রথযাত্রা: যাত্রার বোধনের দিন ।। শুভদীপ গোস্বামী

rath8p

রথযাত্রা: যাত্রার বোধনের দিন ।। শুভদীপ গোস্বামী

 

রথযাত্রা মানেই যাত্রার বোধনের দিন। ষষ্ঠী থেকে জষ্ঠি যাত্রার মরশুম হলেও জগন্নাথদেবের রথের চাকা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় প্রায় ৫৫০ বছরের পুরাতন লোকশিল্প যাত্রার যাত্রাপথ। অনেকে আবার এই দিনটিকে যাত্রার নতুন খাতার দিনও বলে থাকেন। কারণ এই বিশেষ দিন থেকেই শুরু হয় যাত্রাপালার বুকিং।

rath81

ষাট, সত্তর কিংবা আশির দশকের কথা। রথযাত্রায় চিৎপুরের যাত্রা পাড়া সেজে উঠতো রংবেরঙের পোস্টারে। রাস্তার ধারে চোখে পড়তো নায়ক নায়িকাদের বড় বড় ছবি দিয়ে বানানো হোর্ডিং। ছবিগুলি হাতেই আঁকা হতো। সাইনবোর্ডের ক্যালিগ্রাফি ছিল নজর কাড়া। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্লাব, লাইব্রেরি কিংবা অন্যান্য সংগঠন দল বেঁধে আসতো যাত্রা বুকিং করতে। এই দিনটিতে ছিল বিশেষ পূজার আয়োজন। যাত্রাদল গুলির গদিঘরে একটি তক্তপোশ থাকতো। তার ওপর মোটা তোষক ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা। থাকতো কয়েকটি তাকিয়া। পাশে কিছু চেয়ার ও লম্বা বেঞ্চ। মালিক বসতেন তক্তপোশে। কেবলমাত্র বিশিষ্ট কোন অতিথি এলে তাকে তক্তপোশে বসতে দেওয়া হতো। বাকিরা সবাই বসতেন চেয়ার ও বেঞ্চগুলিতে। দল মালিক এইদিন পালাকার, নির্দেশক, সুরকারের হাতে অগ্রিম কিছু টাকা তুলে দিতেন। একে বলা হয় 'সাইদ' করা। সুরকার গানের কথায় সুর বসাতেন। একে 'সুরভাঙ্গা' বলা হয়। কোন কোন দলে আবার নাটক পড়াও হত। কোথাও আবার এই দিন থেকেই শুরু হতো রিহার্সাল। অনেক দল পালার নাম সহ পালাকার, নির্দেশক, সুরকার, নায়ক -নায়িকাদের নাম দিয়ে ক্যালেন্ডার ছাপতেন। নায়েক পার্টির হাতে তুলে দেওয়া হতো ক্যালেন্ডার, মিষ্টি। সঙ্গে কিছু পোস্টার দেওয়া হতো। যাতে তাঁরা প্রচার শুরু করতে পারেন। বুকিং এর ওপর নায়েক পার্টি কমিশন পেত। সেই সময় রথের দিনেই বিপুলসংখ্যক পালা বুকিং হতো। অনেক সময় উল্টো রথের দিন বুকিং করতে এলেই নায়েক বন্ধুরা পছন্দের ডেট পেতেন না। যিনি যাত্রাপালা বুকিং নিতেন তিনি অধিকারী মহাশয় হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তখন যাত্রাদল গুলি বছরে প্রায় গড়ে ১৮০-২০০ টি করে শো করতো। শুধু তাই নয় যাত্রামোদি মানুষেরা ভিড় জমাতেন খবরের কাগজ কেনার জন্য। অতিরিক্ত কিছু পৃষ্ঠাও সংযোজন করা হত সেই সময় ।পাতার পর পাতা জুড়ে থাকতো সাদাকালো কিংবা রঙিন বিজ্ঞাপন।

rath82

এরপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সিনেমা, সিরিয়াল,ওটিটি প্লাটফর্মের আধিক্যে বিনোদন পৌঁছে গেছে বৈঠকখানায় । যাত্রা হারিয়েছে‌ তার জৌলুস।কমেছে চ্যারিটি শো-এর সংখ্যা। যাত্রার কিংবদন্তি কাকলি চৌধুরীর কথায় 'শিল্পীদের দর বাড়ায় সেলের প্যান্ডেল।বর্তমানে তার সংখ্যা খুবই কম। আমরা যাত্রা করে টাকা পেলেও অধিকাংশ মানুষ কিন্তু আমাদের ফ্রিতেই দ্যাখেন।'
তবুও ঐতিহ্য ও পরম্পরা মেনেই রথযাত্রার পবিত্র দিনে আজও সেজে ওঠে চিৎপুর কিংবা বাগবাজার। বাগবাজার ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চে থাকে নানাবিধ আয়োজন। রথযাত্রা উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির সামনে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। উপস্থিত থাকেন যাত্রার পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, অভিনেত্রীরাও। কেউ আসেন চিৎপুর ঘুরে, কেউ চিৎপুরে যাবার আগে। জমে ওঠে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, শুভেচ্ছা বিনিময়।

