মেদিনীপুরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ইংরেজ শাসন বিরোধী সাহসিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন নাড়াজোলের সীতারাম খান ও রানী শিরোমণী। কিন্তু ১৭৮৮ সালের পর ১৮৯৫ পর্যন্ত নাড়াজোলের জমিদাররা প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করেনি। কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন এতবড়ো জমিদারির সুরক্ষায় ইংরেজদের সঙ্গে সরাসরি শত্রুতামূলক আচরণ না করে তাঁদের গুণগ্রাহীতার ভান করে তাঁদেরই পিঠে ছুরিকাঘাত করতে হবে। তাই আমরা দেখি অযোধ্যারাম খান ও মহেন্দ্রলাল খান ইংরেজদের দেওয়া উপাধি গ্রহণ করেছিলেন এবং ভিতরে ভিতরে দেশমাতৃকার সেবায় বিপ্লবীদের হাতে প্রচুর অর্থ দান করেছেন। মহেন্দ্রলালের পুত্র নরেন্দ্রলাল খান সরকারের ‘রাজ’ উপাধি গ্রহণ করেও ইংরেজবিরোধী আন্দোলন কিংবা স্বাধীনতা আন্দোলনের সুযোগ্য নেতা হয়ে ওঠেন।
১৭ ই অক্টোবর ১৯০৫ সালে নাড়াজোল বাজারের সমস্ত দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন নরেন্দ্রলাল খান। ম্যানেজার কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নাড়াজোলের মানুষ কংসাবতীতে স্নান করে খালি পায়ে বন্দেমাতারাম উচ্চারণ করতে করতে গ্রাম পরিক্রমা করেন। ২১শে অক্টোবর স্বদেশী সমিতির উদ্যোগে একটি শোভাযাত্রা পাহাড়িপুর থেকে শুরু করে সমস্ত শহর পরিক্রমা করে নাড়াজোলরাজের মেদিনীপুর প্রাসাদে উপস্থিত হন। সমিতির সকল সভ্য রাজা নরেন্দ্রলাল খান ও কুমার বাহাদুর দেবেন্দ্রলালের হাতে রাখি পরিয়ে দেন। রাজা নরেন্দ্রলাল শোভাযাত্রার অংশগ্রহণকারীদের গোলাপ স্তবক দিয়ে অভিনন্দন জানান এবং প্রত্যেককে মিষ্টি মুখ করান। ওইদিন মেদিনীপুরের রাজভবনে ‘বন্দেমাতারাম’ ও ‘আল্লাহো আকবার’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিলো। সন্ধ্যায় কিছু ছাত্র বড় বড় দোকানে পিকেটিং শুরু করেছিলেন। ব্যবসায়ীরা সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যোগজীবন ঘোষ প্রমুখের বিরুদ্ধে বিলিতি সামগ্রী ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ফৌজদারি মামলার রুজু করেন। ১৯০৬ সালের একুশে জুলাই রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটাল শহরে বক্তৃতা দিতে আসেন। ঘাটালের আন্দোলনকে তীব্র করার জন্য কৃষ্ণকুমার মিত্র, মৌলবী মনিরুজুমান, বিহারীলাল সিংহ, নগেশ্বরপ্রসাদ সিংহ, রাজা নরেন্দ্রলাল খান ও তিনকড়ি পতিরায় প্রমুখ বক্তাদের উপস্থিতি সেদিন ১৩ হাজার শ্রোতাদের মধ্যে অপূর্ব উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিলো। ২২ শে জুলাই রাজা নরেন্দ্রলাল খান, কুমার দেবেন্দ্রলাল খান, ত্রৈলোক্যনাথ রায়, রামধন অধিকারী প্রমুখ নাড়াজোলের পুরাতন বাজারে কেবলমাত্র দেশি সামগ্রী বিক্রির জন্য ব্যাপক প্রচার শুরু করেন। প্রকাশ্য বাজারে নরেন্দ্রলাল খান, তারকনাথ বটব্যাল ও হরিরাজ পণ্ডিতদের আদেশ দেন। যাঁরা বিলিতি চিনি ও লবণ ব্যবহার করবে তাঁদের পৌরহিত্য তাঁরা যেন না করেন। সাধনচন্দ্র গড়াইয়ের দোকান থেকে সর্বাধিক স্বদেশী বস্ত্র বিক্রি হতো। নাড়াজোলের স্বদেশীরা সেই সময় প্রতিদিন নদীর ধারে বটগাছের তলায় সমবেত হতেন।
