লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল এর গুচ্ছ কবিতা
নাভিপদ্ম
ঈশান কোনে মাথা রেখে পরিশুদ্ধ বাতাস চেয়েছিলাম
বিছানার কাছে এগিয়ে আসে জানালা - এই ভাঁজময় কানে কেবল পতঙ্গের অস্ফুট পাখার শব্দ - কার যে হাতছানি - ঝিঁঝিঁ প্রলাপের সাথে রেলিঙের মরিচা খসে পড়ে - টান পড়ে চাঁদের তোরঙ্গে -
চোখ বন্ধ করে কপালকে করি সাদা পাতা - ঢেউ আছাড় খাচ্ছে ধর্মপোতায়
আয় , নীরবতা নিয়ে যা -
কবিতার বইগুলো উইপোকা খায় - সূচিপত্র নিয়ে গান বাঁধে ঝরাপাতা , উদাসীন সন্ধের পাশে অপলক চোখ - চলে যায় পাখিদের শান্ত চলাচল - বৃক্ষেরা ঝুঁকে আছে নিঃসঙ্গতার দিকে, তার চারদিকে ডুবে যাচ্ছে ঈশ্বর
নাভিতে আলো রাখা দায় ; আমি আকাশ হয়ে যাই
প্রান্তিক
কুয়াশা চুমুক দিতেই পায়ের নিচে ক্ষয়ে যায় ঘুম ঘুম জলাশয়
যদিও সর্দি কাশি বাড়তে বাড়তে বাতিল কাগজে বেড়ে যায় ডোবার পরিধি , ব্যতিব্যস্ত চাতক প্রাণে জেগে উঠে ভরা স্নানের জল , পাকে পাকে নিচে দূরে বিনম্র পাপবোধ - শেষ রাতের গোপন হোমাগ্নি
পদ্মপারের সকালকে মুক্ত করতে চাই প্রাণপণ
আলোর শুরুতেই এত বিপত্তি ! ধূসর রাস্তার বুকে চুপি চুপি এঁকে দেয় দেবী আরাধনার ভরাট ধান শিষ - তার বাঁকেই আমার প্রান্তিক ভূমি ; উজানের সম্মূখে অগ্রসর হতে হতে প্রহরে প্রহরে ঘন নীলাক্ত ললাট
দেখা মিলল চন্দন গাছের - উন্মোচনে বিভোর নিভৃত চাষাবাদ
চিবুকে খেলা করে সকল অহংকার
প্লেটোনিক
এর সাথে রাষ্ট্রনীতির কোন সম্পর্কই নেই
বীজতলার কাদা মাখামাখিতে স্বেদকণা , লোমকূপে জেগে উঠছে শালুকের তীব্রতা - জমে উঠেছে নিঃশব্দ তরঙ্গমালা , গড়িয়ে চলা এক নদী ! ক্রমশ পাখি হয়ে যায় নারী ও পুরুষ -
কোন কারুচিত্রের অমেয় প্রহর
দূরে বিষ্ণুপুরের ভাঙা রাস্তায় ট্রাক বোঝাই মদ আসে - আসে ইনসুলিন , কার্বনের চুম্বনে বেয়াড়া বাতাস । তৃতীয় বিশ্বের স্বাপদ পেরিয়ে আগাছা বাছে , জল আটকাতে চায় নারীটি পুরুষটি - বাঁধতে চায় বৃষ্টিপাতের দিনক্ষণ -
আমরা মাটিতে থাকি - তাহলে আমরাই তারা ; জেগে থাকি বিস্তৃত রোদ্দুর -
সকলপ্রাণ
অস্তিত্বের শব্দগুলো জ্যোৎস্না হচ্ছে সকালেও
মাঝে মাঝে পাখিগানের শরীর বেয়ে আস ব্রহ্মনাদ - অন্তঃপুরুষের আখ্যান থেকে উঠে আসে স্নিগ্ধসাঁতার, তরঙ্গ ভেঙে ভেঙে আমি ধরা পড়ছি নিজের কাছে । সামনে খোলা জানালা - জানালার পাল্লায় মাকড়সার ফাঁদ - তার নিচে জল - চোখে লাগছে সূর্যের প্রতিফলন - মাছগুলি খেলা করে
