সুমন মহান্তি-র এক গুচ্ছ কবিতা
বন্ধুতা
সন্ধ্যাশহরে একা, সাক্ষী রাস্তার একমাত্র হ্যালোজেন আলো
নীরবতার সাথে যুদ্ধ নিরন্তর
পাশে বসার কেউ নেই
বৃত্তপরিধির বাইরে একে একে চলে গেছে বন্ধুরা
ভার্চুয়াল বন্ধুত্বও আসলে নিঃসঙ্গ আধার এক।
আকাশ বলল, আমার অসীমে এসো
রাতজাগা তারাদের বন্ধু করো
মেঘ বলল, আমার সাথে চলো
দল বেঁধে কীভাবে ভেসে যাই বুঝে দেখো
গাছ বলল, আমার শরীরে কত গল্প লেখা আছে
শুনতে শুনতে কেটে যাবে একাকীত্বের প্রহরগুলি।
আমার চাওয়া রক্তমাংসের মানুষ তার হৃদয়-উষ্ণতা
সুখ জেনে হাত বাড়াবে দুঃখ চিনে বসবে পাশে
আমার জন্য প্রতি বাঁকে যেন থাকে নিওন আলোর বন্ধুতা।
একবচনের বন্ধু নয়, বহুবচনে থাকব জীবন ভালোবেসে।
জলের কাছে
জলের কাছে এসেছ হে স্বপ্নান্ধ
অধরা স্রোতের রোমাঞ্চ পাবে বলে
জল বড় করুণাময়ী প্রশান্তি দিতে চায়
নামতে ভয় পাও দোলাচলে থাকো
ভাবো ঘূর্ণি নিয়ে যাবে কোন অতলে
ডুবেই তো আছ এতকাল
পাঁজরে শ্বাসকষ্ট টের পাও ঘন ঘন
শূন্যতার বুদবুদে ফুসফুস জমে যায়
এসেছ নির্জনে পিছুটান ভুলে
দ্বিধা ভুলে নিশ্চিন্তে নেমে যাও একবার
জলের ভিতর প্রাণিত শ্বাসকণা
গভীরে তার অভিমান ভালোবাসা
পরিপূর্ণ মিশে যাও শরীরে আত্মস্থ করো
জল বড় করুণাময়ী বুকে টেনে নেয়
অবগাহনের সুখ মাখো হে তুমুল আলোড়নে
আলোড়নে রোমাঞ্চ ফিরে পাবে ভুলে যাবে গ্লানিমুখ . . .
সাধের একতারা
পরোয়া করি না কল্পিত পুণ্যের
গৃহকোণ এবং এই জন্মশহর একমাত্র তীর্থ মেনেছি
লোভের কথা যদি বলো অবশিষ্ট কিছুই নেই
অন্তর্গত রক্তের স্রোত তুচ্ছ করেছে বিষয়-আশয়।
তবুও রন্ধ্রপথে আসে কামিনীফুলের বাসনা
গোপনে চেয়েছি বুকভাঙা ঝড়, আচম্বিতে আমূল কেঁপে ওঠা।
পাপ এবং লোভের শিকড় লতাগুল্ম হয়ে বাড়ছে ভিতরে
এবার তবে ভাঙনের লগ্ন এসে দাঁড়াল চুপিচুপি।
কোনও এক পুণ্যতোয়ার জলে অবগাহনে সমস্ত প্রশ্ন যাবে ভেসে
এই বিশ্বাস রাখি। উড়নচন্ডী বাতাস হতাশে ফিরে যাবে।
সমস্ত টান উপড়ে ফেলে ঘরমুখো হব দৃপ্তে
আজও সংসারের গান বাজে সাধের একতারায়, পাপ মরে যায় ভ্রণে
দৌড়
পাড়ায় পাড়ায় শূন্য রোয়াক
সামাজিকতার আলখাল্লা আস্তাকুঁড়ে আছে পড়ে
কেউ বুঁদ আফিম সিরিয়ালে কেউ স্মার্টফোনে
বাকিরা কেউ ধরতে ছুটেছে অগুণতি উড়ন্ত টাকা
হাওয়ায় টাকা ওড়ার খবর চাউর হয়েছে লোকমুখে
কেউ খুঁজছে শীর্ষে ওঠার অদৃশ্য এক হরিণসিঁড়ি
কেউ দৌড়চ্ছে সন্তান কাঁধে যোগ্য করার আশায়
ঈর্ষাকাতর চোখে বাকিদের মেপে নিচ্ছে প্রতিযোগী
তুমিও দৌড়ে শামিল হলে রাধাকান্ত, তুমিও ভোগবাদে!
