আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...

একক কবিতা সন্ধ্যা



kobitadiwas

তরুণ কবির কবিতা উৎসব



Card image

তরুণ কবির কবিতা উৎসব
তরুণ কবির কবিতা উৎসব ।। রজত গোস্বামী
Card image

তরুণ কবির কবিতা উৎসব
তরুণ কবির কবিতা উৎসব ।। নিরঞ্জন জানা
Card image

তরুণ কবির কবিতা উৎসব
তরুণ কবির কবিতা উৎসব ।। মোনালিসা পাহাড়ী
Card image

তরুণ কবির কবিতা উৎসব
তরুণ কবির কবিতা উৎসব ।। সৌমন্তী সিনহাবাবু
Card image

তরুণ কবির কবিতা উৎসব
তরুণ কবির কবিতা উৎসব ।। সুজিত কুমার পাল
Card image

তরুণ কবির কবিতা উৎসব
তরুণ কবির কবিতা উৎসব ।। কৌশিক দাস
Card image

তরুণ কবির কবিতা উৎসব
তরুণ কবির কবিতা উৎসব ।। আগমনী রাজ
Card image

তরুণ কবির কবিতা উৎসব
তরুণ কবির কবিতা উৎসব।। মোহিত ব্যাপারী
Card image

তরুণ কবির কবিতা উৎসব
তরুণ কবির কবিতা উৎসব ।। কবিতা সামন্ত
Card image

তরুণ কবির কবিতা উৎসব
তরুণ কবির কবিতা উৎসব ।। শান্তময় গোস্বামী
IMG 20180320 WA0041
বোধিকেন্দ্রে সর্বব্যাপী উপলব্ধির সত্যতাই মণীন্দ্র গু'প্তের কবিতা
তৈমুর খান 
 
  
অনন্তকে ধারণ করে অনন্ত হয়ে যাওয়ার পরও নিজ অস্তিত্বকে আবার আলাদা করে তুলে আনতে পারেন । বস্তু শুধু বস্তু নয়, বাস্তবিক প্রাণের সংরাগে জীবন্ত অনুভবের ধারক ৷ দেখার মধ্যেও একটা আলাদা দেখা থেকে যায় I যাকে নতুন করে দেখতে শিখি I দার্শনিকের প্রজ্ঞার সঙ্গে রসিকের রসাচার মিশে গেলে যা হয় ৷ অথবা চেতনা ও অতিচেতনার মাঝখানে এক নতুন বাস্তবের নির্মাণ ঘটে চলে যা আমাদের কাছে অভূতপূর্ব, অনাস্বাদিত ৷ যুক্তি থাকে, মুক্তি থাকে, বিস্ময় থাকে, ব্যাপ্তি থাকে, মােহ ও মােচড় থাকে ৷ মেধা ও হৃদয়ের ঘোর লেগে যায় পরতে পরতে I মনোরম রম্যতা বজায় রেখেও নিষিদ্ধ ক্রুর কথকতা চলে আসে ৷ তাকেও এড়াতে পারি না । বজ্রের পাশে ফুল ফোটে, বাস্তবে নেমে আসে কল্পনা, ছবির ভেতর প্রাণের অফুরন্ত মহিমার ছড়াছড়ি ৷ অদ্ভুত রহস্যাচারী বিন্যাস রূপকথার প্রতিরূপে প্ৰবৃত্তিকে ধারণ করে কখনো তা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দােলাচলে দুলতে থাকে I ঝরঝরে মুখের ভাষাতেও এত জাদু আছে তখনি তা বোঝা যায় I শুধু মনের জটিল স্তরগুলি জীবনের বৃত্তকে ঘোরালো করে তোলে ৷ কাব্যের আকাশ তখন রহস্যময় এক আড়ালে ঢেকে যায় ৷ অবশ্য সময়ের কাছে জীবনের সাক্ষ্য দেওয়ার নিরিখেই কবিরও কিছুটা দায় থাকে I সেই দায়কেই ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন কবি মণীন্দ্র গুপ্ত । লিখেছেন-- 
 