১৯০৮ বাংলার বিপ্লবের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য বছর। সুশীল সেনের উপর বেত্রাঘাতের প্রতিশোধ নিতে বিপ্লবীরা সংঘবদ্ধ হয়। ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং সেই দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী কে। ১৯০৮ সালে ৩০শে এপ্রিল কিংসফোর্ডের মৃত্যুদিন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বাংলার দুর্ভাগ্য যে গাড়িতে বোমা ছুঁড়েছিলেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল সেই গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন কেনেডি পরিবারের দুজন। ক্ষুদিরামকে ওয়ানি রেলস্টেশনে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট মজঃফরপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। ক্ষুদিরামের ফাঁসির দিন কুমার দেবেন্দ্রলালের নেতৃত্বে নাড়াজোল এর মানুষ খালি পায়ে মৌন মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯০৮ সালে ২৮শে আগস্ট পুলিশ মেদিনীপুরের বহু স্থানে তল্লাশি চালান। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নরেন্দ্রলাল খানের মেদিনীপুরের গোপপ্রাসাদ, নাড়াজোলের রাজপ্রাসাদ, নাড়াজোলের কাছারিবাড়ি এবং এবং নাড়াজোলের হাওয়ামহল। তল্লাশকারী পুলিশ বাহিনী নাড়াজোল রাজপ্রাসাদ থেকে কিছু টোটা বারুদ ও বন্দুক উদ্ধার করেন। ইংরেজ সেনাবাহিনী রাজা নরেন্দ্রলাল খানকে গ্রেফতার করেন। ৪ঠা সেপ্টেম্বর রাজা নরেন্দ্রলালকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়। মহামান্য আদালত সেই আবেদন না-মঞ্জুর করেন। ৭ই সেপ্টেম্বর আমজনতার শ্রদ্ধার পাত্র নরেন্দ্রলাল খানের মুক্তির দাবিতে প্রায় ৭ হাজার জনতা আদালত প্রাঙ্গণে সমবেত হন। ওই তারিখেই সরকার পক্ষ কোতোয়ালি থানার লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা শুরু করেন। অভিযোগে উল্লেখ ছিল, মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে বোমা ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা হত্যার পরিকল্পনা গুপ্ত সমিতির বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে সাতাশ জনকে সোপর্দ করা হলো।
যে সাতাশ জনের তালিকা সরকার তৈরি করেছিলেন তাতে নরেন্দ্রলাল এর নাম ছিল সর্বপ্রথম। রাজা নরেন্দ্রলালকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের কনডেমড জেলে বন্দী করে রাখা হয়। ১৯শে সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে পুনরায় নরেন্দ্রলাল এর জামিনের আবেদন করা হয়। আদালত সেই দিন মধুসূদন দত্ত, শ্যামল সাহা, সারদা দত্ত, বড়দা দত্ত ও নিকুঞ্জ মাইতি ছাড়া আর সকলের আদেশ না-মঞ্জুর করেন। ২৩ শে সেপ্টেম্বর পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দুজন জমিদারের জামিনে রাজা নরেন্দ্রলালের জামিন মঞ্জুর হয়। আদালত নির্দেশ দেন নরেন্দ্রলালকে ব্যক্তিগত ব্যয়ে তাঁর প্রাসাদে পুলিশ প্রহরা বসিয়ে বসবাস করতে হবে। শুধুমাত্র নিকটাত্মীয় ও নিজস্ব কর্মচারী ছাড়া তিনি আর অন্য কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। আদালতের নির্দেশে প্রধান ফটকে দুজন ও সিঁড়িতে দুজন, নিচতলার অফিসের সামনে দুজন