পয়লা পৌষ ও আমি
অঞ্জলি দেনন্দী, মম
আমার জন্মদিন পয়লা পৌষ। আমি তখন স্কুলের ছাত্রী। খুব নামডাক আমার! ... কেন? ঐ
বয়সে তা অতশত বুঝতুম নি! আর তা ছাড়া, তা নিয়ে অতশত মাথাও ঘামাতুম নি! হল কি?
! .........
আমাদের গ্রাম, চৈতন্যবাটীর মাঠের ধারে, এক খুব উঁচু একটি
ভিটেতে, সন্তে ঢল থাকতো। তার ভালো নাম ছিল সনৎ। কিন্তু আমি দেখেছি ও শুনেছি,
যে, সবাই ওকে সন্তে বলেই ডাকে। আমার বাবা তাকে খুব স্নেহ করত! কারণ, সে ছিল
খুব সৎ! সে তার ফ্যামিলি নিয়ে কচি পিসির ভিটেতে থাকতো। কচি পিসির কেউ কোথাও
ছিল না। অল্প বয়সেই বিধবা। তার শ্বশুর বাড়ি, এখানে নয়। এই উঁচু ভিটেটি তার
জন্মদাতা বাবার ভিটে। সে সন্তেকে পাতান ছেলে করেছিল। সন্তের বউ ও মেয়ে, ছেলে,
কচি পিসির কাছে থাকতো। খুব কম বয়সেই, সন্তে মারা গেল। কলেরা হয়ে। এবার সন্তের
মেয়ের বিয়ে ঠিক হল। সন্তের বিধবা বউ, আমার বাবার কাছে দান চাইতে এলো। আমার
বাবা দান দিয়ে, সন্তের মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল। কয়েক মাস পর, তার স্বামী তাকে
বাবার বাড়িতে দিয়ে গেল। আর কোনোদিনই ফিরিয়ে নিয়ে গেল না। ও তবুও সিঁদুর পড়ে।
পরে সে শুনেছিলুম, যে সে আবার অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। তাও কেন যে সে সিঁদুর
পড়ত? তা সে নিজেই জানে! ...... যাক। ...... এবার সন্তের ছেলের বিয়ে হল।
ছেলেটার একটি পুত্র হল। কচি পিসি এলো আমাদের মন্দিরগুলিতে পূজো দিতে। আমার মা,
তাকে পূজোর পর প্রসাদ দিল। সেদিন সন্তের নাতি, পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিল। কচি
পিসি, সন্তের ছেলেকে নিয়ে পূজো দিতে এসেছিল। এর নাম ছিল প্রদীপ। তবে ওর ডাকনাম
ছিল ইঁদুর। আমরা জানতুমই নি যে, ওর নাম প্রদীপ। সবাই ইঁদুর বলেই ডাকতুম। যাক।
...... ইঁদুর আমাকে বললো, " তোমার জন্মদিনে আমার ছেলে হল। আমার ছেলে যেন তোমার
মত হতে পারে! তুমি, ওর একটা ভালো দেখে নাম রেখে দাও গো! " আমি বললাম, " তোর
ভালনাম কি? " ও বলল, " ডাকনাম ইঁদুর। ভালনাম প্রদীপ। '' তখনই আমি প্রথম জানলাম
যে, ওর নাম প্রদীপ। যাক। ...... আমি তার সদ্যজাত পুত্রের নাম রাখলুম-"প্রতীক।"
ওর (ছেলের) ও কচি পিসির( পুতির ) খুব পছন্দ হল, এই নামটি! ......
এবার, আমাদের গ্রামের থেকে একটু দূরে, বাখরপুরে, থাকতো, আমাদের এক
আত্মীয়। তার নাম ছিল, গনেশ পাল। তার এক ছেলে জন্ম নিল, পয়লা পৌষ। সে আমাদের
বাড়ী এলো মিষ্টি খাওয়াতে। এসে বোললো, " অঞ্জু তোর জন্মদিনে, আমার ছেলে
জন্মালো। যেন ও তোর মতো হতে পারে! তুই ওর একটি সুন্দর দেখে নাম রেখে দে, দেখি!
" আমি তার নাম রাখলুম-"মিলন".........
এরপর, আমাদের জ্ঞাতি কাকার মেয়ে হল। তার নাম, সুদাম নন্দী।
আর ওর স্ত্রীর নাম, মালতী। সেও আমার জন্মদিনে, জন্ম নিল, এই ধরিত্রিতে। সুদাম
কাকা, আমাদের মিষ্টি খাওয়াতে এলো। এসে বলল, " অঞ্জু, তোর আর আমার মেয়ের
জন্মদিন, একই। ও যেন তোর মতোই হয়! তুই ওর এক উত্তম নাম রেখে দে! " আমি তার নাম
রাখলুম-"সুমনা" । .......
এবার, আমার জ্ঞাতী দাদা, অসিত নন্দীর পত্নী, হাসপাতালে ভর্তি
আছে। তার লেবার পেন তখন ওঠে নি। অসিতদা, ডাক্তারকে বলল, " ডাক্তারবাবু,
আগামীকাল পয়লা পৌষ, কালই আপনি সিজার করে, আমার সন্তানের জন্ম দেবেন! '' এটি
তার দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম ছেলেটিও সিজার করেই হয়েছিল। যাক। ........ এবারও
ছেলেই হল। আর তার জন্মদিনও পয়লা পৌষই হল।
আমি যখন সমাজের ও সংসারের, নোংরা নীচ রাজনীতির শিকার হয়ে
কষ্ট পেতাম। জীবন যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। যখন বাঁচার, আর, কোনও দিশা খুঁজে
পেতাম না, তখন নিজের মনে মনে, এই নাম রাখা ও জন্মদিন নিয়ে ভেবে, স্মৃতিচারণ
করে, হাসতে হাসতে ঈশ্বরকে বলতুম, " ঠাকুর! এ তোমার কেমন বিচার? ! ... "
কিন্তু, এখনও আমি জানি না যে, আমার জন্মদিন সত্যই কি, পুণ্যের? ! ...অবশ্যই
পয়লা পৌষই জানে তা...