“মণিকর্ণিকার দেশে বিকেল ফুরোয় না ।  ----শুয়ে থাকে 
শান্ত অনন্তনাগের মতো অপরাহ্ণ ভরে 
নেশাড়ু বুড়োর কাঁধে  আচাভুয়া পাখি নেমে বলে:
গল্প বলো -”       (গল্পগুলো)
 
সেইসব অদ্ভুত গল্পগুলাে তিনি একে একে কবিতায় তুলে আনেন ৷ গল্পগুলো পাহাড়ের মতো শূন্য, আবার খাদ হয়েও শূন্য হয়ে গেছে ৷ গল্পগুলো নেশার বুদ্বুদও যা উদ্ভট শ্লোকের I কখনো উত্তরকুরুর বন্য চামরী গরু, নীল ঘাস থেকে আকাশে লাফিয়ে ওঠে ৷ বৈকাল হ্রদের জলে ছায়া পড়ে নোমাডলদের। গল্পগুলো কখনও শেয়ালের মতো গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। তখন সে হয় হাঁড়িচোর। আহীর গ্রামের ভরা যুবতীরা ঘড়া ভরে দুধ নিয়ে যায় দিগন্তের দিকে। চোখ‚ পথিক‚ ছায়া‚ শ্লোক মিলে তৈরী গল্পগুলি পাখির ডিমের মতো ভেঙে যায়। ছড়িয়ে থাকা দৃশ্য ছায়াছন্ন বিশ্বাসের ঘোর থেকে কাল্পনিক মোহের বিস্তার করে তার ব্যাপ্তি এনে দেয়‚ তাকে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় কবি সচল করে তোলেন। বাংলা কবিতায় এই নতুন স্বর কোনওদিনই দশক দ্বারা বিভাজিত হবে না। একক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে চিরদিন বিরাজ করবে।
কবি মণীন্দ্র গুপ্ত (জন্ম ১ ৯৩ ০ ) জন্মেছেন অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় ৷ আসামের শিলচর এবং কলকাতায় পড়াশোনা করে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন ৷ সেনাবাহিনী থেকে ফিরে কলকাতায় মেশিন ডিজাইনের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন ৷ কিন্তু তার মধ্যে বিরামহীন কবিতা বীজ কীভাবে বিস্তৃত হতে থাকে তা সত্যিই বিস্ময়কর ৷ অর্ধশতাব্দী কবিতাযাপনে অতিক্রম করে চলেছেন, তবু কবিতায় কখনো বার্ধক্য আসেনি I যদিও উপলব্ধির ভেতর বারবার মনে হয়েছে আমরা বার্ধক্যের দিকেই হেঁটে চলেছি ৷ ‘অক্ষয় মালবেরী’ নামে আত্মজীবনী লিখেছেন 1 ‘ যোগিয়া বাড়ি’, ‘উলটো কথা’, ‘যৎসামান্য জীবন’ নামেও তার বিখ্যাত কয়েকটি গদ্যগ্রন্থ আছে I বিশিষ্ট কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখ করা যায় নীল পাথরের আকাশ, আমার রাত্রি, মৌপোকাদের গ্রাম, লাল স্কুলবাড়ি, ছত্রপলাশ চৈত্যে দিনশেষ, শরৎ মেঘ ও কাশফুলের বন্ধু, নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ, মৌচুষি যায় ছাদনাতলায়, এক শিশি গন্ধহীন ফ্রেইগ্ৰানস, নিরক্ষর আকবর, টু টাং শব্দ নিঃশব্দ, বনে আজ কনচের্টো প্রভৃতি ৷ কবিতার বোধ ও ভাষা জীবনের প্রবাহেই মিশে গেছে ৷ যত বড় হয়ে উঠেছেন, বহুমুখী চেতনার সংসার তত বিস্তার লাভ করেছে ৷ নিসর্গলিবিডো , দার্শনিকতা থেকে মৃত্যু সবকিছুর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছেন ৷ শ্রেষ্ঠকবিতার ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন---
“ লেখাপড়া শুরু হবার আগেই কবিতার দূতী সখীদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ছেলেবেলায় সেই অবােধ সময়ে ওঁরা আসতেন আমার ছোট্ট জীবনের তুচ্ছ ঘটনা ধরে আর অফুরন্ত নিসর্গের  ছদ্মবেশে I তখন থেকেই আমার কাছে কবিতার কলা কৌশল চাতুরি ছিল গৌণ l উপকরণ যতটুকু পেয়েছিলাম তা শুধু জীবনের কাছ 
থেকেই ৷ পরিবর্তে আমিও তার কাছে সরল থাকার চেষ্টা করেছি ৷ চেষ্টা করেছি সোজা পথে তার মর্মের কাছে যেতে I” 
 
