একক কবিতা সন্ধ্যা ।। তানিয়া চক্রবর্তী

tania

তানিয়া চক্রবর্তী-র এক গুচ্ছ কবিতা

 

 

আলেয়া 

আসুন, প্রজাপতির পাখা ধরে উড়ি 
আগুনের কাছে এসে বসি,
এইসব বিচলিত অস্থির দেহ
প্রতিসম ভাগ নিয়ে ঘোরে--- 

হাসি পায়, আগুনের কাছে এসে বসি
ঈশ্বরী ও চাষী দুই শিশু
দুই স্তনে মুখ রেখে তারা পৃথিবী নাচায়,
এ মেরুজ্যোতির দেশ 
ছয় মাস মাটিতে ছয় মাস জলে
ফলে দেহগহ্বর জানে সবই আসলে খোলস 

মেয়েরা বড় হয়ে গেলে
বাবাদের স্বরগুলো বুড়ো হতে থাকে 
তারা জানে এসব সৎকারহীন দেহ
কলার ভেলায় ভাসা হলুদ জীবন! 

             ন্যাপকিন উপবাসী প্লাস্টিক মেয়ে
মেরুজ্যোতির লোভে তারা পিতৃহারা হয়--- 

 

গামছা

গামছা ধরে দেখুন---রক্তমাখা গামছা ---আমাদের রক্তমাখা ঠোঁট--- আমাদের শাণিত লেলিহান জিভ---

কলঙ্কে মাখা শ্লীল –অশ্লীল এই দেবী-চামড়ার শরীর ---শরীর ধরে তা ধিন-ধিন---ঝুমুর পূর্ণ নেশা

কাঁচুলি ভরা মেঠো গন্ধ--- এই তো আলোর হাসি --- দু’হাত দিয়ে চাপুন

ওরা আর চামড়া নয়--- ভর্তুকিরা ভেঁপু হয়ে বাজছে---এসব পেটুক দেশে দেবী নেমে আসেন

এসব নাগরদোলায় পুজো হয় --- ফানুস হয়ে অসুরের কামনা দেখি হাসি

এই গামছা ধরে দেখুন--- সতীর বিবাহ লগ্নে এলিয়ে রাখা গামছা  এ

গন্ধ কিনুন ---গন্ধ মাখুন --- এখানে নীল তিমি জিতে ---শিশুগুলির ছাই উড়ছে

শক্তি শক্তি শক্তি--- শক্তি এক জাদু ---জাদুর মধ্যে পরিব্রাজক উল্টেপাল্টে ঘুমোন

শরীরভর্তি ছাই---পেটভর্তি আলো---এই গামছা বাঁধা পেট ---গামছা গায়ের ভাই

---চাবুক শুষি রোজ---বৈদ্যুতিনের করমচা সব আলো---

গামছারা সব আলের পাশে ঘর বাঁধে গোল—ঘরের মধ্যে গ্রাম ---গ্রাম –এর নাম

করমচা ও আলো

 

পরিকল্পিত 

পরিকল্পনা আসলে একটা অভিসন্ধি
যার দৃশ্যত গায়ে মিহি মিহি হিসেব লেগে থাকে
আর এসব পরিকল্পনার দরুন আমরা চুরমার হতে থাকি---
পেটে প্লাস্টিক জমিয়ে বেঁচে আছে নুলো বুড়ো
তার পাশ দিয়ে বড় হচ্ছে এক্স –রে সভ্যতা
আহা এমন এক্স-রে কবে আসবে
যা দিয়ে মনের কঙ্কাল বেরিয়ে আসবে!
আসুন আমাদের কল্পনার গা জাপটে ধরি
যা অপ্রত্যাশিত তাই আসলে যাপন...

 

