corona canvas

এক স্বপ্নদর্শী শিক্ষক ।। শ্রীজিৎ জানা

 

 apj abdulkalam
তপোবনকেন্দ্রিক ভারতবর্ষীয় জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যধারায় তরুচ্ছায়াতলে আচার্য - শিষ্য সুমধুর পরম্পরায় শিক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন হত। 'গু' তথা অন্ধকার থেকে ' রু' তথা আলোর দিশা দেখাতেন গুরু। দুচোখের পাতায় এঁকে দিতেন জ্ঞানাঞ্জন। শিষ্যের নিকট  তখন গুরু পিতা, গুরু মাতা, গুরু দেব ভবঃ। আর শিষ্যের -"তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া"-র মাধ্যমে অনুগত চিত্তে বিদ্যাগ্রহণ। কালচক্রে এমন মহান ঐতিহ্যবাহী, সশ্রদ্ধ, মধুর সম্পর্কের গায়ে দাগ লাগছে। দূরদর্শনের ব্রেকিং নিউজ, ছাপা দৈনিক, বাজার,  চা দোকান, অভিভাবক তর্জনী  উঁচিয়ে শাসিয়ে বলছেন- "  আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি মাস্টারমশাই"। সেবা আর পেশার ফারাক বুঝতে অক্ষম একাংশের দোষে কালিমালিপ্ত শিক্ষককুল। তথাপি বুনো রামনাথ, রাধাকৃষ্ণাণ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ শিক্ষককুলের প্রণম্যজনরূপে স্মরণীয় হয়ে থাকেন। এহেন গৌরবময় সরণীতে কত নামের মাঝে উজ্জ্বলতম আর এক নক্ষত্র, এক বিস্ময় উড়ান -ফিনিক্স পাখির মতো আগুন ডিঙিয়ে, দৃঢ় পাখায় ঝাপটা মেরে সুউচ্চ শিখরে উড়ালো তাঁর চিন্তাশীল ব্যক্তিসত্তাকে।
 করমন্ডল উপকূলের অখ্যাত গ্রাম। একদিকে মসজিদ অন্যদিকে রামেশ্বরমের শিবমন্দির। একচিলতে ঘরটায় দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। ধর্মপ্রাণ জয়নুল আবেদিন আর সহজসরল আশিয়াম্মার ছেলে কাকভোরে উঠে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয় খবরের কাগজ। সেদিন কেইবা জানত রামেশ্বরমের ওই ছেলেটাই একদিন সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন। দক্ষিণের সমুদ্রবেলা ছাড়িয়ে একদিন ৩৪০ একর জমির রাষ্ট্রপতি ভবনের ১৫ একরের মুঘল উদ্যানে নির্মাণ করবেন চিন্তনকুটির আর অমরকুটির বা ইমমরট্যাল হার্ট।
শৈশবেই বাবা নামাজ পাঠের সাথে ছেলের চোখে এঁকে দিয়েছিলেন স্বপ্ন। যে স্বপ্নকে ছেলেটা কক্ষনো চোখছাড়া করেনি। শুধু কোটি ভারতীয়র চোখে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন–ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্ন আসলে তা মিথ্যে, সেই স্বপ্ন সত্যি যা কখনো কাউকে ঘুমোতে দ্যায় না। যিনি নিজেই দিনরাত্রির চব্বিশঘণ্টার ঘুমোতেন মাত্র কয়েকঘন্টা। সেই ছেলেটা আর কেউ না পাঁচ শব্দ ও একত্রিশ বর্ণের বিস্ময়মানব আবদুল পাকির জয়নুল আবেদিন আব্দুল কালাম।
আব্দুল কালাম। মিসাইল ম্যান। মহাকাশ বিজ্ঞানী। ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানী। একাদশ রাষ্ট্রপতি। পদ্মভূষণ। পদ্মবিভূষণ। ভারতরত্ন। এসবকে ছাপিয়ে তিনি নিজের পরিচয়ে বলেন–আমি একজন শিক্ষক। তিনি রাষ্ট্রশিক্ষক। তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনের মলাটভর্তি শিক্ষণীয় বিষয়।জন্মেছেন মুসলমান পরিবারে। নিয়মিত নামাজ ও কোরান পাঠ, আবার পুরোহিত লক্ষ্মণ শাস্ত্রীর মুখ থেকে শুনছেন গীতা ও ভাগবত। সূর্য যখন পাটে বন্ধুসম জালালুদ্দিনের সাথে প্রদক্ষিণ করছেন রামেশ্বরমের শিবমন্দির। কিশোরবেলার বন্ধুরা হলেন গোঁড়া হিন্দু পরিবারের রামনাথ শাস্ত্রী, অরবিন্দন, আর শিবপ্রকাশন। বই পড়ার নেশা ধরিয়ে দেওয়া সাম্যবাদী চিন্তার মানুষ এস টি আর মনিক্কম। এমন পরিমণ্ডলে আব্দুল কালাম অনুভব করছিলেন বহুত্বের শক্তি, ভারত আত্মার মর্মবাণী সংহতি। বৈচিত্রের মাঝে একতার সুরকে তিনি জীবনভর ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশে। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন গুজরাট দাঙ্গার সময় নিরাপত্তা বিষয়ে শত আপত্তি থাকলেও ছুটে গেছেন সেখানে। ভরসা দিয়েছেন মানুষকে। আবার যখন বিমানবাহিনীর ইন্টার্ভিউতে অসফল ; মন খারাপ; নিঃসঙ্কোচে চলে গেছেন হৃষিকেশে স্বামী দেবানন্দের আশ্রমে। মুসলমান পরিচয় দিলেও স্বামীজি তাঁকে দেখালেন শান্তির পথ, সাহসের পথ, বিশ্বাসের পথ। এহেন দৃশ্যই তো শেখায় ভারতবর্ষীয় ধর্মের উদারতা, মাধুর্য ও সহিষ্ণুতার পাঠ।
