procchod heontor mohool

‘চিরসখা, ছেড়ো না মোরে..’ ।। আনন্দরূপ নায়েক

ananda heontor mohool

 

 
পুরাতন বিকেল পেরিয়ে হলুদ ফুলে ভরা বাবলা গাছের সারি। চলে যাওয়া মাটির রাস্তাটি পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ে প্রিয় বাড়িটির ভেতর। সাঁঝ নেমে আসে। দখিনের বায়ু বয়। মৃদু আলো জ্বলে ওঠে। এক একদিন বাবা তার হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। গান গায় একের পর এক। তোমারি গান। তখন বড়ো বেদনার মতো ক্ষণে ক্ষণে বেজে ওঠো তুমি হে। 'বড়ো আশা, বড়ো তৃষা, বড়ো আকিঞ্চন তোমারি লাগি। বড়ো সুখে, বড়ো দুখে, বড়ো অনুরাগে রয়েছি জাগি'। ..বাবার অন্যতম প্রিয় গানটির কথা আমি জানি। এই তো সেদিন‌ও, পঁচাত্তর বছর বয়সের ভাঙা গলায় কী সাবলীল গেয়ে শোনাল সে গান। 'তুমি কোলে নিয়েছিলে সেতার, মীড় দিলে নিষ্ঠুর করে-- ছিন্ন যবে হল তার ফেলে গেলে ভূমি- ‘পরে'। নির্জন সুপ্তরাতের ভেতর বাজতে বাজতে কখন যে সেই শব্দসব আমার‌ই প্রিয় হয়ে ওঠে..। 
ভোর হয় পাখিদের ডাকে। একটু একটু করে বেলা বাড়ে ব‌ইয়ের পাতায়। কলকাতা-ক-তে সকালবেলার গানের আসর। সুবিনয় রায়ের গলায় 'বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর..'।  কেন জানি না মনে হয়, একটিই তো গান। একটিই তো কথা। সে কথা কত‌ই না সুরে গেয়ে ওঠা বারংবার। মস্তিষ্কের কোশে কোশে খেলে বেড়ায় শব্দ কয়টি। সুর বাজে। '..যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা, তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা। নিশিদিন এই জীবনের তৃষার 'পরে, ভুখের 'পরে..'। 'শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে..'। যদি লিখতে পারতাম এই জীবনে এই ক'টি লাইন, তারপর আর কিছু লেখার তো বড় একটা প্রয়োজন থাকত না। 
ছেলেবেলার আমার বান্ধবীদের সঙ্গে আমার বয়সের অনেক তফাত। তাতা। অনু। শেলি। নমি। ওরা আমার মায়ের সঙ্গে এক‌ই ইস্কুলে পড়ায়। কী প্রবল জোছনা ঝরে পড়ছে সেই সন্ধেবেলা। চারিদিক ভিজে যাচ্ছে নরম আলোয়। দূর্বাচটি নদীটির পাড়। নদীতীরে মাঠের পর মাঠ জুড়ে রজনীগন্ধার ক্ষেত। আমরা কজন হেঁটে আসছিলাম চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙা উছলে পড়া আলোর ভেতর দিয়ে। সঙ্গে মা-ও। কে যেন খালি গলায় গেয়ে উঠল। 'পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে, ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো'..।  ..অ্যালবামের ছবিটি দেখছিলাম। ক্লিক থ্রি ক্যামেরায় তোলা শাদাকালো ছোট্ট ছবিটি। 'এ কী সুধারস আনে'। রজনীগন্ধার বাগানে এত এত ফুলের মাঝে দাঁড়িয়ে সকলে। 
'ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে'-র সে কথা। উইন্ডস্ক্রিনের ওপর ওয়াইপার দুটো জলের সঙ্গে খেলছে তখন শব্দ তুলে। জানালার ছাই রঙা কাচের বাইরে 'মেঘমল্লারে সারা দিনমান' সেদিন শুধু 'ঝরনার গান' হয়ে বাজছে। এখন শ্রাবণকাল। '..বর্ষণ সঙ্গীতে রিমঝিম রিমঝিম..'। ঝরে পড়া জলফোঁটা। ভিজে যাওয়া রাস্তা। জলে ভেজা কুসুমের পাতা। শালের বন। পাহাড়ের গা ধুয়ে জল নেমে আসছে ঢাল বেয়ে। 'মেঘ ছেঁড়া আলো' এসে পড়ল খানিক। গাড়ি থামাতে বললাম স্বপনদাকে। এগিয়ে যাই ভিজে যাওয়া পাথুরে মাটির ওপর দিয়ে জঙ্গলের দিকে। 'তখন পাতায় পাতায়..'। '..বিন্দু বিন্দু ঝরে জল'। .. 'সমুখের পথ'।  'শ্যামল বনান্তভূমি'। কী অদ্ভুত সে 'পলাতকা ছায়া'।..  