জিভ

ধরাধরি খেলতে খেলতে অধরা হয়ে গেলাম
ধরণ বুঝতে না পেরে ধারণ করলে
জিভ –এর ক্ষমতা বাড়ে, 
ক্ষমতাই যেহেতু অক্ষমতা
তাই জিভ অক্ষম! 
তাই শব্দের বদলে  চুষছি শুধু
জিহ্বাজনিত উচ্চারণ ক্ষুব্ধ হচ্ছে না
পর্বমাফিক জীবনের মিথ্যে দেখছি
যা সত্যির বিড়ম্বনায় অশালীন হয়ে উঠেছে--- 
চমকে চমকে যাচ্ছে যারা
তাদের হাতে হাত দিয়ে পলাতক হয়ে দেখলাম
সমাজের ভাবী মুখ আমায় ফিরিয়ে আনল টেনে
এখানে সাধু ও চোর  একসঙ্গে আদর করেছে মেঘের দিনে
আমি মেঘসর্বস্ব কখনো হয়নি বলে 
মেঘলা দিন কেটে গেছে... 
হিংসা এত হিংসাপ্রিয় বলে জনপ্রিয়দের লালা বার করে নেয়! 
আহা! এই রোমাঞ্চকর লালাময় জীবন
যার থেকে অপহরণ করার আর কিচ্ছু নেই বলে
আমি তাকে তেলাই
তেলিয়ে তেলিয়ে লালচে শরীরের কাঁটা বেছে বেছে খাই
এই বাছা আর খাওয়ার জীবনে
জিভ এক অশ্লীল মাধ্যম
সে আমায় হীন করার উদ্যোগ নিচ্ছে 
আমি একটু একটু করে বুঝতে পারছি... 

 

কার্নিশ থেকে 

এখানে পাটি পাতা ঘরে
পা ছড়িয়ে বসেছে মেয়েটা 
নীচু হয়ে বসায় চাঁদ উঁকি মারছে,
ভাবছে ওর আলো  কোথায় বেশী চকচক করবে! 
দাবনার লাল লাল চামড়া
জামাকাপড়ের হারেম বদলাচ্ছে
এখানে পাটি পাতা ঘরে
মেয়েটা গড়িয়ে চলে এসেছে ক্ষয়াটে ছাদে
শরীরের ওপরে গিরগিটি
গিরগিটি মুখ দেখছে না, ব্লাউজ দেখছে
বাচ্চা ঝুলছে কার্নিশ থেকে
একটি মা –এর জন্ম হচ্ছে
একটি মেয়ে মরে গেছে অসম সঙ্গম বিষে

 

সুতো বোনা 

ঘুরপাক আর তালি 
এই বাহানায় নিজেকে বাড়াচ্ছি
বৃদ্ধি ভেবে ভেবে আনন্দে গতিশীল হয়েছি
আর গতি কমে আসছে
যেন ট্রয়ের যুদ্ধ ভয়ে পেনেলপির মতো সুতো বুনি, 
সমস্ত বৃদ্ধি প্রেমদেবতা কেড়ে নিলেন
কী কলতান ইচ্ছের পর
খরস্রোতারা মুখ ভেঙিয়ে পথ করে দিল!
কে কখন পিছোয় কেউ জানে না!
তাই এত হুড়োহুড়ির মধ্যেই বেঁচে আছি
আমাদের ভাবহীন অনুবাদ জীবন হস্তান্তরের কবলে
কিলবিল করছে সহায়হীন হয়ে ! 
আহা দুর্দান্ত দুর্দশা
যেন, পেনেলপির মতো সুতো বুনি...

 

গার্হস্থ্য

পটে ফুটে উঠল গার্হস্থ্য রমণ
তার বসন্ত জীবনে কালো জিরে খাদ্য
সর্ষেমাফিক সে ঝাঁঝ কুড়োও স্বামীর
বিক্রির পটে উলঙ্গ করে প্রেমিক
প্রেমিকের দু’পায়ে দড়ির দাগ
আহা ভাঙা রাস্তার মতো সে যুবকের গায়ে
পা পিছলোয় মেয়ের--- 
ছোবড়া দিয়ে যৌবন ঘষে দেখে নুনছাল, নুনছাল
এসব নাভিদোষ ছলায়কলায় বাড়ে
শিরা ফুটে ওঠে গালে
নাক-ঠোঁট ঘন হয়
পৃথিবী রমণ কালে উপবাসী হয়েছে 
এ উদাস কথা শরৎ জানে না,কাশফুল জানে 
দু’দিক চাপা বলে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে
পটে ফুটে ওঠে অসুরের চোখ
শিবকে না জানিয়ে শিশুকোলে পার্বতী এসব দেখে রোজ
পটে ফুটে ওঠে গার্হস্থ্য বমন--- 

 

