স্বাধীন লেখা এবং স্বাদহীন লেখা ।। বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
swadhinota
স্বাধীন লেখা এবং স্বাদহীন লেখা। এরকম দুটি শিবির আমরা কল্পনা করতে পারি অনায়াসে । কল্পনা নয়, বাস্তবেও আমরা দেখি একধরণের লেখার অক্ষরে কোথাও বন্দিত্বের দাগ নেই। ঋজু টানটান শিরদাঁড়া। শব্দের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে অপরিসীম তেজ। আবার কিছু লেখা থাকে যা কারো নির্দেশে মশলা দিয়ে বানানো হলেও শেষ পর্যন্ত একটি স্বাদহীন লেখায় পর্যবসিত হয়। এই লেখার উদ্দেশ্য এবং অভিমুখ একজন লেখকের স্বাধীন সত্তাকে প্রকাশ করে না। মনে হয় মূল্যবোধের স্বার্থে নয় শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্যই সে ক্ষমতার পক্ষে অবস্থান নেয়। শুধুমাত্র লেখার জন্যই যেন লেখা হয়েছে এই রচনা। ফলে লেখাটিকে জীবন্ত বলে মনে হয় না। সমস্ত মশলা দিয়ে সুস্বাদু বানানোর চেষ্টা করা হলেও। অতিরিক্ত তেল প্রয়োগে অথবা যথার্থ চিন্তার অভাবে   স্বাদহীন রচনায় পরিণত হয়। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা হিসেবে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা ছাড়া লেখাটির আর কোন ঠিকানা থাকে না। 
অথচ একজন লেখক যখন লিখতে শুরু করে তার সেই প্রাথমিকপর্বের দিনগুলিতে সূচনাবিন্দুতে দাঁড়িয়ে  সে  অন্তরের সত্যগুলিকেই লিখবার চেষ্টা করে। তার চারপাশে যখন যেখানেই কোন অন্যায় দেখে, অত্যাচার দেখে অশোভন উদ্যম দেখে তার মনের ভেতর অনুভূতিপ্রবণ একটা মন তাকে ধাক্কা দেয়। সে অস্ত্র ধরতে পারে না। সে পৃথিবীতে থেকে সিনেমার নায়কের মতো সমস্ত অপরাধকে মুছে দিতে পারে না। সে বোমা বারুদ আর বন্দুক দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে না সমস্ত বিভেদ আর বৈষম্যের দেওয়াল। পারে না বলেই চুপিসারে লেখার টেবিল তাকে ডেকে নেয়। সে একা একা ভাবে সমাজ যতই অসৎ হয়ে যাক, যতই বাসের অযোগ্য হয়ে যাক, ‘প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ  শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি”  সে এসব ভাবে কারণ   সে তার লেখার টেবিলের কাছে সৎ থাকবে চিরকাল।  এ তার অন্তরের বিশ্বাস । কোথাও কোন আপস  করবে না। 
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যে তরুণ কবি লিখতে এসেছে  সেও ভাবে এ কথা। একজন প্রকৃত  লেখক হয়ে উঠবে সে,  যে  লেখকের গলায় কোন শেকল থাকে না। কোন প্রতিষ্ঠানের শেকল, দলীয় আনুগত্যের শেকল বা মতাদর্শের দাসত্ব দিয়ে বেধে রাখা যায় না প্রকৃত শিল্পীকে লেখককে। তার ভাবনার জায়গা উন্মুক্ত আকাশের মতো সীমানাহীন। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তাকে বেঁধে রাখবার ক্ষমতা নেই কারও । সত্যিই কি নেই ? তাহলে  বিবেক বিক্রিত হয় কীভাবে ? কীভাবে ক্ষমতার কাছে প্রতাপের কাছে মোহের কাছে সমর্পিত হয় শিল্পীসত্তা ? এ ঘটনা এখন আকছার ঘটছে। তা হলে কি স্বাধীন লেখা বলে কিছু নেই? আজ যখন সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতের ক্রমিক রূপান্তর  এবং বিবিধ সাংস্কৃতিক কাঠামোর ধারাবাহিক বিকাশ আধুনিকতার সামনে বিপর্যয় ডেকে আনছে। মানবতাবাদী পরম্পরা এবং