লোকসংস্কৃতি
শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার...
এমন কাব্যপঙক্তি বিচ্ছিন্নভাবে উচ্চারণ করলে কিংবা পঙক্তিগুলির স্রষ্টার পরিচয় না জানলে মনে হতেই পারে, এ শুধু তরুণ কবির আবেগায়িত উচ্চারণ মাত্র। কিন্তু এমন স্বীকারোক্তির ‘জাগরণে হেমবর্ণ’ যিনি, তিনি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কবিতা তাঁর প্রথম প্রেম, গদ্যের লেখনী ধরেছেন পরে। গদ্যের তথা উপন্যাস-গল্পের বিপুল রচনাসম্ভার তাঁকে অর্থ-সম্মান-প্রতিষ্ঠার চূড়ায় বসিয়েছে। কিন্তু কবি সুনীল আজীবন কবিতাকে নিয়ে, কবিতার জন্যই সৃষ্টিসুখের আনন্দ-বেদনা বহন করেছেন। বস্তুতঃ সুনীলের কবিতায় বাংলা কবিতার পাঠক এক স্বতন্ত্র্য বিষয় ও উপস্থাপনার সাক্ষাৎ পেয়েছেন। প্রচলিত কবিতা স্রোতের বিপরীতে সুনীল যে যৌবনশক্তির প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, সেই সৃষ্টির ভুবনে তিনি থাকবেন অপরাজেয়। বাংলা কবিতায় সুনীলের অবদান সম্পর্কে তাঁর সমসাময়িক অন্যতম কবি উৎপল বসুর মূল্যায়নে স্বীকৃতির চূড়ান্ত দিকনির্দেশঃ
“আজ থেকে একশ বছর পর নয়, তারও আগে আমাদের লোকে ভুলে যাবে। ফেলে দেবে ‘They also ran’ এর তালিকায়। কিন্তু থেকে যাবে কবি ও সংগঠক সুনীল। এ দুটোর ব্যাপারেই যে অসাধারণ, যা তাকে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি করে তুলেছিল।”
‘দেশ’ পত্রিকার ১৯৫১ এর ৩১ মার্চ সংখ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়। কবিতার নাম ‘একটি চিঠি’। সুনীলের তখন সতেরো বছর বয়স।
পাঠকদের অবগতির জন্য সুনীলের প্রথম মুদ্রিত কবিতাটির আংশিক উদ্ধৃতিঃ
‘হিংস্র নখর এখনও লুকোয় বাঁকে-বাঁকে
সরল কুমারী বোবা চোখে শুধু চেয়ে থাকে। সমুদ্র-ঝড় আসেনি এখনও মনে মনে
বলাকা-হৃদয় এখনও শুধু দিন গোণে।’
‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশের পর সুনীলের দ্বিতীয় কবিতা ছাপা হয়েছিল ‘অগ্রণী’ পত্রিকায়। তৃতীয় কবিতা ‘শতভিষা’ পত্রিকায় এবং বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় চতুর্থ কবিতা ‘তুমি’ প্রকাশিত হওয়ার পরই সত্যিকারের কবির শিরোপা পেয়ে গেলেন। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে-র কবিতার বিষয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আকৃষ্ট করেছিল– কিন্তু আবিষ্ট করেছিল বুদ্ধদেব বসুর কবিতা। বুদ্ধদেবের কবিতার তীব্র আবেগ যুবক সুনীলকে আন্দোলিত করেছিল অনেক বেশি।
সচেতনভাবে কবিতার দিকে নিবিষ্ট হয়েছিলেন কলেজ জীবনে। সিটি কলেজে পড়াকালীন সুনীল বন্ধু পেয়েছেন দীপক মজুমদার এর মতো বিখ্যাত তরুণ কবিকে। কলেজে সকলেই দীপককে খুব খাতির করত। বন্ধুর প্রশংসায় সুনীলও সহপাঠী দীপককে সামান্য ঈর্ষা করতেন। প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা সঙ্গী করেই কলেজ ম্যাগাজিনে এবং বাইরের পত্র-পত্রিকায় সুনীল কবিতা পাঠাতে শুরু করেন। এভাবেই একদিন তিনি পৌঁছে যান সে যুগের বিখ্যাত প্রকাশক ‘সিগনেট বুক শপ’ এর কর্ণধার দিলীপ কুমার গুপ্তের কাছে। বিশিষ্ট প্রকাশক দিলীপ গুপ্তের অনুপ্রেরণায় ও পরামর্শে তরুণ কবিদের নিয়ে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার প্রকাশ ঘটলো।
