স্বাধীনতার এত বছর পরেও লোকশিল্পীদের স্বাদহীনতার কাহিনী ।। ভাস্করব্রত পতি

swadhinota

"বিটির বিঁহা দিব কেমনে / আমার ঘুম ধরেনা নয়নে / এমনি মুগের রীতিনীতি / পণ ছাড়া বিকায় না / বিটির বিঁহা দিব কেমনে" --
এভাবেই টুসুগানে আমাদের সমাজের আঁধার কাহিনীর সুর তোলে। এ কান্না শিল্পীদের জীবনেও। কান্নার আওয়াজে দেওয়াল কাঁপে। চোখের জলে দোর ভেজে। আর অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে নিয়েও আজ স্বাধীনতার এতো বছর পরেও এইসব লোকশিল্পীদের লৌকিক জীবনের মেঠোপথ বিস্বাদ! কর্দমাক্ত! রিক্ত! আজও তাই তাঁদের কন্ঠে শোনা যায় - "কাঁহা যাবে রে দাদা ধুতি পিঁধিঞে / কাঁহা যাবে রে দাদা তলং ছাড়িঞে"। ( ধুতি পিঁধিঞে - ধুতি পরে, তলং ছাড়িঞে - কোঁচা ছেড়ে )
মেদিনীপুরের লোকশিল্পের নাম লিখলে শেষ করা যাবে না। হয়তো অনেক লোকশিল্পীর সেই আগের অবস্থান নেই। উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু বেশিরভাগ শিল্পীই আজ স্বাদহীনতার ঘেরাটোপে থেকে ডুবসাঁতার দিচ্ছে। উঠে আসার উপায় নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সামান্য 'লোকপ্রসার প্রকল্প' হয়তো শিল্পীদের অল্পতম সহায়ক হয়েছে। কিন্তু তা তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হয়নি। তাঁদের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটেনি। এখনও তিমিরাচ্ছন্ন তাঁদের জীবন।
আসলে স্বাধীনতার এত বছর পরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে হারে মানোন্নয়ন ঘটেছে, সেইহারে শিল্পীদের কর্মসম্পাদনে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। সেই বস্তাপচা কুমোরের চাকাতেই আটকে থেকে ঘুরছে মাটির হাঁড়িকুড়ি তৈরির হতোদ্যম কাজ। এ তো এক ধরনের 'হারিকিরি'! তাই হাহাকার সর্বত্র। হাহুতাশ আজ শিল্পীদের মনে। হা পিত্যেশ করে চেয়ে থাকতে হয় সরকারের বদান্যতার দিকে। হাড়হাভাতে শিল্পীদের তাই হাঁড়িতে একমুঠো চাল ফেলার সেই কঠিন লড়াই আজও হারিয়ে যায়নি। স্বাধীনতার এত বছর পরেও তাই এঁদের স্বাদহীনতার রূপ রস গন্ধ গায়ে মেখে গান ধরে "তোর কি আমি লয় মনের মতন / তুই করলি কেন অযতন গো অযতন"!
মাদুরশিল্প –'রঙ্গ মসিনায় রঙ্গ কম্বলের বিছানা / তার পরে ঝিনবাস করে আচ্ছাদনা"। 
এই মসলন্দ মাদুর আজ আর কেবল ধনীদের গৃহশোভা নয়। সাধারণ মধ্যবিত্তও ব্যবহার করছে। তবে দীনদরিদ্র মাদুরশিল্পীদের নির্গত ঘামের মূল্য চুষে খাচ্ছে ব্রিটিশদের উত্তরসূরি এক শ্রেণীর ফড়ে, দালাল এবং তোলাবাজ। তবে একটু পরিবর্তন ঘটেছে এখন। যদিও প্লাস্টিকের সস্তাদরের মাদুরের কাছে হার মানতে হচ্ছে মাদুরকাঠির শিল্পীদের। 
পটশিল্প – "দেখিতে ভবের শোভা আকাশের পটে" - হেমচন্দ্র। 
পটের গান তো হারিয়ে যেতে বসেছে। আজ তুমুল দৈন্যদশা পটশিল্পীদের। বাধ্য হয়ে পটের চিত্র আঁকা সামগ্রী তৈরি করে বেচতে হয় মেলায়, বাজারে, পর্যটনকেন্দ্রে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা এখনও ডুমুরের ফুল। সর্বোপরি মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটেছে এখন। তাই এই রুজির মানুষদের একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলতে হয়েছে। ফলে রুটির অভাবে পেট কাঁদলেও মনোহর ফাঁসুড়ার স্রষ্টাদের এখন রূপহীন জীবন।