চোখে তোমার আলো অমিল মুখে ঘন অতৃপ্তির ছায়া
তোমার সারা শরীরে অসুখের চিহ্ন প্রকট হচ্ছে ক্রমশ
বাকিদের মতন তুমিও নেশাগ্রস্ত, ধাওয়া করো অধরা
তোমার নিঃশ্বাসে বিষ, পার্থেনিয়াম রেণু এবং শ্বাসকষ্ট
পিছিয়ে পড়েছি ভেবে যতই করুণা আর বিদ্রুপ করো
জেনে রাখো সম্পূর্ণ স্বাধীন আমি কোথাও নই শৃঙ্খলিত
মাথার ওপরে নক্ষত্রেরা আজও ফুল হয়ে ফোটে
শরীরে আমার হাজার ফুলের সুগন্ধ মাখামাখি
বহতা নদী শ্রোতা ও বন্ধু হয় সূর্যাস্ত অপেরায়
কয়েদি হয়েই জীবন কাটাবে, রাধাকান্ত, ভেবে দেখো একবার . . .
এই এক অস্থিরতা
স্নায়ুকোষ জুড়ে আবার দাপাদাপি ফের নষ্ট হল স্থিতি
সে-ই কিশোরবেলা থেকে সঙ্গী এই দুর্বোধ্য অস্থিরতা
চিনতে দেয় না দিঘির শান্ত জল প্রিয় সূর্যাস্তের রাগ
পাঁজরে দুঃখ জমে চিনচিন ছলাৎ ছলাৎ সারাক্ষণ
যেন কোথাও যাবার ছিল দূরে কোনও উদাসপথে
বড্ড অবাধ্য, গোঁয়ার অবুঝ, কিছুতেই ভোলে না সে
ছেলেমানুষ তাকে ঘুম পাড়াব কোন ঘুমপাড়ানি গানে
ডুগডুগি বাজায় অবিরাম, বলে কোথাও নিয়ে চলো
সকাল ছন্নছাড়া দুপুর হাঁপিয়ে ওঠা কাকের কর্কশতা
সন্ধে এবং রাতগুলি করুণ, বিকেল বৃত্তে ঘুরে মরা
যতই মাথা খুঁড়ে মরি রেহাই অমিল প্রশান্তি দুরাশা
আমৃত্যু সঙ্গে থাকবে এমনই তার ধনুকভাঙা পণ
এই আমাকে প্রশান্ত করো, মানবী, সঘন আদরে রাখো।
খামের ঠিকানা
হাঁটুভাঙা থামে জমে আছে ঘননীল অন্ধকার
অনামিকা নীরবতা
গাছগুলি স্মৃতিধূসর, কোটরে লুকিয়ে রাখে
অর্ধেক জীবনের দুঃখশোক
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আহত ঘোড়ারা
যৌবনের স্তরে স্তরে শ্যাওলা
এখন এই মেঘলা বিকেলে
খামে ভরছি একে একে বার্ধক্যের আসন্ন চিহ্নগুলি
স্বপ্নহীন ঋতুবদল, পুরাতন অলিগলি, অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস
দীর্ঘ তালিকা মিলিয়ে নিচ্ছি হিসেবে
প্রাপ্তি যা-কিছু ছিল তা-ও ভরছি খামে
ভরেছি ভূতভৌরি প্রজাপতি ডানা, মিঠেকড়া শীতের রোদ
সোনাঝুরির পাপড়ি, বৃষ্টিভেজা দুপুর, স্বপ্নাচ্ছন্ন সন্ধে
কালো সেলোটেপে মুখবন্ধ এই খাম
কোথায় পাঠাব এই ডিজিটাল দশকে
তোমাকেই পাঠাব মনপলাশ অবেলার ঠিকানায়
প্রাপ্তিস্বীকার জানিয়ো ভেজা ঠোঁটে অদেখা অনুরাগে।
সাম্যের গান
যে-মানুষ স্বার্থে থাকে চিরকাল
যে-মানুষ দৌড়ে মরে আজীবন
শেষকালে জমি তারও সাড়ে তিন
ক্ষমতায় যে-মানুষ উন্মাদ চিরকাল
গর্বে যে-মানুষ ফেঁপে মরে আজীবন
