অগ্নির কবিতা অগ্নির প্রেম ।। পারমিতা ভৌমিক

 

 

 

 

অগ্নি বসু আলোর কবি। প্রেমই সেই আলো যা তাঁর কবিতার সম্পদ। প্রেমের মৌলিক পথেই সর্বস্ব সমর্পণের আনন্দ মেলে---এ কোনো তত্ত্ব নয় , এ হল ঊর্ধলোকের আপন প্রাণের ধ্বনি। অগ্নির কবিতায় সে ধ্বনি সুলক্ষ‍্য---

"তুমি,ভ্রমর,তুমি আমায়
কখন ডেকেছিলে?
তোমার ও সুর
চিনতে পারিনি!"
"তোমার ছায়া
থমকে আছে নীলাভ জানলায়,
ডাকছে নদী, থমকে দাঁড়াই,
নৌকো ডাকে 'আয়'....",
অগ্নির কবিতাতে প্রেম কখনো নিসর্গপ্রকৃতি, কখনো নারী,কখনো সমগ্র মানব প্রকৃতি,কখনো অধিআত্মার রূপেই ধরা দিয়েছে। পরিণত অগ্নিপ্রতিভায় দেখেছি তাঁর প্রেম চূড়ান্ত ঐশীপর্যায়ে পৌঁছে গেছে।এক অপার্থিব মহাসঙ্গীতে কবি যেন স্বয়ং উপস্থিত।
অগ্নি বসুর কবিতা পাঠ করছি সুদীর্ঘ দিন। তাঁর সব কবিতা পড়েই এমনটা মনে হয়েছে...
কী মধুর প্রেমকথা ভাসিয়ে নিয়ে যায় পাঠককে---
"মায়াটুকু লেগে আছে
আঙুলের তিলে,
কেন ছুঁয়ে দিলে!"...দেখেছি
ভাবের গাঢ়তায়,শব্দ ব‍্যবহারের সংযমে অগ্নির কবিতা মন্ত্রময়।বস্তুতঃ প্রেম আর পূজা এক না হলে সালোক‍্য, স্বারূপ‍্য সার্স্টি কিছুই মেলেনা। অগ্নির কবিতা মন্ত্রসিদ্ধির দিকে এগিয়েছে শেষ পর্যন্ত।ভারতের ঐতিহ্য যেন অগ্নির কবিতাতে প্রকাশ উন্মুখ। কিন্তু কোন গুণে তা সম্ভব হচ্ছে? আমার ধারণাটা তবে বলি---
তিনটি গুণ একসঙ্গে মিললে মন্ত্রধ্বনি সৃষ্টি হয় ---