বয়নশিল্প – "নানা রূপ চিত্র কাঁথে / লিখিল যুবতী যূথে / মণ্ডল পাটনেত চন্দ্রাতপে"।  
আজ তাঁরা কোথায়? জেলায় তসর, রেশম ও কার্পাস শিল্পের নান্দনিক সৌন্দর্য মিলতো শিল্পীদের হাত ধরে। ১৮৫২ সালে কেশিয়াড়িতে ৯৫০ ঘর তসর শিল্পী ছিল। একসময় হিজলী ও তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়ে রপ্তানি হত বস্ত্র। সেই শিল্পীরা আজ কোথায়? কদিন আগেও তমলুক সংলগ্ন রাধামনি এলাকার গ্রামগুলির বাড়িতে বাড়িতে তাঁতকলের রমরমা ছিলো। নেই আজ। উন্নত প্রযুক্তির কাছে পাল্লা দিতে পারেনি তাঁরা। হারিয়ে গিয়েছে কালীডুংরি, লালডুংরি শাড়ি। হারিয়ে গিয়েছে চিরকালীন কিংবদন্তীর ছড়া - "শাড়ি বিড়ি রূপসী / তিন নিয়ে অমর্ষী"।
পুতুলশিল্প – "দস্যুগণ পরশে প্রভুর নারীগণ / পাষাণ পুতুলী হৈল ত্যজিয়া জীবন" - মহাভারত। 
আজ প্রায় হারাতে বসেছে টেপা পুতুল, দেওয়ালি পুতুল, জৌ পুতুল, খেলার পুতুল, কাঠের পুতুল, বৌ পুতুল, দস্তানা পুতুল, হিংলি পুতুল, তারের পুতুল, ডাঙের পুতুল এর একচ্ছত্র আধিপত্য। এখন রঙবেরঙের সস্তার চিনা পুতুল থেকে দামী বার্বিডল কচিকাঁচাদের হৃদয়হরণ করে নিয়েছে। তাই অতি সাধারণ মাটির পুতুলের শিল্পীদের হাতের তৈরি সামগ্রীগুলো এখন ব্যাকডেটেড। 
শোলাশিল্প - "সোলা হইতে পাতল বুড়া হৈল ততৈক্ষণ"- ময়নামতির গান। 
রঙবেরঙের রাঙতা ও জরির কারুকার্য খচিত শিল্পের সাথে কি লড়াইতে পারে এঁদো পুকুর ডোবা খালবিল  থেকে তুলে আনা শোলার ম্যাড়মেড়ে রূপ? আর এখন তো পরিবেশ দূষণের কারণে হারিয়ে ফেলেছি প্রকৃতির এইসব উপাদানগুলিকে। ফলে শিল্পীরা এখন গভীর তিমিরাচ্ছন্ন। খুদ খাওয়ার সুযোগ নেই।
মৃত্তিকাশিল্প - "মাটি হয়ে আছি মা! আমাতে আমি নেই" - দাশরথী রায়ের পাঁচালী। 
মাটির কাজ করে সংসার চালানো দুষ্কর এখন। মানুষ এখন অতি আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত। ফলে মাটির তৈরি টব, জলের কলসি, ধুনাচুর, প্রদীপ, তাবা, খাপরি, ঘটভাঁড় ছাড়া মানুষের চাহিদা নেই অন্য কিছুতেই। আর এগুলো তৈরি করে কি সংসার চলে?
আজ আর তৈরি হয়না পোড়ামাটির তুলসীমঞ্চ। মাটির হাঁড়িতে ভাত রাঁধার দিন ফুরিয়েছে। মাটির গ্লাস আর নেই। একসময় যাঁরা মাটির বাড়ি বানাতেন, তাঁরাও এখন কর্মহীন। পাকাবাড়ির রমরমা। ডাক পড়েনা তাই উলোটি দেওয়ার শিল্পীদের। কুমোরের ঘরে আজ রান্নার উনুনটুকুও জ্বলেনা মাঝে মাঝে।
শঙ্খশিল্প – "শঙ্খবণিকের করাত যেমন, দুদিক কাটিয়া যায়"- বঙ্গসাহিত্য পরিচয়। 
এই শিল্পটিও আজ মৃয়মান। শিল্পীদের তাই লবেজান অবস্থা। আসলে কাঁচামালের অপ্রতুলতা এবং অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি তাঁদের এই পেশাতে মন্দার ছোঁয়া এনে দিয়েছে। খুব অর্থবাণ ও নামকরা শিল্পী ছাড়া অতি সাধারণ শিল্পীদের কাছে অর্থ এবং সামর্থ্য কোনোটাই নেই এখন।
ঝিনুকশিল্প – "এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না, যাতে মুক্তো আছে"। 
