পথের হদিস দিই, কাজ হয় কিন্তু শতকরা হিসেবে অনেকটাই কম। কেন? আসলে, আমরা তো আর নেতা নেত্রী না, আমরা মানুষের বন্ধু হয়ে কাজ করি। আমাদের কথারও যে গুরুত্ব আছে এটা বোঝাবে কে জ্ঞানপাপী মানুষজনকে!
তারা কোয়ারেন্টাইন রাখাকে ভাবে দিদিমণির লাভ, সার্ভে করতে গেলে শোনায় "পয়সা পাবো?"
সময় মতো মা এর রেজিস্ট্রেশনের পিছনেও তারা ASHA দিদিদের লাভের হিসেব দেখে,
একসাথে বাচ্চাকে একাধিক রুটিন ইঞ্জেক্ট করলে তারা দিদিমণিদের নির্দয়তা নিয়ে সোচ্চার হয়।
সময় নিয়ে বাচ্চাকে ইঞ্জেক্ট করলে তারা ব্যস্ততার বাহানা দেয়, বিরক্তি প্রকাশ করে,
৬ মাস অবধি বাচ্চাকে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে বলাকে তারা স্বাস্থ্যকর্মীদের মুর্খামি ভাবে, নরমাল ডেলিভারির জন্য অপেক্ষা করাকে তারা নিজেদের বোকামি ভাবে।
তবু আমরা এসব নিয়েই কাজ করি, বুঝিয়ে যাই এলাকাবাসীকে, জানি ১০০ জনের মধ্যে ১০ জনও তো শোনে আমাদের কথা। আশা রাখবো একদিন আরও সচেতন হবে এলাকার মানুষ, আনন্দের স্বাদ ফিরবে তাদের আমাদের হাত ধরেই।
সরকারি তরফ থেকে আমরা আশা রাখি, সরকার ASHA দের বাঁচাক ANM দের বাঁচাক, সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি সরকার আরও তৎপরতা দেখান।
না মানলেও এটাই সত্যি যে-একটা প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন স্বাস্থ্যকর্মী বানাতে মিনিমাম একটা সময় লাগেই, সাড়ে তিন দিন বা সাত দিনে এসব হয়না। তাই দৃষ্টি দেওয়া উচিত যারা কাজ করছে তাদের সুরক্ষার ব্যাপারে, মূল্য দেওয়া উচিত তাদের জীবনের।
স্বাধীনতার এতবছর পরেও গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর অনুপযুক্ত পরিকাঠামো কি প্রশাসনিক অবহেলা নয়? তৃণমূল স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি দ্বিচারিতা কি উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়? আমরাও চাই আদর্শ পরিবেশে মানুষকে সঠিক পরিষেবাটুকু দিতে। সর্বোপরি খেয়াল রাখতে হবে স্বাস্থ্যকর্মীরাও মানুষ, সর্বাগ্রে উপযুক্ত সম্মান দেওয়া উচিত তাঁদের প্রত্যেককেই।