সুতরাং কবিতার কাছে কবির সততা, সত্যতা বা ছলনাহীনতা আমরা বুঝতে পারি । অফুরন্ত প্রাণের উৎসস্থল থেকেই  কবিতার বীজ সংগ্রহ করেছেন। 
 
যে ঐশ্বর্যের বৃত্তে শান্ত রসের অভিক্ষেপ পর্যাপ্ত হয়ে উঠেছে‚ সেই জীবনদৃষ্টির অনন্ত রূপকার মণীন্দ্র গুপ্তকে বাংলা কবিতায় বরাবরই আলাদা করে ভাববার অবকাশ এনে দেয়। বাংলার জলবায়ু‚ প্রকৃতি‚ আকাশ‚ মানুষ ও মানুষের নানা সম্পর্ক কবিচেতনাকে উর্বর করে তুলেছে। বৈষ্ণব প্রেমচেতনা ধারা থেকে পেয়েছেন অনুপম মাধুর্য। মৃত্যু‚ শোক‚ যুদ্ধ‚ ধ্বংস---- এই প্রেমের শেকড়কে ছিন্ন করতে পারেনি। শরণার্থী ছায়া‚ অন্ধকার নাচ‚ করুণ মুখ সবকিছুই কবির মনে পড়েছে। স্মৃতির দুয়ার খুলে কবি দেখেছেন----
' বোন ভাই বন্ধু‚ তোরা কে কোথায় থেকে গেলি‚
                         কোথায় হারালি
                                      ভয় নেই!
আমাদের সমস্বর কলরব ফিরে আসছে ভাঁটি বেয়ে
                কান্না ভরা নদীর বিকেলে।’
                                                   (দিনের সীমান্তে)
 