১. A highest intensity of rhythmic movement...একটু লক্ষ্য করলেই অগ্নির কবিতায় দেখবো ছন্দের অলৌকিক দোলার পরশ মিলবে লৌকিকে।
২. A highest intensity of interoven verbal form and thought-substance , of style--চিন্তা ও বাচনের পাশাপাশি এগিয়ে যেতে যেতেই রচিত হবে ভবিষ্যতের কবিতা।
৩. A highest intensity of the soul's vision of truth--এটিই কবিতা সৃষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।অগ্নির কবিতাতেও তাইই দেখি,দেখি অভিমুখ অনন্তের দিকে...
"উঠোনে এসেছে নেমে চাঁদ,
পাতাছেঁড়া গানের বিতান,
হৃদয়ে গহন পরমাদ,
'হারিও না, যা দিয়েছিলাম...'
অগ্নির কাব‍্য সার্বভৌম।Revelatory...অথচ তার সহজ পরিবেশনা মুগ্ধ করে। মহৎ প্রেম তাঁর কবিতায় স্বাগত। এই মহতী পরিণতি অলক্ষ‍্যে ঘটে চলেছে অগ্নির কবিতা তে। আমরা দেখছিনা অথবা দেখার চোখ হারিয়েছে। অগ্নি বসুর কবিতা আমাদের পৌঁছে দেয় মোহময় এক অনাবিল আনন্দ লোকে যেখানে বিষণ্ণতাও অলৌকিক আলোময়। কখনো কখনো শিহরিত হই জাদুবাস্তবের রঙীন কাচে আমাদেরই চারপাশের রিয়‍্যালিটি দেখে---
"...'ঝিরিঝিরি বাতাস কাঁদে,তোমায় মনে পড়ে...'
শ‍্যামল মিত্র। ওই নোকিয়ায়। এটাই তো রিংটোন...
মেঘ থই থই কান্না-বিকেল, জল রাস্তায়, ঘরে,
কোনো কথা নেই ওপারে! বেজে যাচ্ছে ফোন...অসাধারণ পার্সোনিফিকেশনে বিকেলের বেদনাময় ছবি এক বিমূর্ত প্রেম বিরহের saga তৈরী করেছে। প্রেম এখানে জগতীফ্রেমে অলৌকিকের ভৃঙ্গার ভরে দিয়েছে।
মনে হয় প্রেমের
এই উড়ানটাই পাঠকমন চাইছিল।
অগ্নির কবিতায় পরানো আছে প্রেমভাবনার মায়াঞ্জন। পাঠককে কবি পৌঁছে দিতে পেরেছেন এক বাস্তব-অতিক্রান্ত(surreal) জগতে । অগ্নির কবিতা মানেই মুক্তির এক অখণ্ড আকাশ। পাঠক মাত্রই জানেন, অগ্নি বসুর কবিতায় মূল সুরটি দূরবগাহ। উচ্চতর প্রেমভাবনায় তাঁর কবিতা জারিত। এখন অনেকেই এই প্রেমভাবনা কে খোকাখুকীপ্রেম বলে হেয় করেন। হয়তো বোঝেন না নয়তোবা বুঝতেই চাননা যে, সব আকর্ষণই স্বরূপতঃ প্রেম এবসোলিউট। তা ঈশ্বরের আনন্দশক্তি...
কখনো জৈবদেহে কখনো ভাবদেহে তা উছলে পড়ে। সচ্চিদানন্দ স্বয়ং প্রেম, তা বিনে গতি নেই। সৎ---
existence absolute
চিৎ--consciousness absolute
আনন্দ---
Bliss absolute
প্রেম এই ধারণাতে কি অনন্ত নয়?
আসলে সৃষ্টির পদার্থিক মৌল আকর্ষণ বিকর্ষণের খেলা টিকেই কবি অগ্নি মানবিক শুদ্ধপ্রেম ভাবনাতে ধরতে চেয়েছেন। জগতী শুদ্ধতা তাই প্রেমবৈচিত্তের হেতু।
ভাবনা যত পরিশুদ্ধ হবে , তত সে ঊর্ধমুখী, উৎসগামী হবে। একক স্বরে ও স্বরায়ণে কবিতার গয়ায়াতটি স্থির হবে। অন‍্যকিছুও হতে পারে তবে তা নিতান্তই কবির ব‍্যক্তিগত স্টাইলের কথা। মীরা রুমি কবীর রামপ্রসাদের মত মন্ত্রবদ্ধ হতে পারে আবার শ্রীঅরবিন্দের সাবিত্রীর মত দীর্ঘও হতে পারে, কিম্বা অণুদেহ কবিতিকা হতে পারে। সাবিত্রীরও উপজীব‍্য ঈশ্বরীয় তথা মানবিক প্রেম। জগতী প্রেম অলৌকিক সাধনায় ব্রহ্মবস্তু হয়ে গেল।
অগ্নির প্রেম ভাবনা যতটা রোমান্টিক ততটাই ক্ল‍্যাসিক। ভাবনা প্রথমাবধি সংহত, মন্ত্রস্বরূপ। Horizontal বা ভূমিলগ্নতা নেই এমন তো নয় অগ্নি বসুর কবিতা? তবে একথা বলতে পারি, বিরাট বিস্তারে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আবার আত্মসংহত হননি কবি। গ্রিসীয় স্থাপত‍্যের ছাপ পাই তাঁর কবিতা দেহে।আসলে কবি জানতেন ,ছড়িয়ে পড়তে পড়তে অনেক ক্ষেত্রেই পতনের সম্ভাবনা এসে যায়। আসলে অবশ‍্য এ সবটুকুই কবিপ্রতিভার গড়নের তারতম‍্য।
অগ্নি বসুর প্রেমভাবনায় যেমন একমুখীনতা আছে তেমনি আছে অন্তর্লীন বৈচিত্র। কবি জানিয়েছেন----
"হারিয়ে ফেলেছি, অলখ, তোমার অঙ্গুরি