১৯৫৩ তে ‘কৃত্তিবাস’-এর আত্মপ্রকাশ। মাত্র উনিশ বছর বয়সে সম্পাদক সুনীল ‘কৃত্তিবাস’-এর নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন।
সুনীল নিজেই জানিয়েছেন পঞ্চাশের দশকে তাঁর কবিতা রচনার সূত্রপাত। কিন্তু তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশ পায় আট বছর পরে ১৯৫৭ তে। দীর্ঘ ৭৮ বছর আয়ুষ্কালে সুনীলের কবিতার লেখনী ছিল স্বচ্ছন্দ সাবলীল। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থঃ ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’(১৯৬৫), ‘সোনালী দুঃখ’(১৯৬৫), ‘নীলপদ্ম করতলে’(১৯৮৬), ‘বন্দী জেগে আছো’(১৯৬৮), ‘বসন্তদিনের ডাক’(১৯৭০), ‘আমার স্বপ্ন’(১৯৭২), ‘জাগরণ হেমবর্ণ’(১৯৭৪), ‘দাঁড়াও সুন্দর’(১৯৭৫), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’(১৯৭৮), ‘দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায়’(১৯৭৯), ‘সোনার মুকুট থেকে’(১৯৮১), ‘স্মৃতির শহর’(১৯৮৩), ‘নীরা হারিয়ে যেও না’(১৯৮৮), ‘অন্য আমি’(১৯৯১), ‘সেই মুহূর্তে নীরা’(১৯৯৭), ‘নীরা এবং নীরা’(২০০০) ইত্যাদি।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’ থেকেই কবি সুনীলের নিজস্ব কবিদৃষ্টি এবং উপস্থাপনার স্বাতন্ত্র্য পাঠকদের আকৃষ্ট করে। আধুনিক জীবনযন্ত্রণায় একাকিত্বের গভীর বেদনায় কবিমন যে পীড়িত, তারই কাব্যভাষা এই প্রথম কাব্যপ্রয়াস। কবিতার আত্মপ্রকাশের মুহূর্তে কবি সুনীলের যে জীবনবোধ এবং কাব্যাদর্শ, সময়ের অগ্রগতিতে তা বহুমাত্রিক সুরে ও স্বরে রূপময়।
‘আমার অধিকাংশ কবিতাই স্বীকারোক্তিমূলক– সেইজন্য বোধহয় আমার এমন একটি কবিতাও নেই, যাতে ‘আমি’ শব্দটি অন্তত একবারও ব্যবহার করা হয়নি।’ এমন স্বীকারোক্তি করেছেন কবি সুনীল নিজেই। প্রথম থেকেই সরাসরি নিজের জীবন অভিজ্ঞতাকে কবিতার বিষয় রূপে গ্রহণ করেছেন। সে কারণেই তাঁর কবিতা হয়েছে Confessional poetry বা ‘স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা’। পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে ব্যক্তিজীবন ও কবিতা পৃথক পৃথক না থেকে তাঁদের কাছে ‘জীবনই কবিতা’ ‘কবিতাই জীবন’ হয়ে উঠেছে। বাংলা কবিতার পালাবদলে পঞ্চাশের কবিরা যে ভাষাগত ও বিষয়গত পরিবর্তনে সক্রিয় হয়েছিলেন সেখানেই তাঁদের লেখনীতে ‘সাবলীল’ হয়েছে ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ কবিতা। এ প্রসঙ্গে সুনীলের বক্তব্য ছিলঃ