করে সশস্ত্র পুলিশ নিযুক্ত হন। রাজার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়ার হয় শুধুমাত্র রাণী মৃণালিনী দেবী, কুমার দেবেন্দ্রলাল, কুমার বিজয়কৃষ্ণ ও জামাই সুরেশচন্দ্র নিয়োগীকে। আদালতের নির্দেশে দুজন পাংখাপুলার এবং একজন পাচক রাজার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পান। ১৯০৮ সালের ৯ই নভেম্বর নরেন্দ্রলাল খান সহ চব্বিশ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বিচার হয় তিনজনের।
১৯১২-১৯১৩ সালে মেদিনীপুর শহরে ‘জর্জ লাইব্রেরী’ নামে একটি বই দোকান খোলা হয়। এই বই দোকানের সংলগ্ন পোড়া বাড়িতে প্রচুর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র মজুত রাখা হতো। নাড়াজোল বাড়িতে তৈরি হতো প্রচুর অস্ত্র। রাজবাড়ীর উত্তর অংশে ঝিলের ধারে একটি গোপন কক্ষে তৈরি হতো দেশীয় অস্ত্র। এখান থেকে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হতো। ১৯১৩ সালে কেশপুরে গরুর গাড়িতে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ, গাড়ির চালকসহ আরো একজনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯১৩ সালে ১০ই জুন গাড়ির চালককে কোর্টে তোলা হয়। গাড়ির চালক স্বীকার করেন রাজা নরেন্দ্রলাল খান নাড়াজোল থেকে মেদিনীপুরে অস্ত্রগুলি পাঠিয়েছিলেন নকুলেশ্বর ভট্টাচার্যের কাছে। রাজা বক্সিশ বাবদ তাকে ৫০ টাকা দিয়েছেন। ১২ই জুন নাড়াজোল রাজবাড়িতে পুলিশবাহিনী হানা দেয়। কিন্তু পুলিশ উল্লেখযোগ্য প্রমাণ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।
১৯২০ সালে রাজা নরেন্দ্রলাল খানের জীবনাবসান হয়। রাজা নরেন্দ্রলাল এর মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রলাল জমিদারির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শুধু জমিদারির দায়িত্বভার বললে ভুল বলা হবে, পিতার স্বদেশ প্রীতির অসম্পূর্ণ দায়িত্বও পালন করেন। ১৯০৩ সালে সিস্টার নিবেদিতা মেদিনীপুরে আসেন। ধর্মালোচনার মধ্য দিয়ে তরুণদের উৎসাহ দিলেন দেশমাতৃকার সেবায় প্রাণোৎস্বর্গ করতে। বিপ্লবী আদর্শের চিন্তাধারা সঞ্চারিত হলো দেবেন্দ্রলালের মনে। তৈরি হল সমাজ সেবার সুমহান ব্রতে। Bengal Light Horse এর সৈন্য বিভাগের শ্রেণি ভুক্ত হলেন দেবেন্দ্রলাল। ১৯০৫ সালে দেবেন্দ্রলাল খান দেশসেবার কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেন। বাংলার শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সংস্পর্শে দেবেন্দ্রলাল এর কর্মক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছিলো। রাজা নরেন্দ্রলাল এর বাসভবনে বাংলা শ্রেষ্ঠ দেশনায়কদের সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল। মতিলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, অরবিন্দ ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ দেশনায়কদের বৈপ্লবিক কর্মধারা দেবেন্দ্রলালকে মানসিকভাবে শক্তি যোগিয়েছিলো।
