ছায়াবৃত্ত
আমাদের স্টেশন ফাঁকা হলে
একটি ছায়াবৃত্ত নামে।
পারস্পরিক বেড়াল আর মাছের গন্ধে
পাড়া ভরে যায় ।
কে কাকে শুঁকবে? সবারই ভেজা ভেজা শরীর
শরীরে আগুন জন্ম, শরীরে পাতাল ।
চুপচাপ স্টেশন ,মৎস্যগন্ধার পিছল শরীর থেকে
আলো আসে। ছায়াবৃত্তের ক্যানভাস দীর্ঘ হয়।
যেন সেই নৌকা । নৌকায় বোধি। বোধির ভেতরে কাম।
ছায়াবৃত্ত কেঁপে ওঠে। ফাঁকা স্টেশন।
ওর জন্য
ভালবাসতে ইচ্ছে হয়
ঘর থেকে মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়াই
এই রাস্তা জানে সব
ওর কুমারীবেলার চলাফেরা, সিঁদুর উৎসব ।
রাস্তার ধুলো জানে
কোন্ হাঁটায় অনুরাগ ঝরে
কোন্ হাঁটায় শুধু ক্রোধ গড়িয়ে নামে ।
এই রাস্তায় এসে দাঁড়াই
ওর পদধ্বনি খুঁজি
জলীয় বাষ্পের মতো গরম নিঃশ্বাস।
বহুদিন পর বৃষ্টি হয় যদি, হোক
ওর বুকের মতন দেখি ওঠানামা মেঘ।
কুহকবাগান
নষ্ট মুহূর্তগুলি পাথরের হৃদপিন্ডে আঁকো
আমরা দূর্বাঘাসের চোখে নরম সকাল দেখি
বিবাহসভায় ভরে উঠুক কুয়াশার গান
মৃত পাখির আত্মারা ফিরে আসবে
ভরে উঠবে সভ্যতার কুহকবাগান ।
নাভি পর্যন্ত ডুবে থাকা হলুদ কন্যারা
আজকেও পোশাক পরেনি
পোশাকে কি ঢাকা যায় দেহ ?
জলের রমণে ভাসে চর্চিত কাম
মেয়েরা কুড়িয়ে নিচ্ছে নিবিষ্ট সঙ্গম।
কালোবেড়ালের দল
জাতের নাম ধরে চোখ তুলে নিচ্ছে
অন্ধকারের সঙ্গে থাকতে বলছে ওরা
ভাগ করে দিচ্ছে কাঁটাতারে
তারপর বসাচ্ছি পাহারা ।
এখন কোথাও যাবার নেই
দুঃখগুলি সেঁকে নিয়ে দু-বেলাই
চলে খাওয়া-দাওয়া ;
কার্যত বিপন্ন যোগাযোগ
বুটের শব্দে ভারী হয় হাওয়া।
সাদা পায়রার দল ওডে নিকটে কোথাও
আকাশে বৃষ্টির রেখা জ্বলে
গল্পগুলি মরীচিকা হলে
কালোবেড়ালের দল নামে।
পলাশ ফোটার শব্দ
দেখি পলাশের মতো সবাই ফুটছে
বসন্ত এলো নাকি?
দূরে দাঁড়িয়ে আছি। এই বাতাসে
ফুটে উঠব, ফুটে উঠব মনে হচ্ছে।
পলাশ ফুলের রঙের মতোই আমার
হৃৎপিণ্ড। স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি।
রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। একটা
পাখি ও ডাকছে না। শুধু ডানা ঝাপটানোর
শব্দ পাচ্ছি। আর ফুল ফোটানোর শব্দ ।
হৃৎপিণ্ড ফেটে পড়ার শব্দ ।
মাথার ওপর কতকগুলো কাক উড়ছে ।
আমার দুটো চোখই উপড়ে নেবে বলে।
কসাইবাজার
একটু নিচু হই। দীনহীন তবু ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই।
কিছুটা স্বভাব ধর্মে সামাজিক।
কিছুটা বাঁচার বিকল্প পথ।
আরও একটু নিচু হই। যাকে সবাই আলো বলে জানে ।
আমি তাকে আলোকেই রাখি।
কেননা মিথ্যে আলো একটা মিথ্যার পাশে মানায়।
বরং আমার থাক অন্ধকার।
এখানে গরুর পা সেদ্ধ হয়।
ঝোল আর চর্বি সিক্ত মানব সমাজ।
এখানে ছুরিতে শান রোজ শুক্রবার।
এখানে রোজ কোলাহল ধর্মকেন্দ্রিক সমাচার।
আলো করে বসে রোজ কসাইবাজার।
আমার আত্মা
আমার মিহি আর নরম আত্মাকে
কোথায় লুকিয়ে রাখব ?
এখন পৃথিবীতে আমার কোনো বন্ধু নেই
ঘরের বউ পর্যন্ত ভাঙা ঘটের মতো
আমাকে ভাসায় ঘাটে ।
পরিবেশ এত জটিল হয়ে উঠছে
রাতের নির্জন তারা, নীল আকাশ,গাঁয়ের সবুজ ক্ষেত
সব ধোঁয়া আর রক্তে ভর্তি—
এদের কাছেও আত্মা থাকতে চাইছে না।
বন্যায় ভেসে ,আগুনে পুড়ে , বাতাসে উড়ে
চোখের জলের নুন খেয়ে
আমার সমস্ত দিন যায় —
কোথায় রেখে যাব ওকে?
চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে
কাঙালের অভাবী সংসার।
শিমুলপুর
যাঁকে খুঁজতে এসেছিলাম সে নেই
তাঁর খুলে রাখা শার্ট বাতাসে দুলছে
তাঁর পায়ের চপ্পল চুপচাপ অপেক্ষায় আছে
কেউ একটা কথাও বলছে না।
তাঁর বসার চেয়ার-টেবিল, লেখার কলম
মনে হচ্ছে কথা বলবে —
আর একটু অন্ধকার হলে
আমাদের কোনো গোপন কথা বলবে!
সত্যিই পৃথিবীতে কবিরা কি মরে যায়?
যশোরের সাগরদাঁড়ি তবে কেন জেগে ওঠে
বিনয় মজুমদারের ঘরে?
অথবা মধ্যরাতে কেন দেখা হয়ে যায়
জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে শক্তি চাটুজ্জের ?
আমরা ফিরে যাচ্ছি বনগাঁর শিমুলপুর থেকে
অজস্র পাখির ঝাঁকে বিনয় মজুমদারকে একা রেখে।
সাক্ষাৎকার
এক একটি শব্দ এসে বলে : তোমার জীবন দেখাও,
তোমার অভিজ্ঞতা…
তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়
জানালার গ্রিলে তাকাতে পারি না
ওপারে মাঠের কুয়াশায় নষ্ট শৈশব
আরও দূরে দ্রবীভূত শহর
পাথর ভাঙার শব্দে জেগে ওঠে।
এখন শব্দের কাছে এসে বসি
আর নির্জনের ভাষায় বিহঙ্গ যদি পাখা মেলে দেয়
আকাশে আকাশে তার নিভৃত ছায়ায়
নেমে আসে চাঁদ ।
পৃথিবী ক্লেদাক্ত হলে
বাঁচার রসদও ক্রমশ ফুরিয়ে যায়
তখন শব্দই মুদ্রিত করে মৃত্যু
একান্ত অন্তিম সাক্ষাৎকার।
সমুদ্রের গল্প
আমাদের সংসারটা ছোট্ট নৌকা
মা ভাসিয়ে দিয়েছে সমুদ্রে
বাবা মাঝি, দাঁড় টেনে টেনে নিয়ে চলেছে জলের উপরে
ঢেউ দিস না সমুদ্র, ঝড় দিস না আকাশ,
আমাদের কান্নাকাটি দেখে জলের মাছেরাও হাসে
কখনো কখনো রাতের শীতল চাঁদ ভেসে ওঠে জলে
আমরা ভাই-বোন মিলে ধরাধরি খেলি
বাবা দাঁড় টেনে ঘেমে যায়
শরীর চিকচিক করে ঘামে
মা আলোর ফুল তুলে সংসার সাজায় জলে
শরৎকাল এলে এক আয়নাওয়ালা আসে
আমরা ওর আয়নায় মুখ দেখে নিই
বোনটি লাল ফিতার জন্য কাঁদে
আমি ওকে সমুদ্রের গল্প বলি ,মাছরাঙার গল্প বলি
আমি ওকে স্বপ্নে রোজ কাঞ্চনমালার দেশে বেড়াতে নিয়ে যাই
মা
১
ঝাঁঝালো দুপুরে মায়ের চ্যালাকাঠ যখন পিঠে পড়ত
ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতাম দূরের গাছতলায়।
খিদে হজম হয়ে যেত , তবু বাঁশের ডালে কাক বসলে ফিরে আসতাম —
ঘরের উঠোনে এসে মায়ের কাছেই বলতাম : কই কী আছে দাও!
থালা-বাসন ছুঁড়ে ফেলে মা বলত, আমাকেই খা!
তারপর শুরু হত বাবাকে গালিপাড়া —
অনেক অনেক রাত অবধি কালী চলত।
কখন রাক্ষস-খোক্কসের পেটে ঘুমিয়ে যেতাম!
মা নিজে-নিজেই মাথায় জল ঢেলে ঠান্ডা হত।
কেমন করে রাতের তারাগুলো মায়ের মাথায়
ঢুকে যেত আর মাথা গরম করে দিত তাই ভাবতাম।
২
আজ আর মা নেই । কোনও কোনও নিশুতি রাতে
এখনও মনে হয় কেউ জল ঢালছে মাথায়….
বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যাচ্ছে….
মায়ের মৃতগলা স্পষ্ট বেজে উঠছে:
'এই খোকা ,ঘুমালি ! উঠে আয়,কচুশাক
সেদ্ধ হয়ে গেছে!...'
প্রাচীন সাপ
এক-একটি ফণার মতো মানুষের মুখ
গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে
ফণায় ফণায় দোলায় দংশন
দংশনে দংশনে বিষ
দুধভাত নিয়ে আসে কেউ
কেউ কেউ মনসা ভাসানের গান
আমরা নিশ্ছিদ্র বাসর বানাই
বাঁচুক আমাদের প্রিয় লখিন্দর
রাজপথে সভ্যতা হাটে
জানালার ফাঁকে ফাঁকে রোদ
ছাদের ওপরে মাথাভর্তি নীল আকাশ
তবুও প্রাচীন সব মাথার ভেতরে খেলা করে
ঝিকিমিকি সুন্দর বিষদাঁতে কী সুন্দর সূক্ষ্ম হাসি ঝরে
আমরা শুধু চুমু খেতে চাই
সরু মাজা পিছল শরীরে উচ্ছল চাঁদের আলোয়…