‘কবিতাকে আমার জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলাম। সাহিত্যের আড়ালে নিজেকে লুকোতে চাইনি, নিজেকেই প্রকাশ করতে চেয়েছি। আমার প্রতিটি কবিতাই আমার জীবনযাত্রার প্রতিফলন।’
বলাই বাহুল্য, সুনীলের এ জাতীয় কবিতা বিশেষভাবে স্বচ্ছন্দ, কষ্টকল্পিত নয়। রোমান্টিক হয়েও এ কবিতা জীবন্ত ও বাস্তব। ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’ সংকলনের ‘সাবধান’ কবিতাটি প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণীয়ঃ
‘রাস্তায় একটা বাচ্চা ছেলে বমি করলো
আমি ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী–
পিছনের দরজায় বস্তাভর্তি টাকা ঘুষ নিচ্ছিল যে লোকটা
আমি তার হত্যার জন্য দায়ী–’
‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’ কাব্যের নাম কবিতাটি তো এই কাব্যরীতির সবিশেষ দৃষ্টান্ত। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে বেশ কিছু আক্ষেপও প্রকাশ পেয়েছে ‘অনর্থক নয়’ কবিতায়–
‘বিষম টাকার অভাব। নেই। শুধু হৃদপিণ্ডে হাওয়া টেনে নিয়ে
হাসি কুলকুচো করি। মাথায় মুকুট নেই বলে
কেউ ধার দিতেও চায় না।
কিছু টাকা জমা আছে ব্লাড ব্যাঙ্কে। সামান্য।’
স্পষ্টই বোঝা যায় চারপাশের দেশকাল এবং সময়ের প্রবহমানতা থেকে কবির আত্মকথন উঠে আসে। মনে রাখতে হবে কাউকে শোনানোর জন্য এ কবিতা নয়, শুধু নিজেকে শব্দশিল্পের আয়নায় প্রতিফলিত দেখা। কবির নিজের অস্তিত্ব, কেমনই বা চতুর্দিক, চারপাশের মানুষের মুখগুলি কেমন– অগোচরে বা সচেতনভাবেই কবি পাঠকের শ্রুতিতে পৌঁছে দিয়েছেন এইসব কথা। মনে রাখতে হবে সুনীলের সুদীর্ঘ কাব্যচর্চায় কবিতার উপস্থাপনাগত এই রীতি একইভাবে অনুসৃত হয়নি।
সুনীলের কবিমন রোমান্টিকতায় আদ্যন্ত আচ্ছন্ন। তাঁর প্রথম কবিতা রচনার প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিপ্রেম তখন রোমান্টিকতার যে উদ্দীপনা প্রেরণা ছিল, সেই রোমান্টিকতা সুনীলের সঙ্গে আজীবনই বহমান থেকেছে। বলাই বাহুল্য, জীবনানন্দের কাব্যজগতে প্রেমের যে রহস্যময় চিরকালীন সৌন্দর্য বর্তমান, তার পরবর্তীকালে প্রেমের কাব্য-কবিতায় কোনো কবির ভুবনজয়ী হওয়া ভীষণ কঠিন। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক্ষেত্রে অতিমাত্রায় সফল। ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর কবিদের প্রেমের কবিতায় রক্তমাংসের প্রণয় উল্লেখযোগ্য সৌন্দর্য। সুনীলও সেই সৌন্দর্যের উপাসক। তাঁর কাব্য যৌবনমূর্তির চঞ্চল প্রতিচ্ছবি। আবেগের তুফানী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তিনি সারা কলকাতা আলোড়িত করেছেন যৌবন সুখ অনুভবের আকাঙ্ক্ষায়। রোমান্টিক সুনীল প্রেম এবং নারী পুরুষের সম্পর্ককে নতুন আলোয় আলোকিত করেছেন। নারী তাঁর কাছে এক অন্তহীন প্রেরণা। নারীর বিচিত্র রূপ-রহস্য সুনীলের গদ্য-পদ্য কে সমানভাবে উদ্ভাসিত করেছে। ভালোবাসা আর সুন্দরের অনুধ্যানে তিনি সারাজীবন তৃষ্ণার্ত। লিখেছিলেনঃ
