কথামাত্র ।। সুকান্ত সিংহ

WhatsApp Image 2018 10 04 at 23.19.09

 
কথামাত্র 
সুকান্ত সিংহ
 

এক সাধু ছিলেন শ্রীবৃন্দাবনে। অন্ধ। রোজ হেঁটে যেতেন বাঁকেবিহারীর মন্দিরে। একেক দিন কেউ কেউ তাঁকে হাত ধরে এগিয়ে দিত। তিনি সাহায্যকারীকে হাতজোড় করে নমস্কার করতেন। এরকমই একদিন একজন জিজ্ঞেস করেছিল--'আপনি তো দেখতেই পান না, তবু রোজ কেন কষ্ট করে যান ?' সাধু মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিলেন --'আমি দেখতে পাই না ঠিকই, কিন্তু বাঁকেবিহারী তো আমাকে দেখতে পান।'

উত্তরটি আস্থার। অবশ্যই তাই। সাথে কি সংযোগেরও নয়? কোনও গুঢ়তত্বের ব্যাখ্যাময় উত্তরের চেয়ে এই যে দেখার অন্য দিক দেখা হল, এ তো আস্থার সাথে বাকের সংযোগ। নিশ্চয়ই এই যোগসূত্র অনায়াস লভ্য নয়। আবার এতটাও অসাধ্য নয় যে ধরা দেয় না।

নন্দিনী যখন রাজাকে বলে--'আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে তোমার সঙ্গে লড়াই'-- এই 'লড়াই' শব্দটি তখন আর কেবল রাজাকে লক্ষ্য করে নয়, এই লড়াই হয়ে ওঠে সমস্ত স্থবিরতার বিরুদ্ধেই। এই একটি মাত্র সংলাপ রক্তকরবীর অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্যকে প্রতিভাত করে তোলে। অথচ গুনে দেখলে কটি মাত্র শব্দ। একটি মাত্র বাক্য।

গুটিয়ে বসা পাখির ডানার বিস্তার বোঝা যায় না। তার অস্তিত্ব ধরা পড়ে ওড়ার মূহুর্তে। তখন আর সে শুধু পালকগুচ্ছ নয়, সে তখন বিস্তারের নিজস্ব টোটেম।

ভাব আর বাকের সাযুজ্য সবসময় এক বিন্দুতে মেলে না। উচ্চারণের প্রতিশ্রুতিই বাকের সার্থকতা বয়ে আনে। ভাব তো মননের সাথে সম্পর্কিত।
'বাঙ মে মনসি প্রতিষ্ঠিতা, মনো মে বাচি প্রতিষ্ঠিতম্' বাক্য মনে প্রতিষ্ঠিত হোক, মন বাক্যে প্রতিষ্ঠিত হোক এই ইচ্ছে প্রকাশ করার পর বলা হচ্ছে 'অবিরাবীর্ম এধি, বেদস্য ম আণীস্হ' হে স্বপ্রকাশ আমার কাছে প্রকাশিত হও। এই ছিল একসময় ঋকবেদের প্রার্থনা। বাক্ আর মননের পারস্পরিক সংযুক্তির পরেই কিন্তু আসছে বিরাটের ধারণা।

অথচ বৃহতের আধিপত্য দেখতে দেখতে একসময় ভুলেই গিয়েছিলুম তার আগের তথাকথিত স্বল্পতা আমার দৈনন্দিন মোরাম রাস্তার সঙ্গি। তার জড়িয়ে থাকাকে সময় বিশেষে এতটাই উপেক্ষা করেছি যে, যখন তার প্রকাশ দেখি, তখনও তাকে সন্দেহ করি -- তাই? তুমি ছিলে আমার সঙ্গে ! এও এক অসুখ। যা দানা বেঁধে আছে আমার পারিপার্শ্বিকের সাথে।

একটা পুরাতন বিশাল কাঠের দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তার গায়ে অচেনা ফুলপাতা নকশা খোদাই করা। দরোজার ওদিকে যে আছে , তাকে মনে করিয়ে দিতে এসেছি--একদিন আমাদের একসাথে দিগন্তে গিয়ে দাঁড়াবার কথা ছিল। দরোজার বালা ধরে বারকয়েক নাড়া দিলুম। একটা বিশাল দরোজার সামান্য একটা বালা ওদিক থেকে সাড়া বয়ে আনল-- কে?
আজও কাউকে দরোজার এপার থেকে ডাকতে গেলে মনে পড়ে কেবল গুলপেরেক নয়, কেবল ফুলপাতার নকশা নয়, দরোজায় চুপ করে আছে সাড়া পাবার ছোট বালা !