হারিয়ে ফেলেছি হিম-কুয়াশার হাওয়াতে

এতোদিনে আজ বুঝেছি যে প্রেম ভঙ্গুর-ই
বেলা গেল শুধু অকারণ পথ-চাওয়াতে

যে ছিল সুদূর তাকে যে শুধুই ডেকেছি
ভুলেও দেখিনি, কে ছিল দুয়ারে দাঁড়িয়ে
বলো তো, অলখ, এ কী ঘুম-ঘোরে থেকেছি
অলখ, তোমার অঙ্গুরি গেছে হারিয়ে"-----
এ কবিতা পড়লে প্রশ্ন জাগে পাঠক মনে,সত‍্যিই আমরা প্রেমপথে ঐ অলখের অভিজ্ঞান কি হারাইনি? Malady of the age... কুরে খাচ্ছে জীবন। গভীর অ-প্রেম আর বাচনসর্বস্বতা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে না কি উষ্ণ উৎস বিয়োগের (alienation)কথা? অগ্নির কবিতার কথা মুখে বলা যায় না। এসব কবিতা, উপলব্ধির সম্পদ। শাশ্বত।।
অগ্নির সব কবিতারই সাধ‍্যবস্তু প্রেম ,তাঁর সব কবিতাই প্রেমে রুচিসুন্দর, শ্রুতি সুন্দর, সায়ণীর উজ্জ্বল টিপখানির মতো। জ্বলজ্বলে... প্রভাস্বর....
"এলে না, দখিনহাওয়া!
তোমার অভিমান হয়েছে, কখনও
তোমায় দেখা দিইনি বলে!
আমার প্রাণটুকু তোমায়
দিয়ে দিয়েছি যে। দেখতে পাও তুমি?
দখিনহাওয়া, তুমিও যে আমার দুচোখের আড়ালে।
তবু কতো ভালোবাসি, সোনা।"...প্রেম এমন নৈর্ব‍্যক্তিক হয়!!?
অগ্নির কবিতায় ভালোবাসা এক বিদেহ-সম্ভব পাড়ি। উজান পথে কবি এসে দাঁড়িয়েছেন হারানো অভিজ্ঞানের সামনে। বিনম্র উচ্চারণে ধ্বনিত হয়েছে--- হারিয়ে ফেলেছি, অলখ , তোমার অঙ্গুরী। অগ্নির কাব‍্যজগতে একটা ত্রিস্তর আদর্শ আমরা দেখি।
১. কবিতা যেন স্থির জলে প্রতিফলিত একটি স্বচ্ছ ছবি...
২. কবিতার মন্ত্রস্বরূপ হয়ে ওঠা... এখানে কাব‍্য নির্মেদ। নিরর্থক কিছু থাকে না। সংক্ষিপ্ত দৃঢ়বদ্ধ গাঢ় তপঃশক্তির প্রাচুর্যে ভরা।
৩. এই স্তরের কবিতায় এমন সব বাক‍্য থাকে যা অর্থ ও কল্পনাকে ভেদ ক'রে , তাকে অতিক্রম ক'রে, এনে দেয় কুহেলিকাময় তূরীয়ের বার্তা।প্রতীয়মান অর্থের আড়ালে অবাঙমনসগোচর কে ইঙ্গিতীত করে।