আব্দুল কালামের অন্তরভরা দেশপ্রেম। তাঁর পরিবার দেশ। বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায় মন্ত্রে তিনি নিবেদিত প্রাণ। সদ্য স্বাধীন দেশ তখন শক্ত পায়ে দাঁড়াতে মরিয়া। প্রতিবেশী শত্রু ঝাঁপিয়ে পড়ছে দেশের উপর। সমরাস্ত্রে দেশ কিছুটা দুর্বল। আব্দুল কালাম ও তাঁর সহযোগী মিলে দেশের হাতে তুলে দিলেন একে একে পৃথ্বী, অগ্নি, আকাশ, ত্রিশূল, নাগ এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র। পারমানবিক সফলতায়ও তাঁর পরোক্ষ যোগদান যথেষ্ট। অনেকে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে তাঁর সমালোচনা করেছেন। কালাম বুদ্ধ এবং গান্ধীজির প্রসঙ্গ টেনে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারত অহিংসায় বিশ্বাসী। কিন্তুু স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নে সে কারো কাছে নত হবে না। তাঁর অস্ত্র ভাবনায় আগ্রাসন নেই, আছে আগ্রাসীকে রুখে দেবার দেশপ্রেম।
হতাশার সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর নাম আব্দুল কালাম। রোহিণী উপগ্রহ উৎক্ষেপণে বারবার অসফল হয়েছেন। বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হয়েছেন। থেমে থাকেননি। শান্ত ধীর ঋষির মতো ভবিষ্যতের আলোক প্রত্যক্ষ করে এগিয়েছেন। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রোহিণী  উপগ্রহের সফল উৎক্ষেপণে বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন। দেশ প্রথম দেখেছে আত্মনির্ভরতার শক্তি। শুধুমাত্র বিজ্ঞাপিত আত্মনির্ভরতা নয়।প্রয়োগে তার সাফল্য  প্রমাণ করা। তরুণ বিজ্ঞানীদের কানে শুনিয়েছেন চরৈবেতি মন্ত্র।প্রাণে সঞ্চারিত করেছেন মানবিক মূল্যবোধ। কর্মোদ্যমের প্রেরণা। বন্ধুর মতো মিশে সব সমস্যার সমাধান করেছেন। গীতা কোরান উপনিষদের শ্লোক আর কবিতার পঙক্তিতে তাদের হৃদয়ে জাগাতেন আধ্যাত্ম চেতনা, বিশ্বাস ও স্বপ্ন। 'স্বপ্ন না দেখলে কাজ করা যায় না'।তরুণ বিজ্ঞানীদের কাছে তাই আব্দুল কালাম আদর্শ শিক্ষাগুরু।
আব্দুল কালাম রূপকথার বর্ণময় চরিত্র। ভারতের ঐতিহ্য সংস্কৃতির প্রতি তাঁর তীব্র অনুরাগ। গবেষণাগারে মগ্ন মানুষটির কণ্ঠে উচ্চারিত হত খলিন জিব্রান, কীটস্, ইয়েটসের কবিতা। কবিতা তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। দুঃখে শোকে আনন্দে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। বিষাদভরা সময়ে একান্তে শুনতেন বিসমিল্লাহ্ খানের সানাই। জ্ঞান ও মননের  আশ্চর্য সমন্বয়ে গড়া ব্যতিক্রমী মানুষ কালাম। একদিকে ঋষির প্রাজ্ঞতা, দূরদর্শিতা অন্যদিকে যুক্তিবাদ আবার শিশুর সারল্য, প্রকৃতিপ্রেম, সহৃদয়তা। প্রাচীন গুরু শিষ্য পরম্পরার প্রতি শ্রদ্ধাশীল কালাম বারবার স্মৃতিচারণায় লিখেছেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক ইয়াদুরাই সলোমন, রামকৃষ্ণ আয়ার ও ফাদার সেক্যুইয়ার কথা। মাদুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণ দিতে হবে তাঁকে। ওই শহরে থাকতেন প্রিয় শিক্ষক সলোমন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে গেলেন তাঁর বাড়ি। পা ছুঁয়ে এলেন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এমন শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শিক্ষাই তো অনুকরণীয়। অহংশূন্য বিলাসবর্জিত জীবন। পরমপ্রিয় মা বাবা আর জালালুদ্দিনের মৃত্যু তাঁকে ভেঙে চুরমার করে দিলেও আবার মগ্ন