শীত ল্যাংচাচ্ছে। লেপের গায়ে জমছে হালকা ঘাম ঘাম গন্ধ। খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসছে পাতলা কাঁথা কম্বল। খিরিশ গাছ সুযোগ বুঝে বাতাসের গালে চকাস চকাস চুমু দিয়ে খুলে দিচ্ছে পাতার গিঁট। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ধরেছো গোঁসাই, মোবাইল রিংটোনে বেজে উঠলো বসন্ত এসে গেছে...
ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মাগো তোমায় মনে পড়ে! গর্বে বুক ফুলিয়ে সোচ্চারে বলি ‘আমি বাংলায় গান গাই...আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই’ । কখনো বা বিড়বিড় করে উঠি ‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে রোদ‚ বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন’। আর চাঁদ দেখতে গিয়ে আমরা চায়ের দোকান খুঁজেছি! ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ এসব শুনতে শুনতে বলতে বলতে দেখছি পাড়ার দোকানগুলোর নাম কবিগুরু মোগলাই হাউস, বিদ্যাসাগর চিকেন সেন্টার, নেতাজি অয়েল মিল কিংবা সারদা চিট ফাণ্ড হয়ে গেছে। মনীষীদেরও রেহাই দিলাম না আমরা। যে শিশু জন্ম নিল আজ, ঘুম ভেঙে উঠে কালকেই যেন elephant বানান বলতে পারে। যেন মিষ্টি করে পরশু দিনই ডাকতে পারে mummy । নইলে কীসের আধুনিক, কীসের বিশিষ্টতা!
বইমেলা এখন শুধু কলকাতায় হয় না, ছড়িয়ে পড়েছে জেলায় জেলায়। বই কিনতে সরকারি অনুদান পায় স্কুল কলেজ। বই কেনা হয় আলমারি সাজাতে। অধিকাংশ শিক্ষক কিংবা অভিভাবক উবাচ –‘ক্লাসের বই পড়ে না, লাইব্রেরির বই পড়বে! বিদ্যাসাগর’।
আজকাল একটা কথা শোনা যায়– কবি লেখকদের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, পাঠকের সংখ্যা নাকি সে হারে বাড়ছে না। তাই বেশীরভাগ বই পোকায় কাটে। শহরে গ্রামে সরকারি লাইব্রেরিগুলো ধুঁকছে উদাসীনতায়। উদাসীন পাঠক ও প্রশাসন, উভয়েই। তবে বাঙালি খুব সচেতন। আলমারিতে সে যত্নে ‘সঞ্চয়িতা’ রেখে বেস্টসেলার করে কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট।
ব্যাঙ্কে দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে এসে দেখি কাঁচের ওপার থেকে আসছে হিন্দি ভাষা। হিন্দিভাষাটা না বোঝাটা আমারই অপরাধ, এই পশ্চিমবঙ্গে চাকরি করতে আসা ওই মানুষটির বাংলা না জানাটা অপরাধ নয়! উপহাসের পাত্র হই আমি আমরা। তাছাড়া আঞ্চলিক কথ্যভাষাকে কতটা সম্মান দেওয়া হয়? নিজের ভাষাকে সকলেই ভালোবাসে। আবার নিজের সঙ্কীর্ণ মানসিকতা নিয়ে অন্যের কথ্যভাষাকে গ্রাস করতে চাই এই আমরাই। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি দুটো বক্তৃতা, তিনটে গান, পাঁচটা কবিতা করে আমরা দায় সারি। আবেগে ভাসি। এই আবেগের মূল্য আছে। জরুরি। কিন্তু দায়িত্ব নিই না। নিজের মায়ের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার দায় যেমন রাষ্ট্রের তেমনি প্রতিটি স্তরের প্রতিটি মানুষের।
আমরা যে যা মুখে বলি তাই কি শুধু ভাষা? প্রকৃতির কি কোনো ভাষা নেই? তার রূপ কি শুধুই সৌন্দর্যের কথায় বলে, সে কি আনন্দ বিষাদের কথা বলে না? যে কথা বলতে পারে না তার ইশারার কি কোনো অর্থ নেই? ভাষাদিবসে শুধু ভাব দেখালেই হয় না। ভাবনার দিন।ভাষাদিবস শুধুমাত্র উৎসব কিংবা স্মরণের দিন নয়, ভাষাদিবস সঙ্কল্পেরও। ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যেমন সোচ্চার হতে হবে, তেমনি সম্মান জানাতে হবে বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন ভাবের নিজস্ব উচ্চারণকে।