ঘুমের পর 

আগ্নেয়গিরির ঘুমোনোর পর
আমরা নগরের রাস্তায় দাবা খেলতে বসব,
দাবনার থেকে যে সকল মাংস
আহুতির জন্য বাঁচিয়ে রাখব বলে 
আমরা ভোলগা থেকে গঙ্গায় এসে বসলাম
পাথরের মুখে মুখে তর্ক করে তাকে ধারালো বানালাম
আজ সেই সভ্যতার ধর্ষকাম খিদে
তাদের পেটে এখন রাজকীয় নরমাংসের অভিষেক হয়
আহা আমাদের পাকরস!
আহা আমাদের জন্মক্ষণ! 
ঘূর্ণনের দাবিদার বলে
বলয়ে বলয়ে শক্তি বেড়েছে
আর নগরের ঘুমের পর
আমরা আগুন জ্বালাচ্ছি, 
মানুষই মানুষের পাকযন্ত্র
মানুষই মানুষের রোগ
নেশা নেশাকে এভাবে ছেয়ে ফেলেছে
যেন উটের জিভ --- ক্ষয় -এর মতো কালচে খিদে 

 

আকর্ষ 

 দু’পাশে বসে থাকা ক্ষয়িষ্ণু দেয়াল
আমাদের বুক দিয়ে হাঁটতে শেখায়নি
শুধু কিছু আকর্ষমাফিক গাছদের প্রতি 
ওরা যেন কিছু বলে! 
বাড়িয়ে দেওয়া হাত আসলে একটি প্রবণতার মতো,
 সকলের হাতে এখন পক্ষাঘাত
এ জাতীয় ছোঁয়াচে আনন্দে আমরা আত্মগ্লানি থেকে দূরে
বিসর্গের ওপর চাপিয়েছি ভার, 
ভার ও ভার, তোমার নামের গায়ে
আমাদের বিপুল বেকায়দারা জন্ম নিচ্ছে
তুমি বোঝো কী দেয়াল ?   
আমাদের ধারণ করা ক্রমশ কমাও
পারানির মতো আমাদের খুচরোরা সব 
তলানিতে গিয়ে জমে জমে রাজত্ব বানাচ্ছে
প্রতিদিন নকল ঝড়ের মতো
আমরাও বাহানা নিয়ে পালিয়ে বাঁচছি  
আমাদের পিঠ ঠেকুক তবু হেলান দিতে শিখিও না
এসো দেয়াল তোমার চুন-রং যাবতীয় আলোকিত
দেহের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসুক আমাদের কায়দা, 
কায়দা এসো, ঘামিয়ে তোলো  এ পূর্ণ দেহ
মৃত্যুর আগে একবার নিজেকে হেলানের মতো করে তুলি
যার ভেতরে জেগে থাকুক দানা দানা জলছবি...

 

রশ্মি

নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে ঠিক আধখানা হয়ে
সমর্পণ করেছে চাঁদ
যেন একটি অভুক্ত ভ্রূণ
চারপাশে মায়াভরা মেঘ জরায়ুর আনন্দের মতো, 
আমাদের কালো দিনে আলোরা এভাবে গান গায়
স্পর্শরেখার মতো তার দিকে তাকাই
পৃথিবীতে আসা আর যাওয়া দুটোই কোথাও সমার্থক বলে
ভ্রূণের মৃত্যুকালীন দিনে আমরা তাকে রসায়নাগারে রেখে দিলাম
আর পরীক্ষার সময় দেখলাম সে স্থিতি, আমি গতি
অথচ তারই স্থিতি আমার গতির রূপে এসেছে
এহেন জন্ম জন্মকে চুম্বন করে না
কেবল টর্চের মতো আলো জ্বলে ওঠে পেটে বা ফ্লাস্কে
সার্চলাইটের মতো আমাদের ভবঘুরে ভ্রূণ
নারকেল গাছের পেছনে বসে আছে কুমড়োর ফালি হয়ে
আর আমরা তাকে মাছের শরীর খুঁজে বেড়াচ্ছি... 

 

চাল

প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ দেখে
আমরা আর এক পাও বাড়াবো না
রাস্তায় হরি বোল শুনতে শুনতে আমরা 
চালের কথাও মনে রাখব না
এভাবে আমরা একদিক দিয়ে আরেক দিকে বেরিয়ে আসব 
যারা অপসৃয়মাণ তাদের জন্য প্রতিফলিত হব না
যারা আমাদের অপেক্ষা করে না 
দুই হাতে তালি মারার লোভে 
আমরা তাদের ভুলে যাব
এগিয়ে চলা সবসময় কী এতটাই ইতিবাচক!
গাছ থেকে আম ড্রেনে পড়ার চিন্তায়
ছাদে উঠে গাছ মুড়িয়ে আম খাব
আর আঁটি ফেল দেব ড্রেনে
আসলে এগিয়ে চলাটা একটা স্বার্থপরতাও বটে..

মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...