এই ত্রিধারাসঙ্গমই অভিপ্রেত। অগ্নির কবিতায় এসব এসেছে সহজ ভাবে। তাঁর কবিতায় সবসময়ই একটি নিগূঢ়প্রেমের ভাব, বিরাটের প্রসারণে লীলায়িত । অগ্নির কাব‍্যসম্ভারে সর্বত্রই রয়ে গেছে অলৌকিক প্রেমকথা । তাঁর কবিতা মূলতঃ মিতভাষ কবিতা । প্রায় সব কবিতার চারপাশ জুড়েই এক নিঃসীম নীরবতার তরঙ্গ.বয়ে চলেছে । যেন অনাদি অনন্ত কাল ধরে সেখানে কোন শব্দরাশি প্রবেশ করেনি । কবি লগ্নতার স্পেস দিয়েছেন । এই স্পেসটুকু, শূন্যতা ও স্তব্ধতার । সুগভীর এই স্তব্ধতা প্রেমে সুন্দর মধুর---
ও দিনান্ত,ওগো অথৈ জল,
এবার চলি।
রইলো কোলাহল।"--আদ‍্যন্ত রোমান্টিকতার সঙ্গে মিশেছে মানুষ প্রকৃতি ও পরমের সুর।
অগ্নির কবিতার
মৌনতা ,ভাবাতীত রূপাতীত মনাতীত এক মহা সৌন্দর্যের বাণী নিয়ে আসে পাঠকের কাছে । ঠিক সেইখানে মানবীয় প্রেমটুকুর উত্তুঙ্গতা উপলব্ধি করা যায়। মানুষের প্রেমই দিব‍্যতায় উত্তীর্ণ হয়েছে অগ্নির কবিতায়---
"কেঁদে ফিরি আমি,
নিরুপায়,
সে কাঙাল চলে যেতে চায় ..."
অগ্নি বসুর কবিতাকে ধরে আছে প্রেম-সত‍্যের গীর্বাণীর তপঃশক্তি। অনন্ত এখানে তার স্থূল আবরণটি খুলে দিয়েছে। এসব কবিতায় রয়েছে নিবিড় ভাব ও অব‍্যর্থ অর্থশৃঙ্খলা। কবির প্রাণের তন্ত্রী আশ্চর্য রকমের সূক্ষ্ম ও সজাগ। তাঁর কবিতার মধ‍্যে প্রতিবিম্বিত হয়েছে অতীন্দ্রিয় ও অশরীরী প্রেমভাবনা। ধরা পড়েছে যা তূরীয় অধরা অথচ অন্তরঙ্গ। অনন্তপ্রেমকে অদ্ভুত অবগুণ্ঠনে ঢেকে দিয়েছেন---
"একটু গোপন চাওয়া
চকিত শিহর
বিরহ , এসেছো?"...
অগ্নি বসুর প্রকৃতিতেই রয়েছে নীরব সাধনার বীজ। তাঁর বিশ্বাস প্রেমই হলো অসীমের আপন স্বাক্ষর।সর্বত্রই প্রেমের সাড়া। প্রাণিক তৃষ্ণাতেই কবি অন্তরকে বাইরে এনেছেন তাঁর কবিতায়। অগ্নির আর একটি অসাধারণ প্রেমের কবিতা পড়ে নেব -----
"আজ কী ভেবেছি, নখের আঁচড়ে লিখে দি' পেলব গাত্রে,
সকাল হলে তো মনেও থাকেনা,
কী ভালোবেসেছি রাত্রে"
অগ্নি বসুর এ কবিতাতে রয়েছে "দেহাতীত দেহবোধ"।
সিনেস্থিসিয়ার ইমেজ ধরে রেখেছে হৃদয়ের পাত্রখানি।