-- কেমন আছেন, কবি?
-- ভালোই তো। আমি ভালো থাকি। অন্তত থাকার চেষ্টা করি। ..আপনি?
-- আপনাকে হঠাৎ ফোন করতে ইচ্ছে করল। জানি না  কেন!
-- বেশ তো! 
-- একটা গান শুনবেন, যদি গাই? 
-- সুন্দর গলা আপনার। কী দারুণ গাইলেন প্রিয় লাইনগুলো। 'জীবনলতা অবনতা তব চরণে'।
নীল পাহাড়ের কথা মনে পড়ে। যার ওপর থেকে ভোরের আলো পেরোনো‌ বরফশাদা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দু'চোখ ভরে দেখে নেওয়া যায়। প্রিয় দার্জিলিং। মেঘে ঢাকা পাহাড়ি পথের বাঁক। 'যে পথ সকল দেশ পারায়ে..'। পাইনবনের সারি পেরিয়ে, তিস্তার নীলাভ সবুজ উপত্যকা পেরিয়ে..। 'দূরে কোথায় দূরে দূরে..'। যেখানে 'আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে'।
এক একদিন একা। কী প্রবল একা। 'বিরস দিন বিরল কাজ, প্রবল বিদ্রোহে' একাই বেরিয়ে পড়ি প্রিয় দু'চাকাটিকে সঙ্গে নিয়ে। 'আসা যাওয়ার পথের ধারে' ফুল ফুটেছে কত। 'পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোনখানে..'। 'কী অচেনা কুসুমের গন্ধে, কী গোপন আপন আনন্দে'। ..এখন 'ফাগুন লেগেছে বনে বনে'। আগুন লেগেছে বনে বনে। এখন পলাশের মাস। আগুনের মাস। যদি এ আগুন থাকত চিরন্তন। জেগে থাকত এ বুকে। তুমি 'কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও'। 'তবে শেষে কেন দাও মুছে?'
সন্ধে ঘন হয়ে আসে। সোনাঝুরি বনের ভেতর আধো অন্ধকার নামে ধীরে ধীরে। খোয়াইয়ের হাট ফেরত লোকজনের গলার স্বর মিলিয়ে আসে ক্রমে। আলো জ্বালে একটি দুটি জোনাকি। চাঁদ আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। জ্যোৎস্না রাতে সবাই বুঝি হারিয়ে গেছে বনে? 'বসন্তের এই মাতাল সমীরণে'? বড় নির্জন এই চরাচর। 'এই নিরালায়.. আপন কোণে' বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে আমরা দু'জন। ..কী অপূর্ব গাও।  অন্তরের ভেতর থেকে উঠে আসা কথা তুমি গাও। বড় 'অন্তর তর সে'..। 'যদি এ আমার হৃদয় দুয়ার বন্ধ রহে গো কভু, দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে, ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু'। 
'এ কী গভীর বাণী এল'..।  কতদিন পর তাতা-র বাগুইহাটির বাড়ি এলাম। 'সেই বাণীর পরশ লাগে, নবীন প্রাণের বাণী জাগে'। ..আগে কত ফাঁকা ছিল জোড়ামন্দিরের এই এলাকা। একতলার পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে গিয়ে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে। আজকাল কানে খুব কম শোনে। মায়ের সঙ্গেও তো তাতা-র বয়সের বেশ পার্থক্য।  প্রতিদিন পাঁচ-ছটা বা‍ংলা কাগজ নেয়। সারা সকাল ওসব‌ই পড়ে। নিজের ক্যামেরা দিয়ে বেশ কতগুলো ছবি তুলল আমার। কত বয়স বেড়েছে আমাদের দু'জনের। জানালার পাশে নুয়ে আসা ডালে ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া। 'সে যে চিরদিবসের‌ই'। 
কোন‌ওদিন হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বসে সে। অপরিণত গলায় গান গেয়ে ওঠে। 'এ পথ গেছে কোনখানে গো কোনখানে..'। কথা বলি নিজের সঙ্গে একা। 'তৃপ্তি আমার, অতৃপ্তি মোর, মুক্তি আমার, বন্ধনডোর, দুঃখসুখের চরম আমার..'। ..'চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না। সংসারগহনে নির্ভয় নির্ভর, নির্জন সজনে সঙ্গে রহো..'।

