সোমা প্রধান-এর এক গুচ্ছ কবিতা
মেরামত
নিঃস্তব্ধ রাত্রির বুকে জেগে থাকে একজোড়া চোখ
দূরে আকাশের গা-য় মিটমিট তারা
জড়িয়ে রাখার রহস্যটা যে বলতো,
সে এখন অন্য কারও জাগ্রত প্রহর।
সময়, মেরামত করে সব ক্ষত।
ভেঙে যাওয়া মন, আক্ষেপ অথবা না পাওয়া আদর।
সন্ধের পর টুপটাপ হিম পড়ে
টুকরো টুকরো কথার ফুল ছড়িয়ে
চতুর্দশীর চাঁদ শীর্ণতোয়াটির মতো মিলিয়ে যায়...
কারও কারও বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে।
সময়
টবে বেলি ফুটেছে সদ্য, ম ম করছে তাই ভিতর বারান্দা
এই তো সঠিক সময়, চন্দ্রাহত হওয়ার...
এসো,
দুয়ার ভেজানো আছে।
বিছানার পাশে রাখা আছে রাতপোষাক, চটি, ডিও।
জলের বোতলও আছে।
বালিশের পাশে পাশবালিশ নেই।
আছে শুধু জড়িয়ে রাখার অপেক্ষারা।
ডাকনাম
একদিন সব ফুরিয়ে যাবে
আড়ালে রাখা কথা, লুকিয়ে রাখা চিঠি,
কিংবা হঠাৎ জেগে ওঠা আবেগ
সব ফুরিয়ে যায় সময়ের আগে
পেন্ডুলামের ঘরে বসত করে
পাখিদের ছানা, ঘুলঘুলিতে রোদ।
স্মৃতিফুঁড়ে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে ডাকনাম।
জন্মাষ্টমী
প্রপিতামহের চিহ্ন ফেলা গ্রামের বাড়ি
পথ চলে গেছে ঐ দিকে
অদৃশ্য টানে থেকে থেকেই ঢুকরে ওঠে দূরত্বের দ্বীপ।
রাস্তা জুড়ে বৃষ্টির কনসার্ট
তরতাজা সবুজে ঢুলে ঢুলে
গান পাড়ে হাওয়া
দূরে আলোর বিন্দু ক্রমশ বড়ো হতে হতে আমাকে পাশ কাটিয়ে অন্ধকারের দিকে চলে গেলো।
সূর্য ঘড়ির কাঁটা আজ পর্দানশীন
জন্মাষ্টমীর সন্ধে, নাড়ু তালের বড়া, ক্ষীরমোহন।
শ্রাবণের রাত আরও গভীর হলে গৃহস্থের বাড়ি
টিমটিম জোনাকিরা শীতঘুমে
আনমনে কথা বলে কেউ ঈশ্বরের সাথে।
মেঘজীবন
এমন কত রাত্রি কাটে একা
মনজানালায় এক টুকরো আকাশ
বৃদ্ধ গাছ, থমকে থাকে সেও
শেকড়জুড়ে গজিয়ে উঠছে ঘাস।
একলা থাকি নিজের মতো করে
এক দুই তিন হারিয়ে যাচ্ছে সব
কৈশোর ভাঙা সেই সব রোদ্দুরে
ঝিকিমিকি করে ভোকাট্টা শৈশব।
এখন নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি বেশ
ভুলপথে যত চৌচির হোক মন
যাপনচিত্রে শুধুই দুঃখবিলাস
সুখ! সেতো পরিযায়ী মেঘ জীবন।
রোদের শত্তুর
আমাকে পোড়ায় রোদের ওম,
ওমের ভিতর ছোট ছোট অভিমান, আরও ছোট কিছু ইচ্ছে রা গুটিশুটি বসে আছে পাশে..
মৃদু হাওয়ায় দুলে ওঠে ছায়া, রোদের শত্তুর
দীপের শিখায় কেঁপে ওঠে প্রেমিক
আমি তার নরম ডালে হাত রাখি,
অমনি সে তখন হাই তুলে দাঁড়িয়ে,
হেলিয়ে, পা ছড়িয়ে কতরকম
ভঙ্গি করে জানান দেয়, তার ক্ষুধা ও তৃষ্ণা।
আগমনী
তুমি ধীরলয়ে প্রবেশের পথ আটকেছো, ভিতরে আরও গভীর অন্ধকার। তীরের ফলায় বিষাক্ত ছোবল, হাতের মুঠোয় জিঘাংসা, আর চোখের মনির ভেতর জুলজুলে ফাঁদ...
সমস্ত আয়োজন সারা। তুমি স্থীর বিশ্বাসে তপোবনের সুন্দরতম সুড়ঙ্গ বেছে নিয়েছো।
আকাশ ফেটে বেরিয়ে আসছে গর্ভ ফুলের আলো... ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে তার কণা, তুমি তীব্র আবেশে চোখ বুজেছ, অমনি ফাঁদ গলে তীব্রতর অন্ধকারের ভিতর ছুটে গেল এক একটা আলোকরশ্মি ...
পড়ে রইলো তোমার তীর ধনুক, হাতের মুঠো খুলে ভোকাট্টা। আলোয় আলোয় ফুটে উঠছে দেবী মুখ। কপালে তখন জ্বলজ্বল করছে তৃতীয় নয়ন।
কবি
আমাকে আদল ভেবে এক
কবিএঁকেছিলো ছবি।
অর্দ্ধেক মুখ এঁকে সে ফিরে গেল
দুপুরের রোদ গড়িয়ে সোনা হলে
তার থেকে তুলি ডুবিয়ে
সে আঁকলো আমার চুল
হেমন্তের কুয়াশা আঁকলো
আমার কটিদেশ।
সমুদ্র থেকে উঠে এলো একজোড়া শঙ্খ।
সন্ধের মায়াময় জোনাকি আঁধার
বাসা বাঁধলো চোখের মনিতে।
কবি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে
থমকে চেয়ে রইলো
নিরাবরন মুর্তির সামনে।
আচমকা ঘোর কাটলে দেখে
মেঘের মতো চুলের থেকে
নীলচে ঝর্ণার ঢল আমার শরীর বেয়ে...
দূরত্ব
এবার ঘুমোতে যাই
মেপল গাছের পাতার রঙে রাঙিয়ে ওঠা সময়
দূরে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যাবে
গাঢ় পোশাকের ভেতর বেড়ে উঠছে শিশুমন, পালকের গন্ধে মাতাল।
কালো চশমায় ঢেকে যায় হরিন চোখ
নিজেকে চিনতে এতদূরে যেতে হয় বুঝি!
ডায়াল
মানুষ একা হয়ে গেলে
হাত চলে যায় স্তব্ধ রিসিভারে
বহু জন্মের পুরনো, কালো রিসিভার
মানুষ একা হয়ে গেলে
ডায়াল করে ডাকতে থাকে নিজেকে ।