তন্ময় কোলে-র এক গুচ্ছ কবিতা
ধর্ম
আমাকে দাহ করা হবে আর আমার বন্ধু আসিফকে কবর।
আমাদের স্কুল এক ছিল, আমাদের কলেজ এক ছিল, আমাদের প্রথম প্রেমিকাও এক ছিল, আমরা দুজন এক থালাতে কত ভাত খেয়েছি, এক গ্লাসে জল।
এইসব ওরা জানেনা,
আমরা দুজনে পাশাপাশি থাকতে চেয়েছি,
দাহ হলে দুজনের নাভি ভেসে যেত একসাথে গঙ্গায় আর কবর হলে আমরা হাত ধরে থাকতাম।
ওরা এসব কিছুই জানেনা, ওরা জানে আমি হিন্দু , আসিফ মুসলিম।
প্রণামী
প্রতি শিক্ষকের ভেতর আছে এক পিতা
যে পথ দেখায় ঠিক- ভুলের, পার্থক্য বোঝায়।
সবাই আমারা ভাল ছাত্র হতে পারিনা,
কিন্ত ভাল মানুষ হবার পাঠ পাই।
জীবনে চলার পথে ছেলেবেলার
সেই পথ রাঙামাটির আঁকা,
ফিরে যেতে ইচ্ছা করে সেই পথে
আজ অনেকটা দূরে এসে আবার।
সেই ক্লাসরুম, খেলার মাঠ, লাইব্রেরীতে
পড়ে আছে জীবনের পদ্মপাতার জল
স্বচ্ছ- উজ্জ্বল কনার মতো।
জীবনে অন্ধকারে কখনও পথ হারালে
আলো দেখতে পাই শিক্ষকের ভেতর।
শিক্ষক তো বাবা মাও আমাদের,
বাবা- মাও শিক্ষক ।
দুখিনী বর্ণমালা
দুখিনী বর্ণমালা বড় কাঁদে
পূর্ণ হলনা বঙ্গের কথামালা।
ছিল যে বর্ণমালায় অমৃত রস
হল সে আজ এক ঘরে।
আসেনা কেউ, চেয়েও দেখেনা কেউ,
ব্যস্ত সব করতে বিদেশী পাঠোদ্ধার।
কচি কচি শিশুও পথ হারায় না,
দুদিনের অতিথি করে আনেনা ঘরে।
আমিও বেমানান শব্দের ঐশ্বর্যে,
ঈশ্বর প্রেরিত আমি, কে খবর রাখে?
সবাই আজও মাইকেল হতে চায়,
আমি যেন বঙ্গের বিধবা কূলবধূ।
কৌতুহল বশত করে কেউ বর্ণ পরিচয়,
কালাপানি'বলে পরদিন করে প্রায়শ্চিত্ত।
বঙ্গের সবুজ কাঁদে লুকিয়ে ঘরের কোনে,
সত মায়ে পায়না সে স্নেহের আদর।
করে সময়ে সময়ে আস্ফালন,
বেদুইন হয়ে ঘুরে বেড়াই,
ভুল করেও কেউ আনেনা সাথে।
অজ্ঞাত পরিচয় হয়ে থাকি শব গৃহে,
কান পেতে কেউ শোনেনি হৃদধ্বনি,
নিভৃতে কাঁদে শ্বাস।
মৃত্যুর চেয়েও সত্য
তখন আমি অনেক ছোট
মুচির ছেলেকে ছোটলোক বলে
দিয়েছি মন্দ কিছু গালি।
মা বলে- 'জাত বলে কিছু নেই,
আমরা আসলে সবাই মানুষ '।
আজ আমার একুশ
প্রেমে পড়লাম আমিনার।
মা বলে- 'ও বেজাত,
ঘরে তোলা যাবেনা"।
আমিনা নিল আমার আগে কবর,
আমিও যাব ভাবছি পেছন পেছন ।
কিন্ত আমিনার জান্নাত, আমার স্বর্গ,
কি করে হবে তবে আমাদের দেখা?
মৃত্যুর চেয়েও সত্য
আমাদের ধর্ম ।
বিশুদ্ধ বাতাস
কোথায় আবার পাবে সে বিশুদ্ধ বাতাস,
যে বাতাসে কথা বলত বিদ্রোহী সুভাষ।
পাওয়া যেত রবীন্দ্র নজরুল গীতি,
কোথায় হারালো সেই অমলিন স্মৃতি।
এই শহর বাতাসে নেই কোন সুর,
সব কথাই যেন ধারালো ক্ষুর।
সোনার গৌরাঙ্গ গায়না শান্তির গান,
যা কিছু ছিল শুভ হল অতি ম্লান।
যিশু আর বলে না তো শুধু ক্ষমা করো,
প্রতিবাদে প্রতিশোধ মারলেই পারো।
অসংখ্য সুকান্তের আজও ঝরে প্রাণ,
নজরুলের কলম লেখে কারাভাঙার গান।
গঙ্গার বিষ জল পান করে নীলকণ্ঠ,
ডাস্টবিনে পড়ে থাকে মনিষীর বীজমন্ত্র।
বিশুদ্ধ বাতাসের চলাচল চিরতরে বন্ধ,
প্রতি গৃহকোণে স্বজন- লোহিত গন্ধ।
আজ কোন বিলে হয়না বিবেকানন্দ,
প্রাণের বিশুদ্ধ বাতাস হয়েছে বড় মন্দ।
বঙ্গবন্ধু তোমাদের উপরেই সমস্ত আস্থা,
বাতাসে আবার ভাসবে শান্তি সুখের বার্তা।
ভারতবর্ষ
ভোরে কিনেছি তোর থেকে ফুলের মালা,
অফিসে গিয়ে উড়িয়েছি জাতীর পতাকা,
বলিষ্ঠ কন্ঠে দিয়েছি সভাপতি ভাষণ,
মনে হচ্ছিল নিজেকে নেতাজী, গান্ধী, শহীদ বিপ্লবী।
সন্ধ্যা নামে, পতাকা নামে ,
আমার গলায় হুইস্কির জল বাড়ে।
বাড়ি গিয়ে দেখি মাগী রাঁধেনি চিকেন,
শাড়িটা ছিঁড়ে চড় থাপ্পড় দিলাম কষে।
রাত বাড়ে, সকালের ফুলেশ্বরী বিছানা জুড়ে,
কিন্ত একি! তোর শরীরে কিসের ক্ষতচিহ্ন এত!!