মাছ মানেই স্বপ্ন ; মৃদু শীতল বাতাস
অখণ্ড মহাদেশের আঁশটে গন্ধের পানাপুকুর - পদ্ম ফুটলে আবার নাও ফুটলেও জানালার কাছে নিরুচ্ছ্বাস সংক্রমণ , তাকিয়ে তাকিয়ে গান বাজাই - 'জাগরণে যায় বিভাবরী -’
ভেতরের কয়েকটা আমি খালি গা দেখেই বেরিয়ে আসে লোমকূপ বেয়ে , বুকে বাজে ঠাকুরঘর - ধূপ পোড়ে - দশমুখি নদীতে একটা সবুজ পাতা ভেসে যায় বহুত্বে -
নিবেদন
প্রহর ভাঙার পর চাঁদ ফিরে এলে শেয়ালের ডাক থেমে যায়
সব দেখে পৃথিবী - শব্দগুলো কোলাহল হয়ে উঠে , বেরিয়ে আসতে চায় শরীরের সমস্ত চামড়া ছিঁড়ে , জলের সীমানা ঘেঁষে অবিরাম হেঁটে যাওয়া দেখে ভেবেছি - চাঁদ নিয়ে কী করা যায় --
বিছানা থেকে অন্ধকার তুলে এনে মাটিতে বসালে মাটিও ভোর খোঁজে , আমার কম্পন দেখে নিও - অনুচ্চ ভিটের ধারে কতদূর শিউলীর টুপটাপ - কতদূর ভোর ? দেয়ালের কাছে অবিশ্রাম রেখে যাই আদিম বিভূতি , ফোটে বারমাস্যা ফুল - শর্মিলা পিসির ঘর থেকে নদীর মহড়া শুনে নিই
শেয়াল ছুটে, কুুকুরও তার পেছনে , অনন্তের বনে ঘুরে ভিজে যায় নিবেদন স্বর
অন্তর্গত
ফাঁকামাঠের স্থিরতার ধারে শিশিরে আলপথ দিয়ে বাতাস হাঁটে সারারাত
ধূসর আলোর সঙ্গমে ধানকাটা সারির ভেতর একঝাঁক জোনাকি উড়ে যায় , মাঠ পেরিয়ে মাঠ - কিছুতেই ফুরোয় না দহন সাজানো শ্যামা ঘাসের চাষিপথ , দিগন্তে গাছের পাহাড়গুলিও সরে যায় দূর থেকে দূরে , আশ্রয়হীন রাতের ব্যর্থতায় মাটিরঙের উজ্জ্বল যৌবনও আলো
গন্ধঋতুর অধিকার উতল ; নাভিতে নেমে আসে নির্মল ধানক্ষেত
অন্তরা তখনও ঘুমে অচেতন । দরজার এপারে নিশ্বাস পড়ে হিম ভবিষ্যতে - চুপি চুপি ক্ষয়লাগা ঘরে উঠে আসে চাঁদ - আহত হিমচাঁপায় সমর্পণের জল
আউস
আউসকাটা রমনীর কোমরে দা গোঁজা , লেপটে থাকা
ভেজা শাড়ির চাহিদায় অর্কিড লতার অবিরাম বৃষ্টি -
নীলিম চোখদুটিও নিঃশব্দে ভরে যায় শেকড় বাকড়ে ।
আলোর ভিতর লুকিয়ে থাকা শষ্যদানা আমন্ত্রনী সুরে
আস্ত একটা পৃথিবীর মানচিত্র - এবং কৃষি প্রধান দেশের
জল স্থলের সমাহার । অতঃপর ভাতের উৎসে ভূমন্ডল
জলের পরিমান তিন ভাগের একটু বেশি ; দীর্ঘ স্তোত্রগানে
দা' য়ের ধার ক্ষয়ে আরও চকচকে আরও ধারালো -
সেই তাপে বরফ গলে বাড়ে সমুদ্র - মাঠের ক্ষুধা বেড়ে যায় ।
বেড়ে যায় জলধারণ ক্ষমতা - পাশেই রুগ্ন আলপথ
পা ছুঁয়ে থাকে সবুজ কামনা -
সেই নিশ্বাসরেখা অনুসরণ করে একাকী বলরাম