খুব আশ্চর্য হই যখন দেখি এই দেহাতীত-দেহবোধ সুগম্ভীর অনুনাদে বেজে ওঠে। এ কবিতায় আরো একটি গভীর রহস‍্য আছে ----- কবির অন্তর্মুখ-শরীর-সংবিৎটি একেবারেই বিষয়হীন। যাকে বিষয় বলে মনে হচ্ছে আসলে তা মানসবিচরণ। এই চলন বিষয়হীন (objectless) বলেই অবাধ। সামনে কোনো প্রতিবন্ধক নেই। এ দেহবোধের চলনটি অসীম। Object নেই বলেই অনুভূতিও অবাধ। কেবলমাত্র অনুভূত প্রেমস্বভাবও তাই এ কবিতায় পেয়েছে অসীম উড়ান। বলাই বাহুল‍্য এই অনুভবের কেবল ভিতর আছে বাহির নেই। আশ্চর্য প্রেমবোধ !!!! আর একটি কবিতায় ঐ আশ্চর্য প্রকাশ দেখবো----
"সে-যামিনী স্বপ্নের ছিলো,
সে-যামিনী ছিলো আঁধিয়ার,
সে কাঙাল দোরে ডাক দিলো,
কেন ফিরে গিয়েছে আবার !"----একই অধিআত্মার ভূমিতে সব মরমীয়া কবিতার জন্ম। অগ্নি বসুর কবিতাও তাইই। তাঁর কবিতায় অন‍্য এক বোধ ও বিশ্বাসের জগৎ উন্মোচিত হয়ে যায়, প্রেমের জগতেও তেমনটাই ঘটে যায়। একধরনের ভাবাত্মিকতায় পাঠক আবিষ্ট হয়। এ এক মহতী প্রেমবোধ । অগ্নির কবিতা কঠামোটিকে ধরে থাকে এক মহাজাগতিক স্পন্দন। প্রেম এক সুধা, কিন্তু ধারণ পাত্রটি চিরন্তন নয়। তাই, অনন্তকে আস্বাদনের একমাত্র এবং নতুনতম পথ হল প্রেম। তাঁর কবিতায় সেই ইঙ্গিত রয়েছে----
‌প্রেম সেখানে এক অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গস্রোত। এরি মধ্যে খেলে চলেছে কতশত বোধ। কবির কবিতায় হৃদয় পাতলে শোনা যায় ঐতিহ‍্যের ঐকতান।
অগ্নির কবিতা কাঠামোতে একটা pseudo সংলাপ রচনা , কবিতার মেজাজটি তৈরী করে দেয়। দুই reality র কুহক তৈরী করে দেওয়া অগ্নির নিজস্ব mystic style.....
"সে ডেকেছে , যাবো, নীপবীথি ?
একবার শুধু তুমি ভাবো,
কী বাঁধন এ রাঙা সিঁথির,
তাকে পাবো, তবু নাহি পাবো"
অগ্নির প্রেমবোধের আসল কথা আকর্ষণ তৈরীর অলৌকিকতা। ব‍্যাপারটা এইরকম...কৃষ্ণের যতখানি প্রেমমাধুর্যের ক্ষমতা ছিলো ঠিক ততখানিই ছিলো রাধার আত্ম নিবেদনের ক্ষমতা। কৃষ্ণের প্রেমবিলাসে উপজাত হল রাধার যন্ত্রণা তবু সে বেদন রাধারই বিরহে মধুর হল। কৃষ্ণ ও রাধা আসলে অগ্নির প্রেম প্রকাশের মিথ---
"বলো তো যাজ্ঞসেনী,
যখনই ডেকেছো তুমি,
আমি কি আসিনি!
বলো,
কেন ডেকেছো আমায়!

