মহিষাদলের রথযাত্রা ।। ড. নীলোৎপল জানা
মহিষাদলের রথযাত্রায় মহিষাদল রাজ পরিবারের ভূমিকাই এক সময় প্রধান ছিল। এই রথ ২০০ বছরের প্রচীন। মহিষাদলের রথযাত্রার সূচনাবর্ষ নিয়ে অল্প হলেও বিতর্ক আছে। কোনো কোনো প্রাবন্ধিক মনে করেন ১৭৭৬ সাল নাগাদ মহিষাদল রথযাত্রার প্রবর্তন করেছিলেন রানি জানকী। কিন্তু প্রামাণ্য ইতিহাস বলে মহিষাদল রথযাত্রা শুরু করেছিলেন জনৈক মতিলাল পাঁড়ে যিনি রানি জানকীর পোষ্যপুত্র। রানি জানকীর মৃত্যুর পর ১৮০৪ সালে এই রথের সূচনা করেন। তবে রানি জানকী সম্ভবত রথের পরিকল্পনা করেছিলেন বলে জানা যায়।
আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে যে রথযাত্রার সূচনা হয়েছিল তা ছিল কাঠের সতেরো চূড়ার রথ। তখনকার দিনে তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৬০০০ সিক্কা টাকা। রথটি বর্গাকার হয়ে কৌণিকভাবে উঠে গেছে। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩২ ফুট। দ্বিতীয়তলের দৈর্ঘ ও প্রস্থ ২৫ ফুট। তৃতীয়তল ২০ ফুট, চতুর্থ তল ১৫ ফুট। পঞ্চমতলের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হল ১০ ফুট। চৌত্রিশটি কাঠের চাকা একলাইনে নেই যাতে দু-চারটি চাকা খারাপ হলেও রথ চলাচলে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। চারখণ্ড কাঠ দিয়ে এক একটা চাকা তৈরি। প্রতিবছর অন্তত দুটো করে চাকা মেরামত করা হয়। সমস্ত রথে মোট বাহান্নটি খুঁটি আছে যার মধ্যে চারটে মোটা খুঁটি রথকে ধরে রাখে।
এখন যে রথটি মহিষাদলের রথতলা থেকে গুণ্ডিচাবাড়ি যায় তার উচ্চতা এক থাকলেও চূড়ার সংখ্যা কমে তেরো হয়েছে। কথিত আছে ১৮৫১ সালে রাজা লছমনপ্রসাদ গর্গের জনৈক ফরাসী বন্ধু মঁসিয়ে পেরু রথ দেখতে আসেন এবং তখনই তিনি রথের প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য একটি নকশা করেন। নকশায় যোগ হয় চারদিকের ঝুলবারান্দা ও চারকোণের চারটি ঋষি মূর্তি। চূড়ার সংখ্যা কমে হয় তেরো। কলকাতা থেকে কারিগর গিয়ে সংস্কারের কাজটুকু করে। সঙ্গে হাত লাগায় দেশি ও চিনা কারিগররা। সেই থেকে বছরের পর বছর রথসংস্কার চলছে মূল কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে। শুধুমাত্র রাজা সতীপ্রসাদ গৰ্গ দুটো সাদা ঘোড়া রথের আগে যোগ করেন। মহিষাদল রাজাদের অন্যান্য স্থাপত্যের মতো রথটির কাঠের কাজ মনোমুগ্ধকর। রথের কোণে লতাপাতার নকশার বদলে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ প্রভৃতি জানোয়ারের উপর বর্শা হাতে সৈন্য বা নর্তকীদের মিছিল দেখা যায়।
প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী এই রথযাত্রা একটু হলেও অভিনবত্বের দাবি রাখে। আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে রথে আরোহণ করেন রাজবংশের আরাধ্য দেবতা গোপাল জিউ। সঙ্গে থাকেন কেবলমাত্র জগন্নাথদেব। ঠিক আগের দিন রাজবংশের আরাধ্য শালগ্রাম শিলা ‘শ্রীধর জিউ’কে রথে এনে ‘রথের চক্ষুদান' উৎসব হয় যা ‘নেত উৎসব' হিসেবে বহুল জনপ্রিয়। ( আজ সোমবার ঠিক দুপুর ২.৩০ মিঃ শুরু হবে) আঠাশ থেকে তিরিশ কিলোগ্রাম ওজনের এক একটি পিতলের কলস ও দশ থেকে বারো কেজি ওজনের এক একটি চক্র রথের চূড়ায় লাগানো হয়। রথের দিন শোভাযাত্রা করে জগন্নাথ দেব, গোপালজিউ ও শ্রীধরজিউকে নিয়ে এসে রথে বসানো হয়। পুরীর রথে টান দেওয়ার পরেই রাজবাড়ির কেউ পালকি করে এসে রথের রশিতে টান দেন। অসংখ্য ভক্তের প্রবল হর্ষধ্বনির মধ্যে রথ এগিয়ে চলে প্রায় এক কিমি দূরের গুণ্ডিচাবাড়ির দিকে। এখন রথে চারটি রশি লগানো হয়। একটিতে মেয়েরা টান দেয় অন্য তিনটিতে পুরুষেরা টান দেয়। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রথ চলতে থকে।
উল্টোরথের দিনও একইভাবে সেখানে উৎসব পালিত হয়।
কোভিদের আগে ২০১৮ সালে রথটির আমূল সংস্কার করা হয়। প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। গত বছর আবার চারটি চাকা পরিবর্তন করা হয় এবং ভালো করে রঙ করা হয়। রথে দেওয়ালে নানা ধরনের চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে কলকাতা থেকে চিত্র শিল্পী এনে। এখন রথটি পরিচালনা করে মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতি। এবছরও একই ভাবে রথটি চালিত হবে। এখন এই মেলাটি প্রায় একুশ দিন ধরে চলে।
মহিষাদলের প্রাচীন রথের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, সারা বছরই পর্যটকদের জন্য রাজবাড়ী ঘুরে দেখার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। রথের কয়েকটা দিন রাজকীয়ভাবেই সেজে ওঠে মহিষাদল রাজবাড়ি এবং প্রাসাদ চত্বর। পর্যটকদের জন্য রাজবাড়িতে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থাও চালু থাকে সারা বছরই। রাজবাড়িতে রাত্রিযাপনের বুকিং সংক্রান্ত ব্যাপারে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা রয়েছে। রথযাত্রা উপলক্ষ্যে ছোলাবাড়ি প্রাঙ্গণে নাগরদোলা বিভিন্ন দোকানপাট বসে। রাজবাড়ির আম্রকুঞ্জে কাঁঠালের দোকান রথযাত্রা উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে সজ্জিত হয়। মহিষাদলের রথের সঙ্গে কাঁঠাল কেনাবেচারই সম্পর্ক চিরকালীন।