নাড়াজোল রাজবাড়ী ও গোপ প্যালেস ছিল বিপ্লববাদীদের সম্পূর্ণ নিরাপদ আশ্রয়। নাড়াজোল রাজের গোপ প্যালেসের আন্ডার গ্রাউন্ডে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভা হত। ইতিপূর্বে মেদিনীপুরে বিপ্লববাদের প্রাণপুরুষ সত্যেন্দ্রনাথ এর দাদা জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু দেবেন্দ্রলাল খানের রাজনৈতিক পরামর্শ দাতা হিসেবে নাড়াজোলে বসবাস করতে শুরু করেছেন। দেবেন্দ্রলাল খানকে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিপ্লবীদের অ্যাকশনের জন্য আর্থিক সাহায্য ও উৎসাহ দিতে অনুরোধ করেন দেশভক্ত দেবেন্দ্রলাল দেশের মুক্তি আন্দোলনের জন্য রাজনৈতিক গুরুর নির্দেশে অকাতরে দান করেছিলেন।
১৯শে মার্চ মেদিনীপুরে আইন অমান্য পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের কর্মসূচি অনুযায়ী সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে সফলতা দানের জন্য প্রতি থানায় কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সব থানায় সামুদ্রিক লবণ জলের অভাব থাকায় লবণ তৈরীর কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। মেদিনীপুর সদর ও ঝাড়গ্রামে মহকুমার কর্মীরা পিছাবনী লবণ কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ঘাটাল মহকুমার দাসপুর থানার শ্যামগঞ্জে একটি বৃহৎ লবণ সত্যাগ্রহ কেন্দ্র খোলা হয়। ৭ই এপ্রিল শ্যামগঞ্জ কেন্দ্রে লবণ তৈরির কাজ শুরু হয়। দাসপুর থানা কংগ্রেস কমিটির মন্মথ মুখোপাধ্যায়, বিনোদ বেরা, বিনোদবিহারী হড়, অরিন্দম , যতীশচন্দ্র ঘোষ এবং হৃষিকেশ পাইন ময়মনসিংহের, নলিনাক্ষ সান্যাল,আবদার রহিম প্রমুথ কিছু নেতা ওই কেন্দ্রকে পরিচালিত করেছিলেন। দেবেন্দ্রলাল খান কর্নেলগোলার কাছারি বাড়ির হাতার মাঠে বিশাল মণ্ডপ করে সত্যাগ্রহী অভ্যর্থনার আয়োজন করেন। মানভূম থেকে নিবারণ দাশগুপ্ত তেরো জনের স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়ে পিছাবনীর উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রলাল এর জাঠা ক্যাম্পে উপস্থিত হন।
১৯৩১ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর পুলিশ হিজলি জেলে বন্দিদের উপর গুলি চালিয়ে নিষ্ঠুর হত্যালীলা চালায়। বন্দী সন্তোষকুমার মিত্র ও তারকেশ্বর সেনগুপ্ত গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ ত্যাগ করলেন। এছাড়াও কুড়ি জন বন্দি গুরুতরভাবে আহত হন। সমগ্র বাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে। দেবেন্দ্রলাল খান তখন সদর মহকুমা কংগ্রেসের সভাপতি। এই ঘটনার সংবাদ তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রকে জানান। পোস্টমর্টেমের পর নিহত বন্দীদের মৃতদেহ গুলি প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে তুলে দেন দেবেন্দ্রলাল খান। সুভাষচন্দ্র বসু, জহরলাল নেহেরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাপুরুষোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেন। কবিগুরু তাঁর বেদনাদায়ক হৃদয়ের ক্ষোভ নিবেদন করেছিলেন। ‘প্রশ্ন’ কবিতায় ভগবানের চরণে। দেবেন্দ্রলাল খান খড়্গপুরের জনসভায় বলেছিলেন, মেদিনীপুরের যুবকগণ সন্তোষ ও তারকেশ্বরের ন্যায় দেশের মুক্তির জন্য শহীদ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করুক। এঁদের মৃত্যুর প্রতিশোধ তাঁদেরকে ত্যাগের দ্বারাই গ্রহণ করতে হবে।