নীপবনে
বাঁশি এসে সাড়া দিয়ে যায়..."
---বাঁশির ডাকে রাধাত্মা ও যাজ্ঞসেনী এক হয়ে যায়। পার্থক্য দেখি জগতী সম্পর্কে। একটি সখ‍্য অন‍্যটি মধুর। অগ্নি জেনেছেন ঐ দুটোই প্রেম absolute....
অগ্নি বসু আমার সমকালের অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর কবিতা পড়ে বুঝেছি অরূপেরও একটা আকর্ষণ আছে .....সেই সৌন্দর্যেই প্রচ্ছন্ন রয়েছেন অন্তঃপুরুষ.....কবির উপলব্ধিতে , প্রেমবোধে ও সৃষ্টিকার্যে আত্মসমাহিত সেই সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে! বাইরের সৌন্দর্যে তিনি হারিয়ে যাননি! তিনি জানেন ...নেহ নানাস্তি কিঞ্চন! তাই দেখি কবির কবিতায় বাইরের অশেষ রূপবৈচিত্র্যে র মধ্যেও গোপনে অন্তরে অন্তরে পুষ্ট হচ্ছে এক অরূপ অধরা সৌন্দর্য ও প্রেমচেতনা..!!
অগ্নি বসুর এই ত্রিবেণী-চেতনার মর্মমূলে রয়েছে এক অপ্রাপনীয়ের জন্য বিরহের স্বপ্ন ! কবির এই প্রেমচেতনা তাঁর কবিমানসের সংস্কার! বিপ্রলম্ভ প্রেমচেতনা কবিকে বিশ্বতোমুখী করেছে! কবি উপলব্ধি করেছেন মিলনে প্রিয়া বিশ্বকে আড়াল করে য়াখে, আর বিরহে ত্রিভুবন তন্ময় হয়ে যায়! অগ্নি বসুর ত্রিভুবন তাঁরই প্রেমচেতনায় তন্ময়ীভূত হয়ে আছে !  এ এক অতীন্দ্রিয় ভাবাবেশের উদ্ভাস! এ বুদ্ধির অগম্য !  আমাদের কবিকে যেন পরীতে পেয়েছে !  কি অলৌকিক রোমান্টিকতা তাঁর কবিতা দেহে ! তিনি খুঁজেই চলেছেন চিরপলাতকা মানস সুন্দরীকে ! মিষ্টিকের এটাই মনোধর্ম! কবি এই মরমীয়াবোধকে ভাষার তীরে পৌঁছে দিতে পেরেছেন !  বিরহীপ্রিয়ার ছায়াই কবির মানস সঙ্গিনী। অনুষঙ্গ হিসেবে কিছু কিছু স্বপ্নকামনাও রয়েছে তাঁর কবিতায়!!
কি অলৌকিক রোমান্টিকতা তাঁর কবিদেহে !
তপঃশক্তির সুষীম রেখাবদ্ধ সৃষ্টির মধ্যেই অরূপের আভাস রয়েছে অগ্নি বসুর কবিতায়! একটা অতিন্দ্রীয় ভাবকেই যেন পাঠকের গোচরে এনে দিয়েছেন কবি। এনে দিয়েছেন আমাদের উপলব্ধির মুঠোর মধ্যে। আশ্চর্য এই আমরা প্রায়শই তাকে না পারছি ছুঁতে, না পারছি হৃদয়ঙ্গম করতে। মিষ্টিক কবি পাঠকের লুকোনো মিষ্টিক বোধটিকেও উদ্দীপিত করে দিচ্ছেন! আলো আর মেঘের কানাকানি, সরসীর সরস মন্তব্য,! সৌন্দর্যে মাধুর্যে সৃষ্টি করে অলৌকিক! কখনো ভাবে কখনো বস্তুতেও......
অনন্তবোধের একটা নিজস্ব রস আছে। আর্টের বিচার করতে গিয়ে সেটা আমরা ভুলেই যাই। আর্টের মূল কথা চিরন্তন আনন্ত্য! বস্তু সত্যের ওপর বৈরাগ্যের রঙ মাখিয়ে দেয়াই ধ্রুপদী ধর্ম। অথচ সত্য ও সুন্দর সেখানে কতো অবাধে খেলা করে। আর্ট আর অধ্যাত্মে , বস্তু সত্য ও কাব্য সত্যে কোন ভেদ নেই। অগ্নি বসুর কবিতা পড়ে এ বিশ্বাস আমার স্থিরবদ্ধ হয়েছে .....
কোথায় কখন কিভাবে যেন ভাব বস্তু হয়ে যায় আবার পরক্ষণেই বস্তু ভাব হয়ে অনন্তে ডানা মেলে দেয়! ম্যাজিক রিয়ালিটি কি অনায়াসেই না নিজের জায়গা করে নেয় অগ্নি বসুর কবিতায়!!! কবির কল্পনায়িকা