কৃষ্ণপক্ষ
মাটির আলো কমে যাবার পর চোখ বন্ধ হতেই ধ্যানে গেলাম আমি ; ঘনঘোর বৃষ্টিপাতে কপালে ঠাণ্ডা বাতাস - নেমে আসে পাখির ডাক আর ফুলের পাঁপড়ি , শুনতে পাচ্ছি আমারই নিশ্বাসের শব্দ , টের পাচ্ছি বজ্রহীন বুকের ওঠানামা , মহাকাশের নক্ষত্র ছুটে আসছে চোখের ভিতর - মুহূর্তে ধাক্কা খেয়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ফুলঝুরি ফুলঝুরি -
ইচ্ছে থাকলে আকাশ দেখা যায় - উজ্জ্বল গ্রহরা ঘোরে বনবন , বিছিয়ে দেয় মাঠ - তারই শরীর জুড়ে ধান রুয়ে দাদু বাবা কাকা - ঘাম গন্ধের সাথে সূর্যকে ঘিরে রাখে ঝিঁঝিঁপথ , বাঁশপাতা কাঁপে - শেয়ালের ধূর্ততায় কেঁপে ওঠে ঝোপঝাড়
মাটির ভিতর সুগোপন স্বদেশ রেখে কেন চলে যাও তোমরা - নাকি এজল এ বৃক্ষ কেবলই স্রোত - হিঞ্চা শাকের ক্ষেতে তোমাদের পালিয়ে যাওয়া আঁকছি দাদু - তোমাদের রোদে কাঁপছি ঠাকুমা -
কেমন মাঠ কমে আসছে আজ !
মুম্বাই থেকে ফিরে এসে ব্যাগ তৈরির কারকানা করছে অমল কাকু । শরীরে ভাইরাস , সঙ্গম করছে - ছুঁ-কিৎকিৎ খেলছে - আর গ্রাস করছে , মদন দাদু জমি বিক্রি করার পরে অন্ধকার থেকে বের হয়নি এক পক্ষকাল - পুঁইডাঁটা লতিয়ে লতিয়ে উঠে গেছে টালির চালায় , নদীচরে গড়ে ওঠা কারখানার ধোঁয়া ঢুকে পড়ে জানালায় , বিছানায় ছাই , চামড়ায় ছাই - সমস্ত শরীরে চিমনির ক্ষত -
আমরা নন্দী ভৃঙ্গী সেকচকে গঙ্গার দোকানে বসি, গ্লাসে ঢালি কান্ট্রি : রঙের পিঠে লাগাই ডানা - হাঙ্গামা হাঙ্গামায় মুখ থুবড়ে পড়ি কপালেশ্বরীর কাদায়
ঘোর কাটে না , কাটাতেও চাই না
তবু সাঁকো তৈরি হয় - পাতালে তার ভিত
আমি রেলিং ধরে পার হতে থাকি এপারের সন্ধে নামার শব্দে
অভিযাত্রা
বনসাই সময়ের মেঘলা জানালায় বসে আছে একজোড়া শালিক।চকিত চাহনিতে দেখতে চায় আত্ম নিবেদনের অন্দরকাল। যদিওবাগানে একটিও চারাগাছ লাগানো হয়নি, মাটির সরসহীনে মৃত-ঘাসের গন্ধ
তারের জালে কালো আলকাতারায় পিছলায় রোদ- কয়েক গুচ্ছ চাকা গড়িয়ে যায় খালবিলের স্নিগ্ধতার উপর, সাত সমুদ্র সাতটি আকাশ দেখার জন্য দিয়েছি দে ছুট , ভেঙচি কাটতে কাটতে শালিক দুটো উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে ,গায়ে হাতে পায়ে ছুঁয়ে দিয়েছে রক্তপ্রবাহ । কাকের জনন নিয়ে ভাবতেই জানালা গলতে গলতে হয়ে যায় নদী, এ আকাশ ও আকাশ নদীগুলি হয়ে যায় সমুদ্দুর , বেনামি পূর্ণিমার ডায়াবেটিসে সাঁঝরাত পিছলে জরুরী হয়ে ওঠে আত্মহত্যা - খুন করার অভিমুখ পাল্টে যায়-