‘আর কিছু নয়, দু’আঙুলের ডগায় নুন তোলার মতন দাও ভালোবাসা’– এই যেন সুনীলের জীবনের, সাহিত্যের একমাত্র পিপাসা।
প্রেমের কবিতায় তাঁর কাব্যে নারীরা কখনো এসেছে যমুনা, নীরা নাম নিয়ে। কিন্তু সুনীলের প্রেমের কবিতা প্রধানতই ‘নীরা’ সর্বস্ব। কয়েকটি কবিতায় এবং নীরাকে নিয়ে একাধিক কাব্যগ্রন্থে সুনীল তাঁর প্রেমের বিচিত্র সৌন্দর্য শিল্পিত করেছেন। জীবনানন্দের বনলতা সেনের মতো ‘নীরা’ও সুনীলের মানসী-প্রেমিকা-প্রেম-প্রজ্ঞা এবং সৌন্দর্য।
নীরাকে নিয়ে কবির বিচিত্র অনুভূতি-অনুরাগের কয়েকটি পঙক্তি–
‘এই কবিতার জন্য আর কেউ নেই, শুধু তুমি নীরা
এ কবিতা মধ্যরাত্রে তোমার নিভৃত মুখ লক্ষ্য করে’
(নীরার জন্য কবিতার ভূমিকা)
‘ইচ্ছে করে তোমার দুঃখের সঙ্গে
আমার দুঃখ বেশি আদর করি
সমাজে কাঁথা সেলাই করা ব্যবহার তছনছ করে...
(নীরার দুঃখকে ছোঁয়া)
‘বুকের উপর রাখবো এই তৃষিত মুখ, উষ্ণশ্বাস হৃদয় ছোঁবে
এই সাধারণ সাধটুকু কি শৌখিনতা? ক্ষুধার্তের ভাতরুটি নয়?’
(নীরার কাছে)
‘নীরা’কে নিয়ে এই বিচিত্র আকাঙ্ক্ষা-মান-অভিমান-বিষাদ এমনকি জীবনের অনেক পথ হাঁটার প্রত্যয় উচ্চারণ করে সুনীল পাঠকের কাছে প্রেমের কবিতার নতুনতর আবেদন সৃষ্টি করেছেন। প্রেমের প্রতিমা রূপে জীবনব্যাপী নীরার উপস্থিতি লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা জাগে নীরার উৎস কোথায়? ‘অর্ধেক জীবন’ আত্মচরিত গ্রন্থে সুনীল অপর্ণা নাম্নী এক কিশোরীর কথা বললেও নীরার উৎস কবির মনোভূমি এবং জীবনবোধে। একালের কবি মঞ্জুভাষ মিত্র লিখেছেনঃ
‘নীরার একটা বাস্তব মূল অবশ্যই ছিল কিন্তু কালক্রমে তাতে একাধিক নারীর সৌন্দর্যছায়া মিশে গেছে, নীরা লাবণ্যকে সমৃদ্ধ করেছে পৃথিবী ও জীবনযাপনের নানা সৌন্দর্য ও অভিজ্ঞতায়।’
তবে কবির বেঁচে থাকা ও বেঁচে যাওয়ার অন্তর্গূঢ় নাম– ‘নীরা’। নীরা কবির কাছে সংগ্রামেরও অন্য নাম– ‘মনে হয় নশ্বরতার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে নেমে পড়ি / তোমার বাদামি মুষ্টিতে গুঁজে দিই স্বর্গের পতাকা’– তখন ‘নীরা’ হয়ে যায় নৈতিকতা এবং জীবনজয়ের উজ্জীবনী মন্ত্র।
প্রসঙ্গত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রেমের কবিতায় যৌনতার বর্ণনায় কোনো কোনো সমালোচক তাঁকে অভিযুক্ত করেন। কিন্তু প্রেমকে রক্তমাংসের অনুভবে সৌন্দর্যময় করতে প্রেমের কবিতায় দেহের বর্ণনা আছে। কিন্তু দেহনির্ভর হলেও সুনীলের প্রেম যৌনসর্বস্য নয়। সুনীল প্রেমের কবিতায় অনায়াসে উচ্চারণ করেছেন–‘এ হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ, এ হাতে আমি কি কোনো পাপ করতে পারি?’ তখন যৌনতার তাপে উষ্ণ হলেও কবির অকপট আত্মকথনে প্রেমের অন্যতর ব্যঞ্জনাই শিল্পিত হয়।