দেশভাগ‚ ছিন্ন সম্পর্ক‚ কে কোথায় ছিটকে পড়েছে এই শূন্যতার অনুভব কবির মধ্যে জেগে থাকলেও সেই সমস্বরের সত্যকে অস্বীকার করার প্রয়োজন হয়নি। যেমন ‘অভিজ্ঞতা মানে জন্মান্তর’ কবি জানেন‚ তেমনি জানেন----
 ‘‘ প্রত্যেক আগুনগুলো আপন স্বভাববেশে
              জ্বলতে জ্বলতে নিভে আসে--
                               নিভে হিম হয় I”
                                                           (দম্পতি -- ৩)
 এই আগুন ভালোবাসার কিংবা সম্পর্কের কিংবা যে কোনো অঙ্গীকারেরই হোক না কেন, একদিন তা নিভে যায় ৷ এও তো কবির অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে I 
অভিজ্ঞতার এই স্তরেই কবির রহস্যময় উপলব্ধিরও দেখা পাই ৷ ‘মহিম্ন স্তোত্র-তে কবি লিখেছেন সেকথা--
“বাউলের মতো আমি ভিতরে জ্বালাব বাতি I” 
কারণ এই অলীক ঘুরিয়ে মেরেছে বহুদিন ৷ বহুদিন কবি অন্ধকারে নির্বাপিত ৷ কিন্তু পরক্ষণেই কবির আর এক সত্তা বলে উঠেছে---
‘‘এই টিমটিমে নিজস্ব বাতির জন্য এত লোভ ! ” 
এটা যে এক অভিমান, মায়া তা-ও জানেন কবি । তাই বহু প্রাণীর সভায় নিজেকে দেখেছেন---রােদ্দুরে, কাদায়, জলাধারে, মোষের
মতন পাঁকে‚ সাপের মতন পদ্মবনে, সন্ন্যাসী- বাঁদর অভিমানে। ভাগ্যিস প্রদীপ জ্বলেনি বলে এই বিশালতা ছুঁতে পেরেছেন ৷ বিশালতা যে শূন্যতার, অদৃশ্যতারও ধারক সেকথা স্পষ্ট করেছেন---
“আমি বিকেলবেলার সূর্যে মুখ রেখে, অবাস্তব এখন মিলিয়ে যেতে পারি, যাই নীরব রােদ্দুরে I” 
এই বিশালতা বোধ রোমাণ্টিক নয়, তাৎপর্যপূর্ণ আত্মস্ফুরণ I এই আত্মস্ফুরণ আর একভাবে এসেছে, প্রাণীর রূপে---
 “আমি প্রাগৈতিহাসিক নই, দৈত্য নই, কবি নই-- কীট I” 
কীটত্ব প্রাপ্তি নিরীহ, নির্বিরোধ শান্তাশ্রয়ী চৈতন্যের ধারক I যেমন কবি শরীর থেকে ময়লা তুলে ফেলতে চান না ; ধুলো ময়লা সবই দেহের অংশ ৷ সেখানেও এসে যায় মাটির সঙ্গে সেই শেকড়েরই টান ৷ বিকেল‚ সূর্যাস্ত, মৃত্যু, বিষাদ, আনন্দ, বুড়াে মানুষের কথা সব ভাবনার মধ্যেই শান্তশ্রী এক মুগ্ধতার বিস্ময় লেপ্টে থাকে, যাকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না I আবার স্থির বলেও ধরে নেওয়া চলে না । কবির দেখার গুণে, অভ্যাসের পরিবর্তনশীল ধারায় চিরচেনা দৃশ্যগুলিও পাল্টে যায় ৷ চেনা ও অচেনা হয়ে পড়ে ৷ ‘একদিন বনের মধ্যে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন---‘
‘একগাছি লতায় ফুল ফুটেছে পাথর বসানো নােলকের মতো ৷ 
সবুজ, ভরন্ত পাতায় কি মুখের কোনো অস্পষ্ট রেখা ?
  যেমনি এগিয়ে দেখতে গেছি--সব কেমন যেন বদলে গেল
 যেন নিষিদ্ধসীমায় পা দিয়েছি ! ” 
এই লতা‚ লতার ফুল কবির কাছে কামদীপ্ত যুবতী , তাই নিষিদ্ধ সীমায় চলে আসা মনে হয়েছে ৷ কিন্তু পরক্ষণেই তা পাল্টে গেছে আরও বিস্ময়কর দৃশ্যে---
 "চকিতে আমাকে ঘিরে হিসহিস করে লাফিয়ে উঠল
           মেঘ-সবুজ-অন্ধ বনের হাজারমুখ লতা 
তাদের প্রত্যেকের মাথায় মণি , চোখে মণি  I স্থির I” 
উদ্ভিজ্জ থেকে বস্তু সবই প্রাণের মহিমায় ব্যাপ্ত মানবীয় প্রবৃত্তির অলৌকিক সান্নিধ্যে নিষিক্ত অথচ এক সহজ সুন্দর লীলাময় ছবি । ভাঁড়ামি নেই, ফ্যান্টাসির বাড়বাড়ন্ত নেই--স্মিত চোখে উদাসীন হৃদয়ে দেখার ও উপলব্ধির প্রয়োগ আছে মাত্র। ‘মাহাতদের মরা শিশু ’ কবিতায় কবর থেকে শিশুটিকে শেয়াল আঁচড় দিয়ে টেনে তোলার সময় শিশুটির মধ্যে যে ভাবনার প্রয়োগ ঘটান তা অপূর্ব I শেয়ালের আঁচড় দিয়ে তোলাকে শিশুটি ভেবেছে মায়ের আদর l গলার নলি কামড়ে টানাকে শিশুটি ভেবেছে মায়েরই টান ৷ এইসব ভাবনার মধ্যেই কবিরও ঘুম ভেঙেছে ৷ ভাবনার সিঁড়ি বেয়ে তিনি অন্যত্র যেতে চেয়েছেন---‘আকাশ পথে হাঁটি’ বলে I কিন্তু অনন্ত থেকে সেই শিশুটির কাছেই ফিরে এসেছেন---