প্রগতিশীল বৈপ্লবিক ভাবনাগুলি নিস্তেজমান হয়ে যাচ্ছে সময়ের আগ্রাসনে। আধুনিক যৌক্তিকতা শিল্পপ্রযুক্তি এবং আমলাতান্ত্রিক বিকাশ যখন মানবমুক্তির পথ প্রসারিত করার বদলে অনেকানেক ক্ষেত্রে রুদ্ধ করছে। যুক্তি ও মুক্তির  সেই স্বাধীন লেখক  তাদের চিন্তার ভেতর ক্রমেই নেমে আসছে আঘাত এবং মুক্তভাবনার যে পরিসর তা ক্রমশই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা  প্রত্যেক মানুষের স্বাধীন সত্তার অধিকারে বিশ্বাসী। মানুষের প্রথম রাজনৈতিক দাবিই ছিল ব্যক্তির স্বাধীনতা তার মত প্রকাশের অধিকার। ধনী দরিদ্র ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে  সমতা ও সুবিচার অর্জন। নিষ্পেষক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতর অক্সিজেন নেওয়ার মতো গণতান্ত্রিক  বাতাবরণ না থাকলে জনগণের কথা বলবার অধিকার সুনিশ্চিত না হলে আমরা কি প্রকৃত স্বাধীন লেখার কথা ভাবতে পারি ? অথচ আমরা প্রতিনিয়ত যে কথাগুলো নির্বিচারে উচ্চারণ করে যাই তা হল জণগণই ক্ষমতা ও শক্তির মূল উৎস । জনগণই দেশের নীতি নির্ধারণ  করে। সামাজিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়ে তারাই শেষ কথা বলে । 
যেকোন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল দর্শনই হচ্ছে মানবতাকেন্দ্রিক , মুক্তি এবং  মানবিক অধিকার অর্জন। সমতা এবং ভাতৃত্বের ভিত্তির উপর যা সংস্থাপিত। কিন্তু আজ এতগুলো বছর পরেও সেই দর্শনের সার্থক রূপায়ন সম্ভব হয়নি। বৃহৎ পুঁজির আগ্রাসন যেমন শ্রমিক শ্রেণির ন্যুনতম চাহিদা পূরণ হতে দেয়নি পাশাপাশি নারীর উপর নেমে এসেছে পুরুষতান্ত্রিক পীড়ণ , আদিবাসী এবং প্রান্তিক মানুষের উপর কেন্দ্রীয় সুবিধাভোগী মানুষের বর্ণবৈষম্য আরও প্রগাঢ় হয়েছে। দুনিয়া জুড়ে দুঃখ দারিদ্র‌্য ক্ষুধা বেকারত্ব এবং হিংসার পরিবেশ একজন লেখকের প্রতিবাদী সত্তার জাগরণকে সুনিশ্চিত করে। জন্ম দেয় মুক্ত কন্ঠস্বরের। এভাবেই জন্ম হয় স্বাধীন লেখার। এই স্বাধীন লেখাকেই ভয় পায় শাসক শ্রেণি। কারণ স্বাধীন লেখাগুলি মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। ফুকো স্পষ্টতই বলেছিলেন – “ ইতিহাসের স্তব্ধ এবং অবদমিত লড়াই ও তার প্রতিবাদী স্বরগুলিকে  ক্ষমতাশীল মৌলসংস্কৃতির শক্ত মুঠো থেকে  মুক্তি দিয়ে আধিপত্যের বিরুদ্ধে সুসংহত করতে হবে ।” তাহলেই স্বাধীন লেখা সম্ভব।
সেই রাজতন্ত্রের যুগে আমরা কী দেখেছি? আমরা দেখেছি সভাকবিদের। যাঁরা অলংকৃত করতেন রাজদরবার। গুণকীর্তন করতেন প্রতিষ্ঠানের। এই ভজনার ভেতর দিয়ে যে লেখা প্রসূত হয় তা ক্ষমতার কাছে সুস্বাদু লেখা হিসেবে পরিগনিত হলেও সময়ের বিচারে তা স্বাদহীন লেখা। প্রকৃত মুক্ত এবং স্বাধীন লেখক যার কন্ঠস্বর ক্ষমতার কাছে প্রতাপের কাছে বন্ধক থাকে না তা দায়বদ্ধ সময়ের কাছে এবং অবশ্যই মানুষের কাছে। 