দীঘা সমুদ্র তীরবর্তী গ্রামগুলিতে পূর্বের তুলনায় ইদানিং এই শিল্পটি একটু রমরমা। অনেক মানুষ বেঁচেবর্তে রেয়েছেন একে ঘিরে। পর্যটকসংখ্যা বাড়ায় এই শিল্পটিও অল্প হলেও প্রাণ পেয়েছে। গৃহশোভা বর্ধনে ঝিনুকের সামগ্রীর খুব চাহিদা এখন। তবে শিল্পীদের অভাব অভিযোগ শোনার কেউই নেই আজ। প্রশাসনের চরম দূরদৃষ্টির অভাব হয়তো একদিন এই শিল্পটিকেও মৃতদের দলে ফেলে দেবে।
এছাড়াও ঘঙপাতার টুপি, পাটজাত দ্রব্য, তালপাতার পাখা, পোড়ামাটির ছলন, কাঁথা তৈরি, লৌহসামগ্রী তৈরি করার শিল্পী মানুষজন চরম অস্থিতিশীল অবস্থায় দিন গুজরান করছে। কেউ নেই পাশে। ক্রেতা নেই। বাজার নেই। অথচ উৎপাদন খরচ হু হু করে বাড়ছে।
শিল্পীদের নাম এলে অবশ্যই আসবে লোকশিল্পীদের কথা। ঝুমুর, টুসু, ভাদু, কৃষ্ণযাত্রা, শয়াল গান, যুগীযাত্রা, পুতুল নাচ, চড়িয়া চড়িয়ানি পালাগান, ললিতা শবর পালাগান, গ্রামীণ যাত্রা, ভাঁড়যাত্রা, সঙের গান, ভারত গান, মাগনের গান, গাজনের গান, হাপু গান, কবিগান, তরজা গান ইত্যাদির শিল্পীরা আজ পাল্লা দিতে পারছেন না নেটযুগের ঝাঁ চকচকে দুনিয়ার সাথে। স্বাধীনোত্তর কালে সারা বিশ্বের মতো আমাদের গাঁগেরামের সাধারণ মানুষের জীবনের জলছবি এখন বদলে গিয়েছে অনেকটাই। সেই ধারাতে কিন্তু আমাদের চিরকালীন লৌকিক ঐতিহ্যের ধারকরা নিজেদের Update করতে পারেননি। যাঁরা পারেননি তাঁরা পিছিয়ে পড়তে পড়তে হারিয়ে যাচ্ছেন চিরতরে। সরকারেরও কিছু করার নেই এমতবস্থায়।  
আসলে যুগের সাথে তাল মেলাতে না পারলে সবকিছুই ইতিহাসের পাতায় চলে যায়। তখন সেটা খুব অমানবিক এবং বিসদৃশ হয়ে ওঠে জনসমাজের জন্য। জীবনের জন্য। বেঁচে থাকার জন্য। ফলে স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের চিরচেনা শিল্পীদের জীবনের স্বাদহীনতার কষ্টগুলো লেহন করতে হয় হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে। সেখানে তখন 'লাবডুব' শব্দ নয়, শোনা যায় একরাশ হাহাকারের প্রতিধ্বনি। শোনা যায় এক মুঠো ভাতের জন্য অমানুষিক লড়াইয়ের কাহিনি। শোনা যায় এক চুমুক ফ্যানের জন্য অভুক্ত শিশুর গোঙানি। শোনা যায় শুধু বেঁচে থাকার অব্যক্ত আর্তি। 
কিন্তু আমাদের চোখে ধরা পড়েনা ঐসব দালাল, ফড়ে, মহাজনদের মুখ। আমাদের কানে ঢোকেনা ঐসব সমাজবিরোধীর তকমাধারী বহুরূপী নেতানেত্রীদের হুহুঙ্কার। আমাদের মনে চেতনা জাগায়না স্বাধীনতার এত বছর পরেও যাঁরা এখনও স্বাদহীনতার যূপকাষ্ঠে নিত্যদিন পুড়ছে, তাঁদের অন্তরের ব্যথা নিরসনে সামান্য একটু বাড়িয়ে দেওয়া -- নিজের হাত!!
 
আসলে পরগাছার মতো থাকতে থাকতে স্বাধীনতার এত বছর পরেও বেঁচে থাকার স্বাদহীনতার জারক রসে ডোবানো এইসব শিল্পীরা আজ বোবা। বাউলের একতারা সুর তোলে। সেই সুর খিদের কথা বলে। কামারের হাতুড়ি রব তোলে। সেই রব বাঁচার কথা বলে। কবিয়ালের কন্ঠ বোল তোলে। সেই বোল লড়াইয়ের কথা বলে। কবির ভাষায় - "বাঁচান বাঁচি, মারেন মরি / বলো ভাই ধন্য হরি / ধন্য হরি ভাবের নাটে, ধন্য হরি রাজ্যপাটে / ধন্য হরি শ্মশানঘাটে, ধন্য হরি, ধন্য হরি / সুধা দিয়ে মাতান যখন ধন্য হরি, ধন্য হরি / ব্যথা দিয়ে কাঁদান যখন ধন্য হরি, ধন্য হরি / আত্মজনের কোলে বুকে ধন্য হরি, ধন্য হরি / ছাই দিয়ে সব ঘরের সুখে ধন্য হরি, ধন্য হরি"।

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...