“এদিকে শেয়ালনী ছোট্ট মাথাটিকে দুই পায়ের মধ্যে রেখে
 কাঁকড়া খাবার মতো করে এক কামড়ে ভেঙে দিলে 
বাচ্চাটা ককিয়ে উঠলঃ মা--!
 শেয়ালনী করুণ স্বরে ‘বাছা, এই তো আমি… ’ বলে 
ঘুমপাড়ানী গান গাইতে গাইতে খেতে লাগল I”
 রুদ্র ও সৌন্দর্যের অপরূপ ব্যবহারে যে গল্পের প্রেক্ষাপট বাংলা কবিতায় তুলে ধরলেন তা আর কোনো কবির লেখাতেই পাই না । শেয়ালের শিশু খাওয়া স্বাভাবিক । সে মানুষ নয় সেকথা আমরা জানি, কিন্তু মানুষের ভাবনা তার মধ্যেও, কবিতাকে নতুন করে পেলাম I হিংসার সঙ্গে স্নেহের সম্পর্ক যে থাকে তা বহু ক্ষেত্রেই প্রমাণিত I মনের সর্বব্যাপী বিস্তার ঘটেছে বলেই নিরক্ষর আকবরও বহুমুখী প্ৰত্যয়ের উৎস মুখে আমাদের টেনে এনেছেন ৷ এই হচ্ছে কবির মহাকাব্যিক প্ৰসারতার গভীর পর্যটন ৷ মানব হৃদয়ের সঙ্গে মানব চরিত্রের বহুপর্যায় অনুধাবন ৷ মণীন্দ্র গুপ্ত সেই অনন্ত ঐশ্বর্যেরই সন্ধান পেয়েছেন বলেই তার লেখায় বাল্মীকি, ব্যাস, হোমারের সৃষ্টির প্রতি, মহত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন I তাঁর দৃষ্টির প্রসারতা, ঔদাস্য,অনুসন্ধিৎসা সবকিছুই ছাপিয়ে গেছে সময়ের সীমানাকে I আনন্দ, দুঃখ, হতাশার তথাকথিত স্বরূপের মধ্যে তিনি স্বভাব কৌতুক নিরাসক্ত দার্শনিক হয়ে উঠেছেন ৷ কোনো কিছুতেই তাঁর যেমন বিমর্ষতা নেই, তেমনি হা-হুতাশও শোনা যায় নি I ‘মারা গেলেন বুলেন্ত এচেভিত’ কবিতাটিতে মহাকাব্যিক ভাবনার অফুরন্ত বৈচিত্র  সন্নিবিষ্ট আছে ৷ মানব চরিত্রের বহুমুখী পরিচয় , আদিম প্রজ্ঞার উত্থান ও নীতি দুর্নীতির দ্বান্দিক বিষয়টি কবি তুলে ধরেছেন ৷ কবিতাটিতে কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন মহাকাব্যিক প্রেক্ষাপটে আর গল্পের প্রয়োজন হয় না ৷ লিরিকের ফল্গুস্রোতেই জীবনের বহুবর্ণ বিভাজিকা কীভাবে গতি সঞ্চার করে ৷
 কবির যতই বয়স বেড়েছে, আবেগ বিলীন হয়ে গেছে ৷ তাহলে কবিকে কে কবিতা লেখায় আজও ? উত্তরে কবি সেই অনন্তের ইশারাকেই কবিতার হাতছানি ভেবেছেন I অখণ্ড কাল, সর্বব্যাপী জগৎ এবং জীবনবােধের প্রতিবিম্বই কবিতায় ভাবনাকে উস্কে দিয়েছে ৷ 
কালের করাল গ্ৰাসে সবই ধ্বংসশীল I আশা বা হতাশার কোনো মূল্য নেই এখানে I এই নির্মোহ হয়ে ওঠাই মণীন্দ্র গুপ্তকে ঋষি করে তুলেছে I কখনো অবসন্নতা আসেনি বলেই বাংলা কবিতা পেয়েছে ঝরঝরে এক দার্শনিককে, যার কোনো মালিন্য নেই, দাগ নেই বরং রসিকের কৌতূকে এক আবহমান দার্শনিকের প্রজ্ঞায় উচ্ছল হয়ে উঠেছে I তিনিই সেই কবি যিনি একই সঙ্গে রসিক ও রহস্যাচারী, যুক্তিবাদী ও কল্পাশ্রয়ী, রূপ ও রূপকে মহাকালের ব্রহ্ম আলোকের দিশারি এবং জীবনবেদের শান্তশ্ৰী মর্মজ্ঞ রূপকার ৷ তাঁর দৃষ্টিতে আমরা দেখতে পাই I মানব মিছিলের অনন্ত রূপ কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে তা তিনি দেখিয়ে দেন I বাড়ি, বুড়ো, শেয়াল, বিকেল, সূর্যাস্ত বারবার তার কবিতায় ফিরে আসে I এগুলি জীবনের, সময়ের, প্রকৃতির সন্নিধানে মায়া , সত্য এবং আনন্দেরই প্রকাশ যা এক একটা পটভূমির ক্ষেত্র রচনা করে I যেমন বুকে ঠান্ডা লেগে কফ জমলে ঘুরুর ঘুরুর শব্দ হয় ৷ এই ‘ঘুরুর ঘুরুর’ শব্দে ঘুঘু প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে I তার সঙ্গে গাছ, গাছের নিঃশ্বাস, ছায়াও ফিরে আসে I কবিতার নাম ‘ঘুঘু’ হলেও শেষ অংশে লেখা হয়---
 
