তুলির টানে স্বাদ–হীন সময় ।। অঙ্কন মাইতি

swadhinota
" প্রভু, আপনি সর্বজ্ঞপণ্ডিত, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা।  জগৎটাকে পরিবর্তন করে সব কালিমা দূর করে দিন। আমিও আমার ছবি মুছে দেব।"
মাইকেলেঞ্জেলোর এই স্বাধীনতার আর্তি হয়তো পথ দেখালো আগামী দিনের শিল্পীদের। আধুনিক চিত্রকলার স্বাধীন ভাবনার যুগ শুরু হলো ১৮১৯ সালে জাত,  ফরাসি শিল্পী গুস্তাভে কুর্বের হাত ধরে। পূর্ববর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের রোমান্টিকতা প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি, অস্বীকার করলেন ধর্ম বা চার্চের শাসনকে। সমকাল তাঁকে ধিক্কার জানালেও,  তাঁর এই স্বাধীন চেতনা পরবর্তী শিল্পী ও শিল্পভাবনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
স্পেনের এক ছোট্ট শহরতলি গোয়ার্নিকা। গৃহযুদ্ধ বিদ্ধস্ত সেই ধ্বংসের ছবি এঁকে চলেছেন এক শিল্পী। যথারীতি সেনাশিবিরে খবর পৌঁছালো। শুরু হল সন্দেহ, সন্ধান। একদিন শিল্পীর ছোট্ট স্টুডিওতে সার্জেন্টের লাথি পড়লো ।
ভেতরে শিল্পী ছবিতে মগ্ন। সার্জেন্ট এগিয়ে গিয়ে 
শিল্পীর কাঁধে হাত রেখে চিৎকার করে বললেন, এটা কি আপনার কাজ ? শিল্পী তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে নিয়ে মাথা উঁচু করে বললেন, না ! এটা তো 
আপনাদের কাজ। 
ছবির নাম " গোয়ার্নিকা ", শিল্পী পাবলো পিকাসো। ধূসর আর সাদাকালোয় রঙিন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিবাদে ছবি।
একজন শিল্পী বা সৃষ্টিশীল মানুষ কোনো পরিস্থিতিরই দাসত্ব করবে না ! পরিস্থিতির মধ্যে তাঁর সৃষ্টি আবদ্ধ থাকবে কেন ? বরং শক্তিশালী শিল্পীর তুলির বলিষ্ঠ আঁচড়ে পাল্টে যাবে অসামাজিকতা ও বিচ্যুত পরিস্থিতিই ! সুস্থ সৃজনশীলতাই হবে জীবনের নতুন নতুন দিশার পথপ্রদর্শক।
সমাজে বা রাষ্ট্রের বিচ্যুতি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাহস বা প্রতিরোধের অজস্র উদাহরণ আছে। বিশ্বজুড়ে নৃশংস স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে কুখ্যাত হিটলারের বিরুদ্ধে বোধহয় সর্বপ্রথম গর্জে উঠেছিল বিশ্বের শিল্পীমহল।  সুররিয়্যালিজম শিল্পী সালভাদোর দালি হিটলারের ছবি আঁকলেন একজন মহিলা 
অবয়বে যা একরকমের জোরালো প্রতিবাদ। আর আঁকলেন " দ্যা ইনিগমা অব হিটলার " নামে 
আরও একটি ছবি যা নিয়ে তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় ।
হিটলার তার মতাদর্শের বিরুদ্ধে আঁকা ছবিগুলিকে বাজেয়াপ্ত করেন এবং নামকরণ করেন " বাজেয়াপ্ত শিল্প " । নিষিদ্ধ হলো কুড়ি হাজার চিত্রকর্ম প্রায় শতাধিক আর্ট গ্যালারি ও অসংখ্য ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা থেকে,  কমপক্ষে 
চারশো জন শিল্পী চিহ্নিত হলেন। উল্লেখযোগ্য নামগুলি হলো পাবলো পিকাসো, মার্ক শাগাল , অঁরি মাতিস, অটো ডিক্স, এমিল নলডে, ফ্রাঞ্জ মার্ক সহ বিখ্যাত শিল্পী এবং অবশ্যই সালভাদোর দালি,  যাঁরা হিটলারের অন্ধকার সময়কে চিত্রিত করেছিলেন সোচ্চারে।