নাভিতে রক্ত জমে, আর পিঠে কিসের ছাপ?
আমার স্বামীও বিপ্লবী তোমার মত, এ তারই ভালোবাসা।
বাড়ির বৌ, ফুলেশ্বরীর শরীর ভারতবর্ষ,
নাভিতে আঁকা যাদের অশোক স্তম্ভ।
বাইশে শ্রাবণ
আজ বাইশে শ্রাবণ
সেই মেয়েটারও মৃত্যু দিবস
যে নিজের জন্মদিবস জানত না।
তবু সে প্রতিবছর পঁচিশে বৈশাখে ফুল- বেলপাতা
দিয়ে জন্মদিবস পালন করেছে।
আজ সেই মেয়ের মৃত্যু দিবস
যার জন্ম দিবস পালন হয়নি কখনও।
প্রতিদিন জন্ম দিবস মনে করে
হ্যাপি বার্থ ডে বলেছে নিজেকে।
আজ বাইশে শ্রাবণ, প্রতিবছর
এইদিন সে কেঁদেছে, হয়ত
নিজের মৃত্যুর কান্নাটাও একসাথে।
হঠাৎ দেখা
বিনয় মনে পড়ে আমাদের ক্লাসে পড়া
রানু ঘোষ, রোল নম্বর ২৩।
এগারো বারো ছিল ক্লাসে,
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তোর আমার তাকিয়ে থাকা।
নবীন বরণে করেছিল 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ",
আমি শুয়েছি ওর সাথে রাতের স্বপ্নে,
ঘুম থেকে উঠে লুকিয়েছি নিজেকে।
পরে শুনেছি বিয়ে হয়ে গেছে ওর ,
তা অনেক বছর হল, ভুলে গেছি সব-ই।
আজ হঠাৎ সেই রানু ঘোষ কে পেলাম,
খুবই কাছে, রাতের স্বপ্নের থেকেও ।
সময় পেলে তুইও যাস,
হোটেল রাতের জোনাকি, রুম নাম্বার ২৩
অস্তিত্ব
ঘরের জানলার পর্দা কি নোংরা! বিচ্ছিরি ছেঁড়া! ঘরে প্যারাসিটামল গন্ধ, গায়ে ঘাম গন্ধ চাদর, যদি পিয়া আসে, দ্যাখে কি ভাববে? অসহ্য! অন্যদিন খেয়াল হয়নি এসব, মাথার উপর মাকড়শার ঝুল, দেওয়াল চটা রঙ আমার বারণ সত্বেও প্রেমের ধ্বংসাবশেষের কারণ খুঁজছে। দশ বারো বছর পর জ্বর এল, রাত থেকে জলপট্টি দিচ্ছে মা, যখন জ্বর এল সত্যি বলছি প্রথমে মনে পড়েনি তোমায় , শুধু মা-মা বলে চিৎকার করে মাকে ডেকেছি। মা অসমাপ্ত রান্না ফেলে মাথায় হাত দিয়েছে,তুমি এসব কিছুই জাননা, কালও যখন তোমার সাথে ঝগড়া হচ্ছে,আমি বোঝাচ্ছি তোমায়। মা ডাকছে ট্যাঙ্কে জল ভরতে, ঝড়- বৃষ্টি হবে।বলেছি- পারবনা করে নাও তুমি, ব্যস্ত থেকেছি হেডফোনেই সারাদিন। তুমি বলতে কাছে থাকলে আদর করবে, জ্বর এলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে, মনে হত এক্ষুনি জ্বর আসুক, তুমি আসবে আজ আমার জ্বর, পারদ উঁচু, কাছে মা বসে। তুমি নেই কোথাও ।
নবীন বরণ
এসেছে নবীন হে পুরাতন ছাড় ছাড় গৃহদ্বার,
নবীন এনেছে যুগ যুগান্তে বিপ্লব প্রতিবার।
মাঠের সোনার ফসল জানাচ্ছে স্বাগতম,
নবীন ভেবে ওদের করোনা ভ্রম।
ওরাই এনেছে স্বাধীনতার ভারোর আলো,
নির্ভিয়ে দিয়ে পরাধীন রাতের কালো।
তাই আজ মোরা করি ওদের সাদর বরণ,
নবীন কে বরণ করবে আজকের পুরাতন ।।
সঙ্গম শেষে
সঙ্গম শেষে তুমি অপেক্ষা করো আরো কিছুক্ষণ ,
নগ্ন শরীর যদি তখন ভালোবাসো
তবেই তুমি আমার প্রেমিক।
কিছু যন্ত্রণার কথা তোমাকে জানানোর আছে
যোনির যন্ত্রণা না, হৃদয়ের
কতজন তো এল, কেউ সঙ্গমের পর
চেয়ে দেখেনি নগ্ন শরীরে ক্ষতচিহ্নগুলো ,
সঙ্গম শেষে কেউ অপেক্ষা করেনি,
আমার কিছু কথা বলার ছিল।