“শেষজীবন বড় মিষ্টি I
পোড়াে বাড়িতে ঘুঘু নামে‚
ডাকে I”
এই পোড়াে বাড়ি যে জীর্ণজীবনও তা বলাই বাহুল্য I ‘ছায়াজগৎ’ কবিতাতেও এই ইঙ্গিত পাই---
 
“এই বাড়িতে অনেকদিন হল একা I’
 
কবিতার শেষে লেখেন---
“তাকিয়ে দেখি -- নাঃ তুমি না, পৃথিবীর ঠাণ্ডা
 সন্ধ্যেবেলাকার ছায়া ঢুকছে ঘরে I”
‘সন্ধ্যেবেলা ’ জীবনের শেষ ধাপ, তারই ছায়া I ‘বাড়ির কপালে চাঁদ’ এটিই কবির শেষ গ্রন্থ I এখানেও জীবনের সেই ধূসর সন্ধ্যা আর অন্ধকারের ছায়াচ্ছন্ন নিরবধি আত্মোপলব্ধির প্রজ্ঞা মহিমান্বিত হয়ে ওঠে I জীবনের শেষ অন্তর্পাতে নীরবতারও এক ভাষা জেগে উঠেছে I ‘বনে আজ কনচের্টো’-য়  দেখি আত্মস্ফুরণের মগ্নতা গভীর অন্তর্দর্শী আলোকের নিরীহ প্রজ্ঞায় কীরকম আত্মযাপন কবির ৷ ‘টুং টাং শব্দ নিঃশব্দ’- তেও এই আত্ম-ঐশ্বর্যের ছায়া মথিত I শব্দের অন্তরালে নৈঃশব্দ্যের পরিধি বিস্তৃত ৷ দেহ ও বিদেহ এখানেও মিশে গেছে I রঙে-রসে, শব্দে-নৈঃশব্দ্যে তবু কবিতায় যে অভিক্ষেপ তা ঋষি জীবনেরই অনবদ্য প্রকাশ ৷ বিশেষণ বা উপমা প্ৰয়ােগে কবির অনন্যতা লক্ষণীয় I ভাঁজ করা পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানের মতো কুড়ি পঁচিশ তলা বাড়ি, চুলের মতো কুঁকড়ে যাওয়া গাছের মগডাল, যমের মোষের মতো রাগ, মহাদেবের ষাঁড়ের  হাম্বারের মতো ভোরের আলো, একপাল সিংহের মতোই পিঙ্গল ও উগ্র মরুভূমি, দীর্ঘনিশ্বাসের মতো লম্বা- লম্বা গাছ প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে এর আগে কখনো দেখা যায়নি I অক্ষরবৃত্তের চালে প্রথম দিকে কবি অগ্রসর হতে চাইলেও গদ্যের মহাপৃথিবীকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন I ভাবনাগুলি হুবহু চলিত কথাতেই লিখতে চেয়েছেন নিজস্ব ঢঙে I
 
