আজ ধড়মড় করে উঠেই ঘড়ি দেখি। সর্বনাশ। সাড়ে সাতটা। পাড়ার মুদির দোকান বলেছিল সাতটায় রুটির গাড়ি আসবে! বাড়ির পোশাক পরেই বেরিয়ে পড়লাম দোকানটার উদ্দেশ্যে। দোকানে পৌছে দেখি আমার আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। পাঁউরুটির গাড়ি এসেছিল। আসা মাত্র রুটি বিক্রি হয়ে গেছে। আবার একদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। ওষুধের দোকানেও তিন নম্বরে নাম লেখানো আছে ডেটলের জন্য। দিনের মধ্যে একবার বের হই। তারপর ঘরে ফিরে ঘরবন্দি হয়ে ভাবতে থাকি কাল কি হবে? টিভি খুলে দেখি গতকালের স্কোর। না। এটা ফুটবল ক্রিকেট লনটেনিস নয়। এটা গতকাল কোন দেশে কতোজন করোনার প্রকোপে মারা গেছে তার হিসেব! ঘরের লোক নালিশ করে। কবে মল খুলবে, বাস চলবে। আমরা ঘরে বসে স্মৃতির পাতা ওলটাই। বেড়াতে যাবার গল্প করি। সেই গল্প চলতে চলতেই মনে পড়ে যায় আন্দামানের সেলুলার জেলের কথা। হঠাৎ ভাবি, যে লকডাউন মাত্র কুড়ি দিন কাটতে না কাটতেই আমাদের নাভিশ্বাস উঠেছে, সেই লকডাউন কীভাবে বছরের পর বছর বটুকেশ্বর দত্ত, যোগেন্দ্র শুক্লা, ফজল-এ-হক খৈরাবাদি, বিনায়ক দামোদর সাভারকার, বা ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর মতো শত শত বীর শহীদদের নিত্যসঙ্গী ছিল। আমার তাও ভোর ভোর রুটির খোঁজে বের হবার সুযোগ আছে। তাঁদের তো সে সুযোগও ছিল না। এক বালতি জল, এক টুকরো রুটি, আর ঘন্টার পর ঘন্টা তেলের ঘানি টানবার পরিশ্রম, অমান্যের সাজা বেইরি সাহেবের চাবুক অথবা ফাঁসির দড়ি। পালাবার পথ নেই। চারদিকে সমুদ্রর গর্জন। দূরে ঘন্টাঘর থেকে ভেসে আসছে ঢঙঢঙ শব্দ। তবু তাদের বুকের মধ্যে গুণগুণ করছে সেই অবিস্মরণীয় মহামন্ত্র। বন্দেমাতরম।
গল্প করতে করতে বেলা গড়ায়। দুপুরের খাওয়া হয় না আমাদের। ভাবতে থাকি, ভাগ্গিস করোনা এসেছিল। আবার নতুন করে যেন উপলব্ধি করতে পারলাম সেই সব মানুষের আত্মত্যাগ আর যন্ত্রণার কথা, যাঁদের রক্তবিন্দুর ইউএসবি তে আমরা আজ স্বাধীন ইচ্ছাতে ঘোরাফেরা করে চলেছি। হে ভারতের বীর সৈনিক। তোমাদের শতকোটি সেলাম। সকালে না পাওয়া রুটির দুঃখ লক্ষ করলাম ফিকে হয়ে এসেছে মনের মধ্যে। বরং এখন ভাবছি সেই মানুষটা, যে রোজ আমাদের ময়লা হাতে করে নিয়ে যায়, সে আর তার পরিবার আজ খেতে পারছে তো?