১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত শাসন আইন পাশ করা হয়। ১৯৩৭ এর ১লা এপ্রিল এই আইন কার্যকরী হয়। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ আইনসভার নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মেদিনীপুর কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে দেবেন্দ্রলাল খান ও ঘাটাল- ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে কিশোরপতি রায় মনোনীত হন। দেবেন্দ্রলাল এর বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের প্রার্থী ছিলেন শম্ভু দত্ত এবং কিশোরপতি রায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের দাসানুদাস ঝাড়গ্রামের রাজা। দেবেন্দ্রলাল ৬০ হাজার ভোটে ও কিশোরপতি রায় ৮ হাজার ভোটে জয়লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় কংগ্রেস ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত হন দেবেন্দ্রলাল খান। ১৯৩৮ সালে ১৭ই মে সুভাষচন্দ্র বসু মেদিনীপুরে আসেন। ১৮ ই মে ঘাটাল মহকুমায় তিনটি সভা করেন। সভাশেষ করে দেবেন্দ্রলাল এর গাড়িতে চেপে নাড়াজোল রাজবাড়িতে পদার্পণ করেন সুভাষচন্দ্র বসু। রাজবাড়ির সিংহদ্বারের কাছে সুভাষচন্দ্র যখন উপস্থিত হন শঙ্খ ধ্বনি দিয়ে নাড়াজোলের মানুষ দেশনায়ককে অভ্যর্থনা জানায়।
১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়, দেবেন্দ্রলাল খান সহ নাড়াজোল এর কংগ্রেস সংগঠকরা সভা সমিতির পিকেটিং ইত্যাদির মাধ্যমে জনসংযোগ ও জনচেতনা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। ১০ই আগস্ট নাড়াজোল পুরাতন বাজারের কতকগুলি দোকানে পিকেটিং করা হয়। কংগ্রেস কর্মীরা ‘বন্দেমাতারাম’, ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’, ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে দিতে পথ পরিক্রমা করে নাড়াজোল হাইস্কুলের সামনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। দেবেন্দ্রলাল খান রাজবাড়ী সংলগ্ন চত্বরে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলেন। সেই সময় নাড়াজোলে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিলো। পুলিশের খাতায় এই অঞ্চলটির নাম ছিল ‘Hot- bed of terrorism’. নাড়াজোল এর পশ্চিম দিকের মাঠে (বর্তমান নতুন কলেজ ভবনের বিপরীতে) মিলিটারী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হতো। শ-দুই এক কলা গাছ পুঁতে সেগুলিকে মানুষ মনে করে এবং দূরের একটি বাঁধের ওপর সারি করে জল ভর্তি হাঁড়ি রেখে সেগুলিকে চুন মাখিয়ে দূর থেকে মেশিন গানের দ্বারা সবগুলিকে ফাটিয়ে দেওয়া হতো। এসবের আসল উদ্দেশ্য ছিল নাড়াজোল এর মানুষকে ব্রিটিশ শক্তির ভয় দেখিয়ে রাখা।
ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন বা ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলন বা স্বাধীনতা আন্দোলন যাই বলি না কেন, মেদিনীপুর সেই আন্দোলনের বিপ্লব তীর্থ আর এই বিপ্লব তীর্থকে যে পরিবার ধারাবাহিকভাবে লালন করেছিল সেই পরিবার হলো নাড়াজোল রাজ পরিবার। স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই উত্তাল অধ্যায়ের স্মৃতি আজও ছড়িয়ে আছে নাড়াজোল রাজের ভগ্নজীর্ণ প্রাসাদগুলিতে।