মণীন্দ্র গুপ্ত ভারতীয় কাব্য শাস্ত্রকে অনুসরণ করেননি, বরং প্রচলিত সমূহ রীতিনীতির উর্দ্ধে  ভারতীয় মননকেই আশ্রয় করেছেন বেশি I তাঁর রচিত বাক্যণ্ডলি কখনোই কষ্টকল্পিত নয়, তা সুকুমার রীতির রসপ্রধান অবশ্যই, সব মিলেই সৃষ্টি হয়েছে নিজস্ব ঘরানা I বাক্য, পদ, শব্দের দ্বারা সৃষ্ট কথন রীতির মাধ্যমেই চিত্রকল্পণ্ডলি সৃষ্টি হলেও তার বোধিকেদ্রে ছড়িয়ে আছে এক সর্বব্যাপী উপলব্ধির সত্যতা I জন সিয়ার্দি( John Ciardi) এই কারণেই বলেছিলনে ‘Poetry lies its way to the truth.’ এই সত্যের পথই মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার পথ I যদিও কবিতা সমগ্রের ভূমিকায় তিনি বলেছেন ‘আমার কবিতাও অসমাপ্ত . . … ৷’ সব সৃষ্টিই কখনো সম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না I এই অসম্পূর্ণতার ধারণাই কবিকে দীর্ঘপথের পথিক করে তুলেছে I স্বাধীনোত্তর বাংলায় তিনি সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি রূপে চিহ্নিত হয়েছেন I ২০১০ সালে ‘টুং টাং শব্দ নৈঃশব্দ্য' কাব্যের জন্য পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার এবং ‘বনে আজ কনচের্টো’ কাব্যের জন্য ২০১১ তে পেয়েছেন সাহিত্য একাদেমি I পুরস্কারই শেষ কথা নয়, তাঁর কাব্য-কবিতা আবহমান বাংলাভাষী মানুষের কাছে কৌতূহল সৃষ্টি করে চলেছে I বিশ্বরূপ দর্শনের যাবতীয় রসদ যেন সেগুলি I 
 
 
 

Taimur Khan ।। তৈমুর খান

রথযাত্রা



Card image




রথযাত্রা  দেখেছেন : 1247

মাহেশের রথে ঘাটাল যোগ ।। সন্দীপ দে
Sandeep Dey ।। সন্দীপ দে

মাহেশের রথে ঘাটাল যোগ ।। সন্দীপ দে   বোন সুভদ্রা বেড়াতে যাবার বায়না ধরলে তাকে ভোলাতে মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে গমন করেছিলেন দুই দাদা - জগন্নাথ ও বলরাম। সেই যাত্রাই রথযাত্রা। বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে রথযাত্রা নিয়ে বলতে প্রথমেই যেটা মাথায় আসে- “রাধারাণী নামে একটি…

Jun 22, 2023
Card image




রথযাত্রা  দেখেছেন : 1151

রথযাত্রা: যাত্রার বোধনের দিন ।। শুভদীপ গোস্বামী
Subhadip Goswami ।। শুভদীপ গোস্বামী

রথযাত্রা: যাত্রার বোধনের দিন ।। শুভদীপ গোস্বামী   রথযাত্রা মানেই যাত্রার বোধনের দিন। ষষ্ঠী থেকে জষ্ঠি যাত্রার মরশুম হলেও জগন্নাথদেবের রথের চাকা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় প্রায় ৫৫০ বছরের পুরাতন লোকশিল্প যাত্রার যাত্রাপথ। অনেকে আবার এই দিনটিকে যাত্রার নতুন খাতার…

Jun 23, 2023
Card image




রথযাত্রা  দেখেছেন : 1145

গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা ।। শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়
Souvik Bandopadhyay ।। শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়

গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা ।। শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় উষ্ণতা এবং ভক্তির একটি প্রাচীন ঐতিহ্য, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা ২৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। গুপ্তিপাড়া পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার একটি প্রাচীন জনপদ। এই জায়গাটি চুঁচুড়া সদর মহকুমার বলাগড় ব্লকে অবস্থিত। গুপ্তিপাড়ার পাশ…