রাজনৈতিক পাশাখেলার ছকে ধর্মমতের গোঁড়ামির চাষ করা আর স্পিরিচুয়ালিটি এক নয় ! ধর্মের নামে গণহত্যা চান নি শিল্পীরা। ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার পরবর্তী সময় একত্র হয়ে ছবি এঁকেছিলেন কলকাতার চিত্রকরেরা। সেইসব ছবি পরে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে প্রদর্শিত এবং নিলাম হয়। 
শিল্পের সাথে শিল্পীর সম্পর্ক কেমন হবে, এই প্রশ্ন চিরকালের।  শিল্পীর শিল্পকর্ম কি শাসকসমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে নাকি শিল্পকলা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে সুন্দরের প্রকাশ ঘটাবে ? শিল্পী যেহেতু এই সমাজেরই অঙ্গ তাই সমকালীন সমাজচিত্রের প্রভাব তার কাজে পড়তে বাধ্য। বিশেষ করে এই ভুবনগ্রামের ভাবনায়, সমকালীন সামাজিক অবস্থা ও তার পরিবেশ শিল্পের রূপ ও প্রকাশকে হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে। দেশাচার, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষা-দীক্ষা, রুচিবোধ এসব প্রভাব শিল্পকলার উপর পড়তে পারে, এর সাথে যুক্ত হতে পারে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদ।
প্রতিবাদ বা স্বাধীনতার কথা হলো। এবার স্বাদ হীনতার ছবি এঁকে ফেলা যাক। এই ভারতের বুকে ঘটে চলা ঘটনার রেখাচিত্র এগুলো ।
মকবুল ফিদা হুসেনের " নগ্ন সরস্বতী " নিয়ে উত্তাল দেশ। হুসেন স্কেচটি এঁকেছিলেন ১৯৭৬ সালে। কুড়ি বছর পর ১৯৯৬ সালে অশ্লীলতার দায়ে ও হিন্দু ধর্মের প্রতি আঘাত, এই অভিযোগে তিনি আক্রান্ত হলেন। প্রসঙ্গত ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর, ধর্মের নামে কেন এবং কাদের উন্মত্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমরা সবাই জানি । 
অথচ একজন সংখ্যালঘু হিসেবে ১৯৮২ সালের 
দিল্লি এশিয়াডের উদ্বোধনে, রবিশঙ্করের মূর্ছনা আর অমিতাভ বচ্চনের উদাত্ত কন্ঠের সাথে অতিথিদের স্বাগত জানাতে হুসেন সাদা ক্যানভাসে দ্রুত এঁকে চলেছেন গন্ধমাদন পর্বত 
হাতে পবনপুত্র হনুমানকে। অথচ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে,  অশ্লীলতার দায় মাথায় নিয়ে হুসেনকে দেশ ছেড়ে নির্বাসনে চলে যেতে হয়েছিল এবং জীবনের শেষ মূহুর্তেও তিনি স্বদেশের মাটি ছুঁতে পারেন নি অথচ তাঁর চিত্রধর্মে মাদার ইন্ডিয়া, রামায়ণ, মহাভারত, গণেশের চিত্রকল্প সহ দেশজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল।
প্রসঙ্গত, 
যেমন স্পেনের জনপদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া জীবন্ত হয়ে উঠেছিল পাবলো পিকাসোর হাতের ছোঁয়ায়। তেমনি অনেক ‘গোয়ার্নিকা’ ভারতীয় শিল্পীদের তুলি-পেনসিলেও মূর্ত হয়ে উঠেছিল। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন এম এফ হুসেন, কৃষন খান্না, রাম কুমার ও তায়েব মেহতা। তাঁরা প্রত্যেকেই ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধশেষে গিয়েছিলেন সীমান্তে, সেই ধ্বংসের ছবিই তাঁরা একেছিলেন নিজেদের ঢঙে। সাথে ছিলেন তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি জাকির হোসেন।
