মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে এরকম স্থবির একটা সময়ের ভেতর আছি।
দিন মাস সব গুলিয়ে গেছে, ঝিমিয়ে কাটছে সময়। রোজ ভাবি, আজ যেন কী বার! কত তারিখ! কিছুতেই মনে আসে না সহজে। তার মধ্যে এই একটা সপ্তাহ যেন একদম অন্যরকম। সেই কোন কাল থেকে শুরু হওয়া বিশেষ এই সময়টা সব অবস্থাতেই কী করে যে একই রকম সুরে বাঁধা হয়ে আসে কে জানে! উদবেগের মধ্যেও কেমন প্রসন্ন আর শান্ত হয় মন, যখনই তাঁকে ভাবি। এ জীবনে আর কাউকেই পেলাম না এমন করে আঁকড়ে ধরার।
কদিন ধরে কানের কাছে ' কার যেন এই মনের বেদন' ...গুনগুন করে যাচ্ছে কেউ! কার বেদন আর হবে ! আমারই ,আমাদেরই! দিনগুলো সব এখন এই বেদন দিয়ে মাখামাখি। তারপরও ওই বিষণ্ণ লাইনগুলোই কেমন ম্যাজিকের মতো কাজ করে ভেতরে, চোখে জল আসে, ক্যাথারসিস হয়। যত দিন যায়, ততই বেশি করে বুঝি, মোটের ওপর কোন অবস্থাতেই তাঁকে ছাড়া চলবে না আমার , সমস্ত অনুভূতির পরতে পরতে শুধু তিনি তিনি তিনি।
এ বছরটা আমাদের আজন্ম দেখে আসা দিনগুলো থেকে ভয়ংকর রকমের আলাদা, মহাসংকট কাল। এবার কোভিড সাহেব তাণ্ডব নৃত্যে মেতেছেন। ... তোমার বিশ্ব নাচের দোলায়, বাঁধন পরায় বাঁধন খোলায়... পুরো বিশ্বটাকে কেউ যেন প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে কঠিন বাঁধনে বেঁধে রেখেছে । এ বজ্রমুষ্টি থেকে কবে মুক্তি মিলবে কে জানে! এর মধ্যেও এক একটা দিন ফুরোয়, আরো বেশি করে আশ্রয় খুঁজি তাঁর কাছে।
সুরে স্বরে যেভাবেই শুনি না কেন ...সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে শোন শোন পিতা, কহো কানে কানে শোনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা।.... বেশ শক্তি আসে মনে, থমথমে পরিবেশে শুভ কিছু ছড়িয়ে যায়। বিশ্বাস হয়, মঙ্গগলবারতা আসবে, আসবেই।
তাঁর যে কোন গানের অনুষঙ্গেই দেখি টুকটুক করে এক একটা স্মৃতির পর্দা খুলে যায়। যাঁরা আছেন, যাঁরা ছিলেন, সব মনে পড়ে। এই মনে পড়ানোর আর এক নাম পঁচিশে বৈশাখ ।
পঁচিশে বৈশাখ তাই শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়, প্রতিবার নতুন করে এই দিনটাতে আমারও জন্ম হয় যেন। সারা বছর তিনি যতই আমাদের যাপনে জড়িয়ে থাকুন, এই দিনটা কিন্তু বিশেষ রকমে বিশেষ, আমার কাছে। ও যতই পুজার ছলে তাঁকে ভুলে থাকার কথা বলা হোক, যতই দিনটাকে ঘিরে হুজুগের কথা বলা হোক, পঁচিশে বৈশাখ নিয়ে আমার কিন্তু বাপু বেশ একটু 'আদিখ্যেতা' আছে। তাঁর আসা তো আসা নয়, আবির্ভাব। দিনটাকে একটু বাড়তি আদর যত্ন করতে হবে না!