Jun 21, 2023
Card image




রথযাত্রা  দেখেছেন : 1107

মহিষাদলের রথযাত্রা ।। ড. নীলোৎপল জানা
Dr.Nilotpal Jana ।। ড. নীলোৎপল জানা

মহিষাদলের রথযাত্রা ।। ড. নীলোৎপল জানা     মহিষাদলের রথযাত্রায় মহিষাদল রাজ পরিবারের ভূমিকাই এক সময় প্রধান ছিল। এই রথ ২০০ বছরের প্রচীন। মহিষাদলের রথযাত্রার সূচনাবর্ষ নিয়ে অল্প হলেও বিতর্ক আছে। কোনো কোনো প্রাবন্ধিক মনে করেন ১৭৭৬ সাল নাগাদ মহিষাদল রথযাত্রার প্রবর্তন করেছিলেন  রানি…

Jun 19, 2023
Card image




রথযাত্রা  দেখেছেন : 1426

মেদিনীপুরের তিয়রবেড়িয়ার পেতলের রথ ।। কেশব মেট্যা
Keshab Metya ।। কেশব মেট‍্যা

মেদিনীপুরের তিয়রবেড়িয়ার পেতলের রথ ।। কেশব মেট্যা     শৈশবে মেলার প্রতি আকর্ষণ থাকবে না, এটা ভাবাই যায় না। কচি পায়ে হাঁটা দিয়ে মেলা দেখতে যাওয়া আর ছোট্ট ছোট্ট জিনিসের জন্য আবদারই তো মেলার প্রাণ। খেলারমাঠ আর মেলারমাঠ পেলেই শিশুরা ডানা মেলতে চায়…

Jun 19, 2023
Card image




রথযাত্রা  দেখেছেন : 1247

দাসপুরের খাঞ্জাপুরের প্রাচীন রথ ।। দেবাশিস কুইল্যা
Debasish Kuila ।। দেবাশিস কুইল্যা

দাসপুরের খাঞ্জাপুরের প্রাচীন রথ ।। দেবাশিস কুইল্যা   সে কবেকার কথা। সংস্কৃত পণ্ডিত চতুষ্পাঠীতে ন্যায়শাস্ত্র শিখিয়ে চলছেন ছাত্রদের। আর পণ্ডিতের পরিচয় ছড়িয়ে পড়েছে দূর বহুদূরে। তখন সময়টা দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে। বর্ধমান মহারাজ কীর্তিচন্দ্র মহাতাব। সংস্কৃত মনস্ক মহারাজের একান্ত ইচ্ছায় চেতুয়া পরগনার…

Jun 19, 2023
Card image




রথযাত্রা  দেখেছেন : 1006

রথ দেখবি নাড়াজোল, জাত দেখবি কানাশোল ।। উমাশঙ্কর নিয়োগী
Umasankar Neogi ।। উমাশংকর নিয়োগী

রথ দেখবি নাড়াজোল, জাত দেখবি কানাশোল ।। উমাশঙ্কর নিয়োগী ভগ্ন রাজপ্রাসাদ আছে রাজা নেই, রাজার রাজত্বও নেই কিন্তু রাজকীর্তির সব কিছু জনসাধারণের মন থেকে মুছে যায়নি। রাজকীর্তিকে নিজেদের অতীত গৌরব বলে মনে করেছে। সাধারণ মানুষের একটি অংশ নিজেদের অর্থ শ্রম আন্তরিকতা…

Jun 21, 2023
Card image




রথযাত্রা  দেখেছেন : 1243

মেদিনীপুরের রথযাত্রা ।। ভাস্করব্রত পতি
Bhaskarbrata Pati ।। ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের রথযাত্রা ।। ভাস্করব্রত পতি   অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। ধারে ভারে এগুলো বেশ কয়েক কদম এগিয়ে। তবে জেলার মধ্যে বিখ্যাত মহিষাদলের রথ, রঘুনাথ বাড়ির রথ, নাড়াজোলের রথ, বগড়ির রথ, মহাপ্রভু মন্দিরের রথ ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন…

Jun 19, 2023
আরও পড়ুন

সর্বাধিক জনপ্রিয়



একক কবিতা সন্ধ্যা



সহজ কবিতা সহজ নয় কঠিনও নয়



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...