কিছুতেই বোঝা যায় না কতটা পোশাক খুললে উলঙ্গ হওয়া যায়। আমি সময় সাক্ষী রেখে প্রত্যেক নদী ও মাঠের শব্দ শুনি; ঘাস পাতা ধুলোমাটির দেশে ছড়িয়ে থাকে প্লাসটিক চুড়ি , শাঁখা পলা আর জ্যৈষ্ঠা নক্ষত্রের ভূমি উৎসবে শরীর পোড়াই , সুদীর্ঘ রাত শেষে পড়ে থাকে আমারই ধানক্ষেত, কোথাও সন্ধ্যাহ্নিকে ঠাকুমার মৃত্যুশয্যা - খুব কাছের শ্বাস মাটিময় ধারকের মতো অপেক্ষা করে মিশে যাওয়ার। কুন্দ ফুলের ঠোঁট চুইয়ে আসা ক্ষত আটকাতে পারিনি - অগুন্তি শাখাপ্রশাখার ভারে নত মস্তক, দাঁড়িয়ে আছি চিরকাল , জানতে চাইনি কিভাবে মহব্বতের গান গায় অনিচ্ছুক ভিখারি--
জীবন এক জার্নি ; অভিযাত্রা । সেই শরীরে মাংসের ভেতর থরথর কেঁপে ওঠে স্খলন; মৃত্যুযন্ত্রণা - সত্য বই মিথ্যার মোরগ ঝুটি থেকে আকাশে লটকে থাকা চাঁদের ভাতপাখি, নাকি শ্বাস থেকে ঘুসের দূরত্বে মিশিং ডাইরির কোন কিনারা হবে না--
নিহত হতে চাই না কোনদিন। আমার যেটুকু মোরাম ছিল তাকে দীর্ঘশ্বাসের কাছে দাঁড় করিয়েছে কামুকের প্রচণ্ড চাকা। কাদাপায়ে পরজন্মের মাঠে জোয়াল কাঁধে হাঁটছি, জাগিয়ে রাখতে অনন্ত সূর্যকে- আর শরীর ঢালছি মাটিতেই : মায়ের স্নেহে--
জোড়া শালিক বসবে কবে , আমার শরীরে
বন্দিশ
পলাশকে প্রচ্ছদ করেছে মেয়েটি , চড়াই পেরিয়ে বার বার সালংকারা আর বর্ণাঢ্য করার কোলাহলে বন্দিশ পোড়ায় অরণ্যের গাছতলা
চারপাশে তৃষ্ণারা জড়িয়ে ধরছে মাটি। হাওয়া স্রোতে ঝোপ ঝোপ ঘরগুলি আজন্ম নতজানু , নিঃসঙ্গ বিবেক দাঁড়িয়ে থাকে দয়িত মধ্যাহ্নে। ভাসে প্রমাদহীন জলকনা , এখনো অনন্ত বিভোর আলিঙ্গন ! অন্ধকার নেমে আসার পূর্বে চুম্বন উড়িয়ে দেয় আকাশে--
ইচ্ছে করে পাতা উল্টাই , রাস্তার ধারে ভ্রমরের অস্থির মোহে দেখা দিচ্ছে ভাঙা ভাঙা শব্দের ক্রমাগত বিষ্ময় , আমার অহংকারে মাটির বর্ণ - এক একটা বাঁকের মুখে অনুরাগের শরাঘাত , আলপথের শরীরে প্রচ্ছায়া -ইহকাল পরকালে পার হই নৈবেদ্যর ঘন অবসাদ -
তারপর উঠে দাঁড়ানো , প্রজাপতির হিসেব নিয়ে রোদ ঘিরে ধরি । পুরোনো স্বভাবের মোটা চালের ভাত আর উন্মুক্ত লোমশ অন্ধিসন্ধির ভেরেন্ডা ফুলের অপমান গুলোকে গুঁজে দিতে থাকি তারি ভাঙনকালের ভাঁজে ভাঁজে--
গোপন থাকেনা কিছুই; রাতের কান্নাগুলো নগ্ন হয়, পান করে অগুন্তি ফাঁকের উজ্জ্বল শৃঙ্গার---৷