logo corona

স্বাদহীনতার জীবন : উপভোগ্য এক নোতুন পৃথিবী ।। বিভাবসু

swadhinota

 

স্বাদহীনতার জীবন : উপভোগ্য এক নোতুন পৃথিবী।। বিভাবসু 

।। এক ।।

স্বাদহীনতার প্রসঙ্গে ঢুকে পড়ার আগে, হে আমার জিহ্বার দেবতা, হে আমার বোধের দেবতা, হে তৃপ্তির দেবতা, তোমাদের আমি আমার বিস্বাদ ও বিষাদগ্রস্থ জীবনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। একসময়ে আমি তোমাদের ভুলঅনুষঙ্গে মাথায় তুলে রাখতাম বলে আজ, সুযোগ পেয়ে আরেকবারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমার এই স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে যে, সেসব দিনে আমি তথাকথিত স্বাদের কাঙাল ছিলাম। কথাগুলি এও প্রমাণ করে যে, আমি আজ তথাকথিত বিস্বাদের কাঙালতা অর্জন করে, ধন্য এক জীবন কাটাচ্ছি। এবার যদি 'তথাকথিত' শব্দটি দুই ক্ষেত্র থেকেই বিদায় দেই, তাহলে কথাগুলি দাঁড়ায় এই যে, একদা আদতে আমি বিস্বাদের সাধক ছিলাম। আজ আমি সত্যিস্বাদের পূজারী হয়েছি।

আজ তৃপ্তি নামক এক পরিপূর্ণ উপলব্ধি আমাকে ঘিরে থাকে। মানে আমি বর্তমানে এক উলোটপুরাণের জগতে বসবাস করছি। যদিও এইই প্রকৃত স্বাদ বা পিওর টেস্ট। আর আমি আশা করছি যে, আমার বান্ধবেরাও সেই অনুপম জগতে এসে বিচরণ করুন ও জীবনের সত্যিকারের আস্বাদ  নিন।

এখন বলি পূর্বাশ্রমে স্বাদ বলতে আমি কী জানতাম। আমাদের সাধারণ জীবনে, স্বাদের যে পারাকাষ্ঠা আছে, তার সবার উপরে লবনের অধিষ্ঠান। এক হিসেবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন হতে শুরু করে, রসনাবিপ্লব, সবকিছুতেই লবণ বা নুনের গরিমা আকাশচুম্বী। এরপরে যার ভূমিকা বিরাট, সে চিনি। চিন থেকে চিলি, আমাদের স্বাদের চিল চিৎকার জুড়ে আছে সে। অথচ মানুষের জীবনে, এই দুটি স্বাদেলা বস্তুর আলাদা কোনো ভূমিকাতো থাকার কথাই নয়, বরং নিষিদ্ধ হওয়াই উচিত। এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলার আগে আমি স্বাদগুলির শ্রেণিভাগ করে নিতে চাই। 

।। দুই ।।

স্বাদকে আমি মোটাদাগে চারভাগে ভাগ করতে চাই। আগেই বলেছি, এর একদম প্রথমেই আছে ১.জিভের স্বাদ। এটা আবার প্রধানত দুই প্রকার— প্রথমে আছে i) নুন, তারপরে আছে ii) চিনি। তারপর আছে ২. যৌনতার স্বাদ। এর একটাই স্বরূপ—'প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর...'। এরপর আসে ৩. মনের স্বাদ। মনের স্বাদ না বলে বলা যেতে স্বভাবের স্বাদ। এরমধ্যে পরে নানারকম মদ, মাদক ও মনের বিকারজাত স্বাদপূরণের ইচ্ছা। এটা অবশ্য সভ্যতার অন্ধকার দিক। সবশেষে বলি মননের স্বাদের কথা। মননের স্বাদ জটিল এবং বহুমুখী। তাকে আলাদা আলাদা করে দেখানো খুব মুশকিল। তবে এর কয়েকটি স্পষ্ট রূপ আছে। যেমন প্রথমেই আছে i) মুক্তচিন্তার স্বাদ, তারপরে আছে ii) বাক স্বাধীনতার স্বাদ। এবং তৃতীয়ত iii) নিজের মতো করে বাঁচার স্বাধীনতার বা স্বকীয়তাযাপনে স্বাদ। 

এবার দেখাবো ধীরে ধীরে কীভাবে আমি আমার জীবন থেকে তথাকথিত প্রধান স্বাদগুলি বিসর্জন দিয়েছি। বা কীভাবে আমার স্বাদবদল হয়েছে। বা কেন আমি তাদের ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। 