আজকের সময়ে আমরা কতটুকু এগিয়ে এসেছি।  চারদিকে যখন সার্বিক অন্ধতা এবং বিচারবিমুঢ়তা যার ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা অন্ধ  নিঃসাড়তা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারছি না। সেই প্রেক্ষিতের ভেতর সংখ্যালঘু হলেও স্বাধীন লেখার জন্ম হচ্ছে। যে লেখাগুলির গায়ে রুদ্ধতার কোন চিহ্ন নেই।  জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বহুস্বরিক উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে  সত্তা ও অপরতার সেতু।  নিজেদের চারপাশে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ তৈরি করে তাকেই ভূবনগ্রাম তকমা দিয়ে এক মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে যারা । তাদের এই বিশ্ববিজয়  বালখিল্যের উল্লাস  ছাড়া আর কিছুই নয়। কৃত্রিম মানচিত্রের অন্দরমহলে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে আরও অনেক সংকীর্ণ অণু মানচিত্রের সীমান্ত। স্বাধীন লেখকের  প্রথম এবং প্রাথমিক শর্তই ছিল  বিভাজনের এই অন্ধ সীমান্তবিন্দুগুলিকে  মুছে দিয়ে সত্যিকারের মানবমুখী সাহিত্যের  এক অমল বাতাবরণ সূচিত করা। এই অনন্যতাই তাদের  চিন্তা ও চেতনাকে মৌলিক দীপ্তি দিয়েছে। একটু কাব্যিক উচ্চারণে বললে যা দাঁড়ায় তা হল এই মুক্ত চিন্তার  প্রতিটি তাৎপর্যই আসলে প্রকল্প তাকে কেউ কখনও চুড়ান্ততায় অবরুদ্ধ করতে পারে না। কোন ক্রিয়ারই শেষ কথা নেই। আয়ুষ্কাল থাকা স্বত্তেও অবসান নেই কোন মানবিক ভূমিকারই। তাই ব্যক্তি নয় সমবায়িক চলাচলের  ভেতর দিয়েই সমস্ত উচ্চারণের জন্ম হয়। উৎসব যেমন কোন নির্দিষ্ট সত্তার নয়। সত্তার চেয়ে সমষ্টির অংশগ্রহণই হয়ে উঠে তার প্রাণবিন্দু। লেখাও সেরকমই দায়িত্বের উৎসব।  যে লিখছে সেই শুধু নয়, তার ভাবনার সাথে জুড়ে আছে এরকম সমস্ত মানুষের মিলন উৎসব। জীবন অর্জিত অভিজ্ঞতার  ক্রমপ্রবাহের ভেতর দিয়েই অন্তর্ভেদী আলো নিক্ষেপ করে। শিল্প বা সাহিত্যের প্রতিটি প্রশাখাই মূলত সৃষ্টির সমাজতত্ব। সংযোগ ছাড়া বাচকের চেতনা অথবা অবচেতনার রূপান্তর সম্ভব নয়। তাই একজন স্বাধীন লেখক সমাজের স্তম্ভ হয়ে ওঠে। আর স্বাদহীন গন্ধহীন নির্জীব লেখাগুলি হারিয়ে যায় অন্ধকারে। 
 একজন লেখকের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াও সামাজিক শক্তির সজীব মিথস্ক্রিয়ার সার্বিক প্রকাশ এবং বিভিন্ন উপলব্ধির স্পন্দিত অভিব্যক্তি- Every Word is directed toward an answer and cann’t escape  the profound influence of the answering word that is anticipates.
সারা পৃথিবীতে যুগে যুগে মুক্তচিন্তার উপর নেমে এসেছে আঘাত। বারবার রুদ্ধ করা হয়েছে স্বাধীন কন্ঠস্বর। পিনোচেত স্বৈরতন্ত্রী বিশ্ববন্দিত পাবলো নেরুদার রক্তে দু হাত রঞ্জিত করেও  প্রতিহত করতে পারেনি কবিতার উদার অভ্যুত্থান। শুধু চিলি নয়, সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে সেই আগুন। একদিন লোরকার রক্ত লাল হয়েছিল স্পেনের মাটি। বজ্রলাল অধিকারী  সফদার হাসমী থেকে ভারভারা রাও  বারবার স্বাধীন লেখাকে রুদ্ধ করবার চেষ্টা হয়েছে এদেশে। বাংলাদেশে একাধিক ব্লগার এবং স্বাধীন কন্ঠস্বরের লেখক সন্ত্রাসবাদীদের হাতে খুন হয়েছে। তবু কি রুদ্ধ করা গেছে মুক্ত ভাবনাকে প্রকৃত স্বাধীন লেখাকে। কোন লোভ দিয়ে প্রলোভন দিয়ে হুমকি দিয়ে অথবা ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে রুদ্ধ করা যায় না একজন স্বাধীন লেখকের কন্ঠস্বর।

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...