rath83

২০১৩ থেকে প্রতিবছর রথযাত্রার দিন প্রকাশিত হচ্ছে ‘যাত্রা দর্পণ’ নামে একটি পত্রিকা। কোন দল নতুন কী যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করতে চলেছে, সেই বিষয়ক বিস্তারিত তথ্য থাকে বইটিতে। যাঁরা নতুন পালার বায়না করতে চান তাঁদের সুবিধার জন্য এই উদ্যোগ। আকাদেমির সামনে হয় পোস্টার প্রদর্শনী। এই বছর প্রায় ৫৫ টি দলের পোস্টার সোনালী ফ্রেমে ঠাঁই পেয়েছে। হয়েছে বিভিন্ন দলের নতুন পালার বুকিং। অতিমারি ভয়াবহতা কাটিয়ে গত মরশুম অর্থাৎ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ থেকে যাত্রা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। কমবেশি সমস্ত দলই ভালো শো পেয়েছে।আকাদেমির উদ্যোগে পুরস্কৃত করা হয়েছে শো এর নিরিখে এগিয়ে থাকা প্রথম তিনটি দলকে। প্রথম হয়েছে দেবী বন্দনা অপেরার সামাজিক যাত্রাপালা 'আ-এ আমটি খাব পেড়ে।' ১৯১ রজনী অভিনীত হয়েছে মঞ্জিল ব্যানার্জী রচিত, চম্পা হালদার নির্দেশিত, অরূপ ব্যানার্জি অভিনীত পালাটি। ঝুলিতে রয়েছে একই মঞ্চে দু-বার অভিনীত হওয়ার রেকর্ড। দ্বিতীয় হয়েছে বিশ্ববাংলা অপেরা পরিবেশিত সামাজিক যাত্রাপালা 'আমি অন্ধকারের যাত্রী'। অজয় কুমার রচিত নির্দেশিত অভিনীত পালাটি ১৮২ রজনী অভিনীত হয়েছে। তৃতীয় হয়েছে মুক্তমঞ্জরী অপেরা পরিবেশিত সামাজিক যাত্রাপালা 'মেয়েরা কি জানে সিঁদুরের মানে'। বাবলি ভট্টাচার্যে রচিত, নেপাল সরকার সম্পাদিত, নির্দেশিত পালাটি অভিনীত হয়েছে ১৭৪ রজনী ধরে। তাই এ বছর রথযাত্রায় শিল্পীরা আবার নতুন আশায় বুক বাঁধছেন। স্বনামধন্য অভিনেত্রী রুমা দাশগুপ্ত, কাকলি চৌধুরী, চম্পা হালদার প্রমূখ অভিনেত্রীরা এই দিন দুর্গা পূজার মতোই আনন্দ করেন।সারা বছর ধরে এই দিনটির অপেক্ষায় থাকেন।দলমত নির্বিশেষে সবাই একসাথে মিলিত হন যাত্রা আকাদেমিতে। হয় মিষ্টিমুখ, শুভেচ্ছা বিনিময়। নতুন পোস্টার রিলিজ করলে জানা যায় কোন শিল্পী কোন দলে গেলেন। কেউ কেউ দল পরিবর্তন করেন, কেউ কেউ আবার বছরের পর বছর একই দলেই থেকে যান।

rath85

যাত্রার সুদিন কি তাহলে আবার ফিরে আসছে?সে উত্তর সময় দেবে। এটুকু বলতে পারি উৎপল রায় ,অনল চক্রবর্তী, মঞ্জিল ব্যানার্জী, ব্রহ্মময় চট্টোপাধ্যায়, অরূপ ঘোষ, বাবলি ভট্টাচার্যের মতো পালাকাররা যাত্রাকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। তাই রথযাত্রার পর থেকেই জোর কদমে লেগে পড়েছেন কথা-কাহিনীর নিটোল বুননে। আগস্ট মাসের মধ্যেই মোটামুটি সব দলেরই রিহার্সাল শুরু হয়ে যাবে। কোন দলের শো শুরু বিশ্বকর্মা পূজায়, কোন দলের আবার দুর্গাপূজাতে।জীবনমুখী পালাকার অনল চক্রবর্তী ৪০ বৎসর ধরে যাত্রা করছেন। যাত্রা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেন। অহেতুক মেলোড্রামার প্রয়োগকে দূরে সরিয়ে বাস্তবধর্মী কাহিনী ও উচ্চ স্বরের অভিনয়ের ধারা পরিবর্তন করে যাত্রাকে দিয়েছেন নতুন আঙ্গিক। উদ্দেশ্য একটাই যাত্রাকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। উনি বলেন,'বর্তমান যাত্রায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। যাত্রা এখন অনেক আধুনিক।আপনারা যাত্রা দেখুন।যাত্রার পাশে থাকুন।'

rath88

পুরোনো এই লোকসংস্কৃতিটি ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে জাত হয়েও বহু শতক থেকে ক্রমাগত ভাব, বিষয় ও অভিনয়ের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যুগযুগ ধরে রথের রশির টানের সাথে সাথে গ্রাম থেকে শহর সমস্ত নাট্যপ্রেমীদের টেনে এনেছে নাট্যশালার আঁতুড়ঘরে৷ সবশেষে বলা যায় রথেরযাত্রা যেমন বাঙালীর উৎসবযাপনের সূচনা কাল তেমনি বাঙালীর বহু প্রতিক্ষিত যাত্রাপালারও শুভসূচনাকাল। অতীত থেকে বর্তমানেও তাই সূচীত হয়ে আসছে যাত্রার সুদীর্ঘপথের নতুন নতুন অধ্যায়। সেই ধারা বয়েই আজও আধুনিক বিনোদন যাপনের সামগ্রীও তাই এই হাজার হাজার দর্শকের নাট্য-উন্মাদনাকে ম্লান করতে পারেনি। 

 

মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...