।। আলুনি জীবন ।।

যেদিন থেকে জানতে পারলাম মানবসভ্যতা যে প্রধান কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস অর্জন করেছে, তার এক নম্বরে আছে নুন, আলাদা করে নুন খাওয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই আমাদের, সেদিন থেকেই আমি খাবারে 'কাচানুন' খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। মানুষের সামান্য যে পরিমাণে নুনের প্রয়োজন তা শাকসবজি থেকেই পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, নুন ছাড়া খাওয়া অভ্যাস করলে একসময় নুন দেওয়া খাবারই বিষাক্ত লাগে। সেদিক থেকে বলা যায়, নুন খাবারের প্রকৃত স্বাদকে নষ্ট করে দেয়। যখন নুন খাওয়া ছাড়ি, তখন আমি একা একাই থাকতাম। রান্না করতে করতে কোন একটা পত্রিকায় পড়ছিলাম যে, নুন আলাদ করে খাওয়ার প্রয়োজন নেই; সেই মুহূর্ত থেকেই এটি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। যদিও আমি তখন পর্যন্ত অস্বাভাবিক লবণপ্রিয় ছিলাম। অথচ আমাদের সেই 'নুনের মতো ভালোবাসা' বা 'লবণসত্যাগ্রহ আন্দোলন' সব জায়গাতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ লবন। ভাবুন একটা কোম্পানি জাস্ট অপ্রয়োজনীয় একটি দ্রব্য দেশ-জাতিকে গিলিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললো। অন্যদিকে 'লাবণ্য' শব্দটি জন্ম পেয়েছে এই নুন থেকেই। আর ভেবে দেখুন আমাদের সাহিত্যে 'লাবণ্য' ব্যাপারটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়! আমাদের হাড়েমজ্জায় গভীরভাবে নুন-সাম্রাজ্য বিস্তারিত হয়ে আছে! এছাড়া কারো গুন গাইতেও আজকাল ভালো লাগে না। ফলত, এই আলুনি জীবনে মজাতেই আছি একথা জোর দিয়েই বলা যায়।

।। মিষ্টান্ন মিতরে জনাঃ ।।

সাহিত্যে মিষ্টতারই বা কদর কম নাকি? রস বা অমৃত যাই বলুন না কেন, প্রসঙ্গ 'মিষ্টি' হওয়া বাঞ্ছনীয়। 'মিছরির ছুরি' ব্যাপারটিও মনে রাখতে হবে। আমার বন্ধু ও প্রিয়জনেরা জানেন আমি একসময় কতটা মিষ্টিখেকো ছিলাম। কিন্তু এই মিষ্টিকেও আমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম, রক্তে চিনির মাত্রা বাড়বাড়ন্তের পরে। বহুবছর আমি চিনিহীন জীবন কাটাচ্ছি। মানে আমি একজন অচৈনিক। সত্যিকথা বলতে কী, গ্রিন টি দুধ, চিনি ছাড়া খেতে হিম্মতের প্রয়োজন হয়। কিন্তু একবার যদি আপনি প্রকৃত চায়ের স্বাদ পেয়ে যান, তাহলে গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, স্বর্গ হাতে পেয়ে যাবেন। তারপর একসময় জানতে পারলাম, চিনি খাওয়াও মানব সভ্যতার আরেকটি অপ্রয়োজনীয় খাদ্যাভ্যাস। শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, সে নাকি মাদকের মতো ক্ষতিকারক। ফলে আনন্দ আরো বেড়ে গেল আমার। এই হল আমার স্বাদহীনতার পানপাত্রের ইতিহাস। আসলে তা উপভোগ্য এক নোতুন পৃথিবী। 

।। যৌনতার স্বাদ ।।

পৃথিবীতে প্রকৃত প্রেম আর সম্ভব নয়। প্রথমত বিবাহপদ্ধতিই যৌনতার প্রকৃত স্বাদের পায়ে প্রথম শিকল পরিয়েছিল। তারপর যতদিন গেছে এবং নর-নারীর সম্পর্ক নিয়ে যত কড়াকড়া আইন হয়েছে, যৌনতা ততবেশি অফিসিয়াল ও কৃত্রিম হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে অনেক অনেক তর্ক-বিতর্ককে পাশে সরিয়েও বলতে চাই, এখন, বিশেষত পুরুষদের জন্য হৃদয়বিনিময় সত্যিসত্যিই স্বাদহীনতায় কাহিনি পরিণত হয়েছে। সে হিসেবে পুরুষের হাতেও এখন শেকল পরানো। তাই আমার দাবি যতদূর সম্ভব দ্রুত ’খেলনা'গুলি বাজারে সহজলভ্য হওয়া দরকার। না হলে মানবজীবন সত্যিকারের স্বাদহীন হয়ে যাবে। তাছাড়া অবদমিত যৌন ইচ্ছা, মানুষকে ভেতরে ভেতরে মানসিক রোগী করে তুলবে। কথাগুলি ফ্রয়েড সাহেবের অনুসারেই বলছি। আর আমি নিজেও সেটা রোমে রোমে উপলব্ধি করি।