হয়েছেন কর্মে। তিনি - দুঃখেষু উদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহ। কর্মজীবনে মাত্র দুদিন ছুটি নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি ভবনের দ্বার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। অনেকক্ষেত্রে প্রোটোকলকে পাত্তা দেননি। যা সত্য উগরে দিয়েছেন অকপটে। তাঁর মতে ভারতীয় সভ্যতার শিকড় প্রোথিত আছে গ্রামে। রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজীর মতো গ্রাম উন্নয়নের কথা বলেছেন বারবার। সদা কর্মচঞ্চল কালাম সদ্য রাষ্ট্রপতি হয়েই দশমাসে একুশটি রাজ্য পরিদর্শন করেন। পাঁচ বছরের মেয়াদে বারশোর বেশি কার্যক্রমে যোগদান করে পনের লক্ষ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। কর্মযোগী তাদের শুনিয়েছেন ভারতবর্ষের আশার কথা, সম্ভাবনার কথা, স্বপ্নের কথা।
স্বপ্ন ছিল অবসরের পর এমন এক বিদ্যালয় গড়বেন, যেখানে ছেলেমেয়েদের সার্বিক বিকাশ ঘটবে। স্বপ্ন সত্যি হয়নি ঠিকই কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপকরূপে নিরলস জ্ঞান বিতরণ করে গেছেন। এমনকি বিশ্বের অনেক দেশের ছাত্রমহল রাষ্ট্রপতি নয়, তাঁকে দেখতে চেয়েছেন শিক্ষকরূপে। শিক্ষকতা তাঁর সাধনা। তাঁর বিশ্বাসে – ন হি জ্ঞানেন সদৃষং পবিত্রমিহ বিদ্যতে। ছাত্রকূল তাঁর হৃদস্পন্দন। কলকাতার একটি বিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান। মঞ্চে শহরের বিশিষ্টজন। বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি সবাইকে অবাক করে বলে উঠেন–আমি ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তাদের কেন্দ্র করে এই অনুষ্ঠান অথচ এখানে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি কেন? হতচকিত কর্মকর্তারা সঙ্গে সঙ্গে খুলে দেন প্রেক্ষাগৃহের দরজা, দলে দলে প্রবেশ করতে থাকে ছাত্রছাত্রী। তাদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। এমনই ছাত্রদরদী আব্দুল কালাম।
আমৃত্যু তাঁর সাধনা–তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জিথা। সাধারণ জীবনযাপন আর অসাধারণ কর্মভাবনা। কয়েকটা কোট, কোটের পকেটে চিরুনি, হাজার হাজার বইয়ে ঠাসা একটা লাইব্রেরী এটুকুই সম্বল এক স্বপ্ন সন্ধানীর। ধর্মপালনের মধ্যে এনেছেন যুক্তিবাদ, হৃদয়ের ঔদার্য। জ্ঞানচর্চার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন ভারত আত্মার চিরন্তন সেবা ও ত্যাগের আদর্শ। জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও আব্দুল কালাম বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে শেখাতে চেয়েছিলেন প্রকৃতিকে ভালবাসার কথা। স্বপ্নের ফেরীওয়ালার অন্তিম স্বপ্ন ছিল দূষণমুক্ত এক পৃথিবী। কিন্তু থেমে যায় আগুনপাখির উড়ান। শবদেহ পৌঁছায় রামেশ্বরমে। যাত্রাপথে অগুন্তি মানুষের ঢল। ছাত্রছাত্রীরা এনেছেন কবিতা, সাধারণের চোখে জল। তিনি যে কারো প্রিয় কালাম স্যার। তিনি যে দেশের পিপিলস্ প্রেসিডেন্ট। রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে এমন উন্মাদনা দেশ কবে দেখেছে? রাষ্ট্রশিক্ষক তাঁর সহজাত মহিমায় রাষ্ট্রকে বলছেন– আমার মৃত্যুতে ছুটি ঘোষণা কোরো না। আমায় যদি ভালবাসো তাহলে সেদিন মন দিয়ে কাজ করো। 
  দেশের মানুষদের মধ্যে, বর্তমান শিক্ষককুলের মধ্যে এমন কর্মযোগের আদর্শ অনুসৃত হবে কি? শিক্ষকতাকে আব্দুল কালাম জীবনের সর্বোত্তম আসনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন বলেই তাঁর দৃঢ় বার্তা– বিজ্ঞানী নয়, রাষ্ট্রপতি নয়, শিক্ষক হয়েই মানুষের মনে বেঁচে থাকতে চায়। এমন গৌরবমণ্ডিত স্বপ্নের পথ ধরেই কি হেঁটে চলেছেন শিক্ষালয়ের উদ্দেশ্যে বর্তমান শিক্ষকসমাজ? –সময় বলবে সেকথা। 

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...