কবি প্রণাম : হে অন্তর



Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 3479

যার নাম রোদ ।। লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল
Laxmikanta Mandal ।। লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল

           'তবে পরানে ভালোবাসা কেন গো দিলে              রূপ না দিলে  যদি বিধি হে ' -  এ আক্ষেপ নিজের কাছেই । ভালোবাসা চাই  - ভালোবাসা চাই  - ভালোবাসতে চাই - ভালোবাসতে চাই , আজ চিৎকার করে বলতে হচ্ছে । …

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 3834

ঘরের ডাক ।। কেশব মেট্যা
Keshab Metya ।। কেশব মেট‍্যা

  ‘পিসেমশায়! আমি কি ঐ উঠোনটাতেও যেতে পারব না?' –এই শব্দবন্ধ আজ  যেন বুকের মাঝে বারংবার ছ্যাঁৎ করে ছুঁয়ে যাচ্ছে । অমলের মতো কতো কোমলমুখের এখন এই একটাই আর্তি। দেওয়াল তোলা বর্গফুটের কারাগারে অসুখভয়ে বদ্ধ শৈশব। নির্ঘুম রাস্তার বুকেও শ্মশানের নিস্তব্ধতা।  নিজের…

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 2134

বন্ধু, রহো রহো সাথে...।। পাপিয়া ভট্টাচার্য
Papia Bhattacharya ।। পাপিয়া ভট্টাচার্য

     মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে এরকম স্থবির একটা সময়ের ভেতর আছি। দিন মাস সব গুলিয়ে গেছে, ঝিমিয়ে কাটছে সময়। রোজ ভাবি, আজ যেন কী বার!  কত তারিখ! কিছুতেই মনে আসে না  সহজে। তার মধ্যে এই একটা সপ্তাহ  যেন  একদম…

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 1675

‘চিরসখা, ছেড়ো না মোরে..’ ।। আনন্দরূপ নায়েক
Anandrup Nayek।। আনন্দরূপ নায়েক

    পুরাতন বিকেল পেরিয়ে হলুদ ফুলে ভরা বাবলা গাছের সারি। চলে যাওয়া মাটির রাস্তাটি পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ে প্রিয় বাড়িটির ভেতর। সাঁঝ নেমে আসে। দখিনের বায়ু বয়। মৃদু আলো জ্বলে ওঠে। এক একদিন বাবা তার হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। গান গায় একের…

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 2840

ব্যক্তিগত অন্তরকথন ।। অমিত মাহাত
Amit Mahata ।। অমিত মাহাত

    মা শালপাতা তুলে আনত বন থেকে। সেলাই করত। অন্যের বাড়িতে কখনও ধানসেদ্ধ চাল পাছড়ানো থেকে কাজে ভোজে ছোঁচগোবর সাফসুতরা। আমার তখন অতি অল্প বয়স। মা কাজে চলে যেত। সকালে। ফিরত সাঁঝে । আমার হাতে দেদার সময়। কীভাবে যে খরচা হত …

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 1699

আমাদের রবীন্দ্রনাথ ।। সোমনাথ শর্মা
Somnath Sharma ।। সোমনাথ শর্মা

  রবীন্দ্রনাথ। এই ভদ্রলোক সম্পর্কে আমাকে লিখতে হবে! কঠিন কাজ। ও কাজ আমি করব না। আমি যাদের চিনি তাদের নিয়ে লিখব। রবীন্দ্রনাথকে আমরা কত ভালোবাসি তার সপ্রমাণ ব্যাখ্যায় যাব খানিকটা। একজন লেখক বা যে কোনো পেশার সৎ লোক মনীষী হয়ে ওঠেন তাঁর…

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 3193

যে-অন্ধ বৃষ্টি আনতে যাচ্ছে ।। সুকান্ত সিংহ
Sukanta Sinha ।। সুকান্ত সিংহ

    আমার কিছু অনিবার্য বিষণ্ণতা ছিল। আমার কিছু অনিবার্য বিপন্নতা ছিল। আমার কিছু অনিবার্য আকুলতা ছিল। ছিল। আছে। থাকে। হ্যাঁ, আমার কিছু অনিবার্য আশ্রয়ও ছিল। সেই যে শিলাবতীতে নৌকো বাঁধা থাকত, আমি বাসের জানলা দিয়ে দেখতে পেতুম, তারা দুলছে জলের ঢেউয়ে…

May 7, 2020
Card image




কবি প্রণাম : হে অন্তর   দেখেছেন : 3336

‘চিরটাকাল সঙ্গে আছে জড়িয়ে লতা’ ।। প্রিয়াঙ্কা
Priyanka ।। প্রিয়াঙ্কা

      শব্দের অভাব বোধ হয়, সমুদ্রের বা আকাশের মতো অনন্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে। তাঁকে নিয়ে কিছু না লিখতে যাওয়া মানে ঠিক তাই। যাকে বাঙালীর বেশ বড় একটা অংশ একটা অলিখিত ব্যাকরণ বইএর ভেতর রেখে দিয়েছে।  স্বরলিপির অক্ষরের মধ্যে রেখে দিয়েছে। পাঞ্জাবী…

May 7, 2020
আরও পড়ুন

কবি প্রণাম : হে অন্তর- সংখ্যায় প্রকাশিত লেখা সমূহ



একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...