এই জগৎব্যাপি রাশি রাশি শব্দের সমারোহ, এইযে বলার পর বলা, আরো আরো বলা আমাদের ঘিরে ধরছে দীর্ঘতার অবয়বে, এর কতটুকুই বা জলকাদাপৃথিবীর নিজস্ব স্বর? অবিরাম কথাস্রোত কেবলই আরেক কথার কাছে মাথা খুঁড়ছে স্বীকৃতির জন্য বলে মনে হয়। স্বল্পে যা বলা যায় তাকে টেনে দীর্ঘ করার কোনও মানে নেই। সেও এক হত্যা, অবশ্যম্ভাবী দীর্ঘতাকে সংকুচিত করার মতোই আত্মহনন। অপব্যয়ের এক দাম্ভিক দেখনদারি।

আদপে মনন সূক্ষ্ম থেকে স্থূলে যায় উচ্চারণে পরিনত হলে। ভাবনার সূক্ষ্মতা কণ্ঠস্বরে হয় বৈখরি। আর এই কণ্ঠ থেকেই যাত্রা শুরু করে ধ্বনিবিজ্ঞান। যত বেশি প্রকাশ, তত বেশি স্থূলকায়। কেউ কেউ এর বিপরীত যাত্রাও করেন। সে যাত্রা থেমে গেলে নকশা কাটা দরোজা দেখতেই দেখতেই সময় বয়ে যায়, সাড়া পাবার বালা আর চোখে পড়ে না।

যার চোখে পড়ে সে একটিমাত্র শব্দ নিয়েই হেঁটে যায় অনেকটা পথ। একটা সাইকেলের ক্রিং শব্দও কোনও এক কিশোরীকে ব্যাকুল করে। ধাতব সেই শব্দকে ঘিরে থাকে হাজারো বাক্। যার চারদিকে থাকে আকূতির ঘন শ্বাস। আরো কেউ কেউ জেনে যায় ওই শব্দের মানে। তাদের পাড়াতুতো প্রতিরোধ এগিয়ে আসে। আধিপত্য জেগে ওঠে ক্রমে ।

বাক-প্রাচুর্যের মধ্যেই বিস্ময় চিহ্ন হয়ে থাকে অণুকবিতা। আমাদের ধাতুপৃথিবীতে তারা ডানা লুকিয়ে রাখে। কেবল খাদের কিনারে গেলে বোঝা যায় তার বিস্তারের সক্ষমতা। তারা থাকে ভাবনার সহোদর হয়ে। যুগলপ্রসাদের মতো লবটুলিয়ায় তারা পুঁতে চলে বীজ।

চন্দরা কহিল -- 'মরণ !'

যা বলতে চাই, তাকে সংকুচিত করে বলা নয়, বরং যেটুকু বলা হলেই 'অধিক' বাহুল্য হয়ে পড়ে, সেটুকুও না-বলাই অণুকবিতা। বাগাড়ম্বর থেকে এর অবস্থান স্বতন্ত্র ও স্বতঃস্ফূর্ত। আসলে চন্দরার ওই 'মরণ' উচ্চারণের সাথে সাথেই পূর্বের পংক্তিগুলির প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃতি পায়। ম র ণ এই তিনটি মাত্র অক্ষর না থাকলে ব্যর্থতার চিহ্ন বহন করত শাস্তি।'
আমাদের স্বর্গ নেই স্যারিডন আছে'-- এই কথা বলা মাত্রই ভাস্কর হয়ে ওঠেন আমার ভাষাপৃথিবীর একমাত্র ঈশ্বর, যিনি কবির ছদ্মবেশে কটাদিন ঘুরে গেলেন।

অণুকবিতা মৃৎশিল্পীর হাতে গড়া সেই টেরাকোটা, যে আছে জোড়াবাংলোর শরীর জুড়ে। অণুকবিতা কুমার গন্ধর্বের কণ্ঠে জেগে ওঠা কবীরভজন। ঋত্বিকের অযান্ত্রিক। নবারুণের 'ভাল করে ঘুমোক। ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে।'

অণুকবিতা হল রীনা ব্রাউনের -- 'আমাকে। টাচ্। করবে না।'
 
 
 ( গদ্যটি শারদীয় মহুল ১৪২৩ থেকে সংগৃহীত )
 
 

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...