সব শুরুরও আগে যে একটা শুরু থাকে, আমার সেই শুরুর দিনগুলি এসময় ভোর ভোর হাজির হয়ে যায় গীতার পিসিকে সঙ্গে নিয়ে। আমাদের গৃহসহায়িকা সেই বালবিধবা পিসি, যে তার ভাইঝির নামেই বেঁচে রইল মৃত্যুর পরও , সামান্য সেই মানুষটাও উঠে আসে দিনটার হাত ধরে।
প্রতি পঁচিশে বৈশাখের সকালে আমাদের চাতালে মায়েদের শাড়ি দিয়ে সাজানো, ক্যালেন্ডার থেকে কাটা কিছুটা রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে ছবিটি ঘিরে ভুলভাল উচ্চারণে, খুঁতো সুরে আবৃত্তি, গান আর নাচের জমজমাট হইচই শেষ হলে মায়ের এক ঝুড়ি লুচি বেলায় সাহায্য করতে করতে পিসি গজগজ করত, ' গড় করি মা তোমাদের ফানশানকে! আর কারো যেন জম্মোদিন হয় নি সোমসারে, বউদিদি আর আমি খেটে খেটে মরে গেলুম গো। '
রাগের কারণ ছিল পিসির, ওই অতগুলি বাচ্চার জন্যে অনেক লুচিই বেলতে হত তাকে। কিন্তু দিনটা যে খুব স্পেশাল, সে বোধের হাতেখড়ি তো ওই বয়স থেকেই, ফলে পিসির ওই ' ফানশান' দিন দিন আরো একটু পরিণত হয়ে সারাজীবনের জন্যে সঙ্গে রয়ে গেল।
তাই পঁচিশে বৈশাখ এলে পিসির সেই হুতাশ আমার মনে পড়বেই৷ আর রবীন্দ্রনাথের মতো খানিকটা দেখতে সেই ক্যালেন্ডারের ছবিটার কথাও, যাঁর মুখে আমি স্পষ্ট দেখেছি মিটিমিটি হাসি, রসিক কবি নিশ্চয়ই আমাদের বালখিল্যপনাতেও বেশ মজা পেতেন।
একসময় সব সৃষ্টি ছাপিয়ে আমাকে জড়িয়ে রইল তাঁর গান। গ্রীষ্ম বর্ষা শরত হেমন্ত শীত বসন্ত... আহ, সব ঋতু ভরে ওই একজনই, মরণ হতে জাগিয়ে তোলার জন্যে। জানি, এ জীবনে যত বিচ্ছেদ এসেছে, আরো যত আসবে , সব সয়ে নিতে আমার ধ্রুবতারার সঙ্গে এই নিবিড় যোগাযোগ আর ফুরোবে না৷ আর আমারে বাইরে তোমার কোথাও যেন না যায় দেখা...।
সময়ের নিয়মে দিনগুলো তো আর এক থাকে না। পরিবর্তনের হাওয়ায় হাওয়ায় এক একসময় এক এক রূপ হয়েছে তার। শ্বশুরবাড়িতে আসার সময় বাবা মার বিয়েতে পাওয়া সঞ্চয়িতা আর এক খণ্ড গীতবিতান নিয়ে এসেছিলাম, আমার চিরদিনের একমাত্র সঙ্গী৷ সেই ভিন্ন পরিবেশে আর এক পঁচিশে এল, আমার আর্জি মঞ্জুর করে শ্বশুরবাড়িতে প্রথম শুরু হল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। শুধু আমার স্নেহময় শ্বশুরমশাই হেসে হেসে বলেছিলেন, আরে আমরা তো এতদিন জানতাম এসব স্কুলে কলেজেই পালন করে। বাড়িতে করতে তোমরা? তা বেশ, করো না!
কী এমন করতাম! ছেলেবেলার ধুলোখেলা সাঙ্গ হলে প্রিয় দিনটি নিয়ে বিশেষ কী আর করে মানুষ! শুধু দিন পরে যায় দিন, উচ্ছ্বাস কমে, আরো আরো শান্ত গভীরে প্রবেশ করেন তিনি। তখন তত্ব তথ্যের গুরুভার কিছু নয়, কোন ভারি কথা নয়, শুধু অনুভব আর ভালবাসা, প্রিয় কিছু গান, আর শুধু সমর্পণ... সুধা তোমাকে ভোলে নি!
এমনি করে এখনও এই দিনটার ভেতর কত প্রিয় মানুষ হারিয়ে গিয়েও এসে দাঁড়ান। মনে হয়, এই পঁচিশেও প্রিয় কবি অধ্যাপক অনুত্তম বিশ্বাস ঠিক তাঁর উদাত্ত খোলা গলায় গেয়ে উঠবেন , এ পরবাসে রবে কে! যে গান শুনে আমার ঘরের লাল মেঝের ওপর সাদা আল্পনায় বসা জন্মদিনের স্বল্প সাজের কবি আলো আলো হয়ে উঠতেন। তাঁর এপারের পরবাস পর্ব শেষ হয়ে গেছে অল্পদিন আগেই , কিন্তু আর এক পরবাসেও তো অপেক্ষা আছে কতজনের। কে আর যায় কোথায় ! এঘর, ওঘর বই তো নয়!
তারপর যা হয়, একদিন বাইরের এটুকু হইচইও থেমে গেল। শাশুড়িমা নেই, ছেলে চলে গেল বাইরে, বাড়ি শূন্য। আবার আমি একা, মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ। আর সারাদিন শুধু ঘুরে ঘুরে বিক্রম সিং খাংগুরার কণ্ঠের মগ্ন নিবেদন, কবির প্রসন্ন মুখ৷
আর এবার তো আমি সবকিছু থেকে, সমস্ত দিক থেকেই অনেক দূরে, ...নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা।