লেদ কারখানার কর্মী বাপি হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরেই স্ত্রী-রূপাকে বলল-
'দরকারী জিনিসগুলা গুছি লও। আজ রাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে'
রূপা বলল-'রাতেই!'
'হ্যাঁ রাতেই। দিনের বেলা পুলিশ ঝামেলা করবে'
'কাজ বন্ধ। টাকা নাই। এখেনে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। ছেলের কত টাকার ওষুধ লাগে, কুথা থেকে এসব পাব। দেশে গেলে রেশনের চাল, মাঠে-ঘাটে কাজ করে অন্তত একবেলা খেয়ে বেঁচে থাকতে পারব। আজ রাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে।'
এগারো বছরের ছেলে হাঁটতে পারেনা, পরিষ্কার কথা বলতে পারে না, সব কথা বুঝতেও পারে না। এই ছেলেকে নিয়ে অতদূর রাস্তা (বাসে আট ঘণ্টা লাগে) কেমন করে যাবে ভাবতেই রূপার বুকে একটা গুমরানো ঢেউ পাক খেতে লাগল।
বিয়ের পরই গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিল ওরা। তারপর অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে বারো বছর এই টিনের ছাওয়া ছোট্ট ঘরটাতে সুখে-দুঃখে কেটে গিয়েছে। কাজ হারিয়ে এই সংসার ছেড়ে আবার ঘরে ফিরতে হবে। গলার কাছে ব্যথাটা দলা পাকিয়ে উঠছে রূপার।
জিনিস-পত্রের বস্তাটা কোলে নিয়ে বাড়ির চৌকাঠে পা রাখতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল রূপার। জলভরা চোখে পিছন পানে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সাথে বেরিয়ে এলো - 'আর দেখা হবে সবার সাথে?'
রূপা আগেই এসে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বাপি ঘরে তালা লাগিয়ে ছেলেকে নিয়ে পরে এলো। বাপিকে দেখেই রূপার বুকটা কেঁপে উঠল-
"সাইকেল! সাইকেল কুথায় পেলে!"
বাপি রূপার মুখটা চেপে দিয়ে বলল - "অন্ধকার থাকতেই শহর ছাড়তে হবে। বস্তাটা কোলে লিয়ে পেছনে বসে পড়।"
বাপি ছেলেকে সামনে ও স্ত্রী-কে পেছনে বসিয়ে জোরে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে লাগলো।
সকাল বেলা বাপির বাড়িওয়ালা সমর ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বাইরের দরজা খুলতে এসে অবাক হয়ে গেল। বাড়ির মেন গেটে তালা লাগানো, অথচ বারান্দার গ্রিলের তালা খোলা। ভালো করে তাকিয়ে দেখল- সমস্ত জিনিস-পত্র ঠিক-ঠাক আছে, শুধু সাইকেলটা নেই। সাইকেলের কাছে আঁকা-বাঁকা অক্ষরে লেখা একটা চিরকূট পড়ে রয়েছে। সমর হাতে তুলে নিয়ে দেখল লেখা আছে - "বাবু আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি না বলেই আপনার সাইকেলটা লিয়ে যাচ্ছি। সাইকেল নাহলে - আপনার কষ্ট হবে, কিন্তু আমি আমি আমার খঁড়া ছেলেটিকে বাঁচাতে পারবনি। আবার আপনার সঙ্গে দেখা হলে সাইকেলের দাম দিবার চেষ্টা করব।"
সমরবাবুর দু-চোখ জলে ভরে গেল বুকটা মোচড় দিয়ে বেরিয়ে এলো কয়েকটা শব্দ -" তোমাদের কল্যাণ হোক। "