।। নেশার স্বাদ ।।

আমাকে একবার এক পরিচিত বলেছিলেন,—‘তুমি মশাই নিরামিষ মানুষ’। সেই রসময় মানুষটি, নানা সময়ে আমাকে তার রসের আসরে যোগ দেওয়াতে ব্যর্থ হয়ে, এই ধিক্কারবাক্যটি বর্ষণ করেছিলেন। সেই সোমরসের স্বাদবর্জিত এই আমার অবস্থা এখনও একই আছে। সত্যি কথা বলতে কি শিল্প ছাড়া আমার কোনো 'নেশা' আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। আর আমার শিল্পচর্চার মূলে আছে নারী। ফলত, নারী ছাড়া আমার কোনো নেশা নেই। কিন্তু এই দুঃসময়ে ছিটেফোঁটা সে স্বাদের যোগানও রাহুগ্রস্ত। আমাকে যদি স্বাদহীনতার জীবন বলে সত্যিকারে কিছু বলতে হয়, তবে এই অনারী জীবনকেই বোঝাবে। বাদবাকী যে নেশাদ্রব্য, তা আমি সচেতন এবং ঘৃণাভরে উপেক্ষা করি। কারণ আমি আমার স্নায়ুর অধিকার কাউকে দিতে রাজি নই। আর তাই এই স্বাদহীনতার জীবনে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।

হায় চিল!...

।। মুক্তচিন্তার স্বাদ ।।

আমি সারাজীবন চেষ্টা করেছি, আমার ভেতরে সব সময় যেন একজন মুক্তচিন্তক জেগে থাকে। সে যেন মানব সভ্যতার স্বপক্ষে প্রহরী হয়ে ওঠে। কোনো চাপিয়ে দেওয়া বস্তাপঁচা চিন্তা যেন আমাকে না ছোঁয়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মুক্তচিন্তক হয়ে উঠতে পেরেছে কি? বা আমার সমাজ, আমার মুক্তচিন্তার দাম দেয় কি? আমিতো স্বাদহীনতার পৃথিবীতে ঢুকে পড়ি মাঝে মাঝেই। বেরোই কি কখনো? চারিদিকে চিন্তাহীনতার দানব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যে! এই স্বাদহীনতা আমাকে মরমে মেরে রাখে!

।। বাকস্বাধীনতার স্বাদ ।।

মুক্তচিন্তার হাত ধরেই আসে বাকস্বাধীনতার প্রসঙ্গ। যেমনটা ভাবি তেমনটাই বলতে চাই। কিন্তু পারি কই? বোধবুদ্ধি হবার পরে থেকেইতো এই বিষয়ে স্বাধীনতা অর্জনেরই চেষ্টা করে যাচ্ছি। কথা বলার স্বাধীনতা। আমার বলার কথা আমি খোলামেলা প্রকাশ করতে চাই। কোনো প্রকার সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় কাঁচিতে তাকে যেন ছোট না হতে হয়। চাপিয়ে দেওয়া কথা নয়, নিজের অনুভব-অনুভূতির কথাটি, আমি সোজাসাপ্টাই বলতে চাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, এই স্বাধীনতার স্বাদ সম্পূর্ণভাবে কখনোই পাওয়া হল না। সেই ডাকাবুকো বুকটাইতো নেই। এই ‘মিনমিনে শয়তান'-এর জীবন খুব খারাপ। আমি মেরুদণ্ডহীন এই আমিকে ঘৃণা করি।

।। স্বকীয়তাযাপনের স্বাদ ।। 

এও এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যতই আমি নিজের মতো থাকতে চাই, নিজের মতো ঘুরতে চাই, হারিয়ে যেতে চাই নিজের দেশে, ততো বেশি বেশি বেড়ি পড়ে আমার পায়ে। স্বকীয়তাহীন এক বিস্বাদ জীবনে ডুবে থাকতে বাধ্য হই আমি। কেউ কি পারে নিজের মতো করে বেঁচে থাকতে? সামাজিক জীব হতেই হবে? কেন? সমাজের এই ঘেরাটোপ আমি ঘৃণা করি। আমি একলা চলতে চাই। কিন্তু পারি কই? 

পরের জায়গা পরের জমি...

।। তিন ।।

আমার স্বাদহীনতার এই আখ্যান, আজ লকডাউনে আরও আরও স্বাদহীন হয়ে উঠেছে। এই আতঙ্কময় পরিবেশে কবিতা, ছবি, শিল্পের জগত আমাকে জাগিয়ে রেখেছে, বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে আজ এই পর্যন্তই থাক। আসলে ব্যক্তিগত অতৃপ্তির, অপ্রাপ্তির কথা নিয়ে বেশি কচলাতে নেই। তাতে পরিবেশ তেতো হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া স্বাদহীন গৃহ-সংশোধনাগারে থেকে থেকে আজকাল, মস্তিষ্কের মধ্যেও কেমন অসংলগ্নতা দেখা দিচ্ছে। তাই রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়েই শেষ করি—

'স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?/ দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,/কে পরিবে পায়।...'



একক কবিতা সন্ধ্যা



সহজ কবিতা সহজ নয় কঠিনও নয়



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...