আধুনিক কবিতায় নগরজীবনকে প্রথম প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন কবি শার্ল বোদলেয়ার। প্যারিস শহরের ক্লান্তি ও অবক্ষয় তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। বোদলেয়ার থেকে বাংলা কবিতায় নাগরিক কবি বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, জীবনানন্দ দাশের কাব্যচর্চায় সঞ্চারিত হয়েছিল– নগরজীবনের ক্লেদ-গ্লানি, কুশ্রীতা এবং সৌন্দর্য। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই পরম্পরাকেই কাব্যায়িত করেছেন–‘স্মৃতির শহর’ কাব্যগ্রন্থে। এ কাব্যের পেক্ষাপটে কলকাতা শহর শরীরী প্রতিমা লাভ করেছে। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরের ভূমিপুত্র সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অল্প বয়সেই কলকাতায় আসেন। দেশভাগের পূর্ব থেকেই তাঁর পিতা কর্মসূত্রে কলকাতায় ছিলেন। সেই আশ্রয়েই সুনীল কলকাতার নাগরিক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সুনীলকে বিশেষ আন্দোলিত করেছিল। ‘আমার স্বপ্ন’ কাব্যের কয়েকটি কবিতায় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী কীভাবে বাংলাদেশের মানুষের উপর অত্যাচার করেছে তার কাব্যিক প্রতিক্রিয়া আছে। এই সব কবিতা অনিবার্যভাবেই সুনীলের দেশ সচেতনতার শিল্পভাষা। মনে রাখতে হবে কবি ‘অর্ধেক জীবন’ গ্রন্থে বিবৃতি-বর্ণনায় যে সময় ও সমাজের কথা বলেছেন তারই অন্যরূপ এই সব কবিতা। শুধু চিত্র বা বিবৃতি নয় ‘আমার স্বপ্ন’ কাব্যের কবিতাগুলিতে সুনীলের কবিহৃদয়ের বেদনার স্বর সততই প্রকাশিত। যেমন–
‘শিয়ালদার ফুটপাতে বসে আছেন আমার ধাইমা
দুটো হাত সামনে পেতে রাখা,
ঠোঁট নড়ে উঠছে মাঝে মাঝে
যে কেউ ভাববে দিনকানা এক হেঁজিপেজি বাহাত্তুরে রিফিউজি বুড়ি।’
(ধাত্রী)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার জনপ্রিয়তা আজ প্রশ্নাতীত। ‘কৃত্তিবাস’ সম্পাদনায় তরুণ কবিদের সঙ্গে, তরুণদের কবিতার সঙ্গে যোগাযোগ সূত্রে তাঁর সৃষ্টিশীল উপস্থিতি প্রসারিত হয়েছে ক্রমশ। কিন্তু সুনীলের কাব্য-কবিতার গ্রহণযোগ্যতার বড় কারণ, কবিতার প্রেক্ষাপটে কবির নতুন কণ্ঠস্বর এবং উপস্থাপনার নিজস্বতা। জীবনানন্দের লেখনীতে রবীন্দ্রপরবর্তী যে আধুনিকতা কাব্যায়িত, সেই পরিমণ্ডলে অবস্থান করেও সুনীল তাঁর নিজের কবিতার আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং উচ্চশ্রেণীর কল্পনা এবং দুর্বার আবেগ সঙ্গী করে হয়ে উঠেছেন স্বতন্ত্র রূপরীতির নির্মাতা।
আধুনিক কাব্য আন্দোলনের ইতিহাসে ‘Some Imagist Poets’ নামক কাব্য সংকলনের ভূমিকায় আধুনিক সময়ের কবিতার রূপরীতি সম্পর্কে মূল্যবান নির্দেশ ছিলঃ
‘To us the language of the common speech’,
‘ To create new rhymes–as the expression of new moods’,
‘To allow absolute freedom in the choice of subject’,
‘To present an image’–