অমৃতসর পেরোতেই যুদ্ধের চিহ্ন সর্বত্র। কোথাও পাকিস্তানের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক,  কোথাও পড়ে রয়েছে শেষ-না-হওয়া চিঠি, এ দিক-সে দিক ছড়িয়ে থাকা যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ। তারই মধ্যে দেখা মিলেছিল সাঁজোয়া গাড়িতে চেপ্টে যাওয়া এক সেনার দেহ, যা টের পাওয়া গিয়েছিল পচা গন্ধ থেকে। 
এ সবই তাঁদের ছোঁয়ায় ভাষা পেয়েছিল। তিন শিল্পী সহ হুসেনের কিছু ছবি পরবর্তীতে নিলামও হয়েছিল যা নিহত সৈনিকদের বিধবাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন মানেই স্বল্প রেখায় ধরে রাখা সমসাময়িক সমাজ বা গুরুত্বপূর্ণ মুখ। এর তীব্র স্যাটায়ার আমাদের জাগিয়ে তোলে, ভাবায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কার্টুন এঁকে অসিষ্ণুতার শিকার আসামের প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট নিতুপর্না রাজবংশী ঠিক এক বছর আগে এই পনেরো আগস্টে।
ঐ ব্যঙ্গচিত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এক কর্পোরেট মাস্ক পরা অবস্থায় ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা তুলতে দেখা যাচ্ছে। যে কাপড় দিয়ে মোদীর মাথার পাগড়ি সেই কাপড় আসছে এক অসহায় নারীর শরীর থেকে।
এই কার্টুন প্রকাশের পরই নিজের ফেসবুক পেজে মৃত্যুর হুমকি পান নিতুপর্না। এই ঘটনার প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই সোচ্চার হয়ে উঠেছিল শিল্পী মহল।
শিল্পীর নিজের ভাষায়, কার্টুন সাধারণ মানুষের মুখপত্র। এই ঘটনার পর নিতুপর্না প্রশ্ন তুলেছেন, দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক আদর্শ বা অন্য যে কোনো কারণে অনেকেই আমার আঁকা কার্টুনের সমালোচনা করে। অনেকেই গালাগালি দেয়। আমার কাছে সবকিছুই গ্রহণীয়। কিন্তু আমার কার্টুন দেখে হত্যা করার হুমকি দেখে আমি স্তম্ভিত।
কোলকাতার বড়বাজারের ভেঙে পড়া পোস্তাব্রীজ নিয়ে একাডেমির সামনে হাজির প্রখ্যাত শিল্পী সনাতন দিন্ডা। প্রকাশ মাধ্যম হল ভিডিও। নাম, ভার্চুয়াল ইলাষ্ট্রেশন আর্ট। ভেঙে পড়া ব্রীজের সাথে মানুষের ভয়াবহ মৃত্যু, রক্ত আর অসহায় চিৎকার, একটুর জন্য বেঁচে যাওয়া মানুষের স্তম্ভিত আর নির্বাক অপলক দৃষ্টি,  শিল্পী জনসমক্ষে তুলে ধরতেই শাসকের ক্ষমতা প্রয়োগ শুরু। বানচাল হয় এই প্রদর্শনী । এই ট্র্যাডিশন সমানে ও স্বগর্বে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে। আমরাই অধিকাংশ এর পৃষ্ঠপোষক। প্রতিবাদীরা ক্রমশ সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে।
কোভিড ১৯ -- এর একটি অন্যতম লক্ষণ স্বাদ হীনতা যা আজ এই আচ্ছন্ন সময়ে আমাদের দুশ্চিন্তায় রাখে। কিন্তু মনে রাখতে হবে স্বাদ - হীন হয়ে, মৃতপ্রায় হয়ে থাকার অভ্যেস আমরা যুগ যুগ ধরে রপ্ত করে চলেছি যা এখন চূড়ান্ত সীমা ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে । 
 
সবাইকে স্বাদ - হীনতার অগ্রিম শুভেচ্ছা ।

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...