উর্মি কেমন করে যেন হয়ে যায় গোলাপী ঠোঁট হলুদ বেনে বৌ পাখি .......
অগ্নি বসুর. কাব্য ভাষা একটু অন্যরকম! প্রাণের আবেগ-এর, বাইরের দিকে ছুটে চলার যে অসহিষ্ণু প্রেরণা থাকে, তাকেই কেমন যেন থমকে দিয়ে গাঢ় এক চিন্তার রসে ভাসিয়ে দেন কবি!
ভাবের পিছনে রয়েছে কবির চিন্তার সুস্থিরতা! নিরেট ভাব -স্থৈর্য ও কথাভঙ্গীর সুগভীর স্বচ্ছতা সুভাষিত ( এপিগ্রাম) এর মতো!
লৌকিক প্রকাশ এবং অলৌকিক অপ্রকাশের মধ্যে কবি পেয়েছেন একটা সামঞ্জস্যের খোঁজ! সংক্ষিপ্ততার মধ্যে দেখেছেন অনন্তের অভিব্যঞ্জনা! এই অনন্তই ধরে আছে কবির প্রেমভাবনাকে।কবি বিশ্বের গোপন কথাটি কেমন এক যাদুকরী ভঙ্গিতে বলেছেন! সেই অর্থগৌরবকে স্ফুটে প্রকাশ করা যায়না। তাঁর কলমের শুচিতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এইখানে শুচিতা কে বলছি প্রসাদগুণ ও সংযম। কবিতায় কোথাও গাঁট নেই, মোচড় নেই। সহজ সরল সুন্দর প্রেমটুকুই জেগে থাকে! অগ্নির শব্দ প্রয়োগ শিথিল বাচাল বা দুর্বল নয়। রচনা -রীতির শালীনতা তাঁর কাব্যসম্পদ। শুধু তাই নয় কবির ভাবেরও একটা বৈশিষ্ট্য আছে। ব্যথায় বেদনায় ক্রন্দন নেই, আছে কেবল চোখে ছলছল এক ফোঁটা জল। বেদনা গাঢ় কিন্তু কোথাও তা স্বচ্ছতা হারায়নি। বেদানাকে নিবিড় তৃপ্তিতে পরিণত করার জাদু আপনার আয়ত্তে।
অগ্নির ভালোবাসার কথাই বলি, ......
সেখানে কোনো আকুলতা উগ্রতা বা বিহ্বলতা নেই। আপনার বিরহ অভাবাত্মক নয়। তা পূর্ণ। ভালোবাসার সার্থকতা ভালবাসায় বলেই প্রতিদানের প্রশ্ন এখানে নেই। এ সাত্ত্বিক চিত্তাভাব আজ দুর্লভ।
আধুনিকরা বক্রোক্তি করবেন প্লেটোনিক বলে।তাঁরা অনেকেই হয়ত বলবেন ...ও সব জোলো কথা। বলতে পারেন, কবির চিত্তাবেগে ঝর্ণার উচ্ছলতা নেই, নেই সাগরের উত্তাল উদ্বেলতা.... কিন্তু আমরা জানি আছে পাহাড়িয়া জলাশয়ের নির্মল
সুষীম সমাহিত চারুতা।
অশ্বখুরে স্তব্ধতা বিঘ্নিত করে চলা তাঁর ধাত নয়। তিনি মেঠোপথের পায়েচলা পথিক।
তাঁর সুরটিও মেঠো। তা খেলা করে কোমলে খাদে। উচকিত শার্দুল বিক্রীড়িত ছন্দ চিৎকার অগ্নির নয়। আটপৌরে অনাড়ম্বরতাই তাঁর কাব্যলক্ষ্মীকে করেছে হ্রীময়ী ও শ্রীময়ী।
আত্মহারা প্রেম এখানে বস্তু জগতের সব গন্ডী পার হয়ে দেশ কালসীমার বাইরে এক নতুন জগতে নিয়ে যায় । তাঁর কবিতায় অন্য এক ধরণের বেদনা রয়েছে । সে বেদনা কেবলমাত্র সৃষ্টির নয় । সৃষ্টি-পূর্ব অলৌকিক এক বেদনার লৌকিক অনুভূতি যেখানে আচ্ছন্নতা এসেছে মৃদু কিন্তু নিশ্চিত পায়ে । এও এক দেবাবেশ ! এ যেন, অনন্তকে ধরা একহাত সাদা রেশমে !! এ এক হৃদয় সংবেদী সার্বভৌম বেদনা যা অগ্নির প্রেমবোধের সূর্যফসল। 


কবি শুদ্ধচৈতন্য না হলে কবিতা সার্থক হয়না । সেই চৈতন্য থেকে ঠিকরে পড়ে প্রতিভার আলো ! সে আলোয় প্রভাস্বর হয় চরাচর ।  অগ্নি বসুর কবিতায় সেই আলো আছে ।

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...