কবিতার ভাষায় মুখের কথাকে ব্যবহার করতে হবে, সঠিক শব্দটি চাই, শব্দ নিছক কারুকার্যখচিত হলে চলবে না, ভাব প্রকাশের জন্য নতুন ছন্দ আবিষ্কার করে নিতে হবে এবং বিষয়ে নির্বাচনে কবির পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে– কবিতার রূপরীতির এই বৈশিষ্ট্যগুলি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় আন্তরিকভাবেই প্রকাশিত হয়েছে।
শব্দের সন্ধানে নিরন্তর ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেই সুনীল তাঁর কবিতায় মুখের ভাষাকে ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সার্থকভাবে। বাইরের দিক থেকে দেখলে বোঝাই যাবে না সে পরীক্ষায় তিনি কতখানি কঠিন তপস্যা করেছেন। একটি সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে কবি জানিয়েছেনঃ
‘আমি মুখের ভাষাতে কবিতা লেখার পক্ষপাতী। কবিতার কোনো নিজস্ব ভাষা নেই। সব দেশে মানুষের কল্পিত দেবতার রচনার রহস্য ও ব্যঞ্জনা ফুটলেই তা কবিতা হয়ে ওঠে।’
সুনীলের কবিতার সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে ভাব ও ভাষার পরিমিতিবোধ। পাঠককে মুগ্ধ করে তাঁর ভাষার সাধারণ রীতি। অপরিচিত শব্দ ব্যবহারে কবিতাকে কখনই ভারাক্রান্ত করেননি সুনীল। ভাষারীতি ও শব্দ ব্যবহারে সহজেই সুনীলের কবিতা আইডেনটিটি পেয়ে যায়।
‘রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের প্রতিমা
এ যেন আলোর শস্য’
এমন রোমান্টিক শব্দবন্ধ সুনীলের কবিতাকে সহজেই পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়। শব্দ ব্যবহারে সুনীলের নিকট বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন। লোকজ, গ্রাম্য শব্দ যা অপরিচিত তা তন্ন তন্ন করে খুঁজে কবিতায় ব্যবহার করেছেন শক্তি। সুনীল ঠিক ততখানি লোকজ শব্দের অনুসন্ধানী না হলেও তাঁর কবিতায় যত্রতত্র দেশজ শব্দ শিল্পময় হয়েছে।
কবিতার অবয়বে গল্প বা আখ্যান গড়ে তোলার নিপুণতাও সুনীলের কাব্যবৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’ কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতায় এই আখ্যান রচনা আমাদের আকৃষ্ট করে। শুধু একটি কাব্য নয় সুনীলের বিভিন্ন পর্যায়ের কাব্যেরই এমন পদ্য গদ্যের সংমিশ্রণ আছে। ছন্দের পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেও সুনীলের কবি লেখনী সফল। দলবৃত্ত, মিশ্র কলাবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্তের প্রচলিত বিন্যাসে তিনি সাধ্যমত নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন। তাঁর ছন্দ সম্পর্কীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা অবশ্যই স্বতন্ত্র আলোচনার অপেক্ষা রাখে। সর্বোপরি প্রাত্যহিক ও ক্ষণকালের জীবনযাপনের বিচিত্র অনুষঙ্গ থেকে চিরকালের কবিতা সৃষ্টির রহস্য কবি সুনীলের অজানা ছিল না। সেখানেই তাঁর কবিতার রূপসিদ্ধির সার্থকতা।