শেষকালে জমি তারও সাড়ে তিন
যে-মানুষ সম্পদে বাঁচে চিরকাল
যে-মানুষ অভাবে মরে আজীবন
শেষকালে জমি তারও সাড়ে তিন।
পঞ্চাশ পেরোলে
শীর্ণ নদীটির বুকে কচুরিপানা ঘোলাজলে অবেলা
কিনারা থেকে ফিরে খোঁজো তাই স্বজনসুজন
তোমার জন্য কেউ রাখেনি ঘড়ির কাঁটায় চো
দরজাগুলি বন্ধ একে একে কেউ দেবে না সাড়া
প্রিয় মুখ যারা বদলেছে তারা কীভাবে কখন
ভাবতে ভাবতে ঝাপসা চোখ কুয়াশা চাদরে
সবাই ছুটছে আমি-তুমির সংসারে বাকি সব তুচ্ছ
এখনও তো নতুন করেই বাঁচতে চাও উত্তর-যৌবনে
সূর্যুমুখী আলোর দিনে সবান্ধবে স্বপ্নে যাও দিগন্তপুর
রক্তের ভিতর আলোড়ন প্রার্থনা করো দ্রিমি দ্রিমি দ্রাম
এখনও চাও অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ উচ্ছ্বাসে - আবেগে
বলগাহরিণ বা টগবগে ঘোড়া হতে সাধ আগের মতো
কিছুই হয় না শেষমেশ ক্লান্তপায়ে ফেরো পরাজিত
বুঝতে পারো কেউ নেই কেউ থাকবে না পাশাপাশি
তোমার অপেক্ষায় আছে শুধু চিরচেনা এক মুখ
এই বয়সে কোথাও যাওয়ার নেই সব গন্তব্য শেষ
থাকে শুধু একজন তার ছায়ানিবিড় পরম আশ্রয়
পঞ্চাশ পেরোলে প্রকৃত সহধর্মিনীর মর্ম বোঝে একাকী পুরুষ।
মানবাধিকার
হাড়িকাঠে এইমাত্র চড়ানো হল চর্মসার বৃদ্ধাকে
ধড় এবং মুন্ডু আলাদা করা হবে
বৃদ্ধা অপরাধ জানে না এখনও
নেকড়ে ও ঘোলাজলের অজুহাত চিরকালীন।
শিশুটিকেও ছুঁড়ে ফেলল আগুনের গোলায়
বাবা ও মা জীবন্ত পুড়ে মরেছে কিছুক্ষণ আগে
হত্যালীলা সেরে দল ফিরে গেল গোপন ডেরায়।
আগামীকাল এককোণে খবর বেরোবে কয়েক লাইনঃ
অসমের এক গ্রামে জঙ্গিদের হানা বলি দশজন।
শীতের দুপুরে প্রেসক্লাবে বক্তব্য রাখছেন মানবাধিকার নেতাঃ
জঙ্গিরাও মানুষ, চাই মানুষের অধিকার, নো এনকাউন্টার।
নির্ভয়ার চার ধর্ষকের শাস্তির পরেই প্রতিবাদে রাস্তায় দশজন
গলায় প্ল্যাকার্ড, লঙ্ঘিত হয়েছে নাকি মানবের অধিকার।
শিকার নয়, মানবের পরিবর্তে দানবের অধিকার চেয়ে
বারেবারে সোচ্চার হয় নখদন্তহীন কয়েকটি মানুষ
জঙ্গলমহলঃ ২০১০
আগুনখোর বিপ্লবীরা বলেন, ঘৃণা এক পবিত্র আবেগ
অতএব হত্যা আসলে ঘৃণার প্রকাশ।
ওরা পিছমোড়া করে বাঁধে, কুপিয়ে কুপিয়ে মারে
কেটে দেয় গলার নলি
মাঝরাতে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে
মুন্ডু কেটে ফেলে আগুনে পোড়ায় মাটির বাড়ি।
আট থেকে আশি সব্বাই আতঙ্কে বোঝে সারমর্ম
এই মুক্তাঞ্চলে হত্যাই নিয়ম, চর সন্দেহে মেরে ফেলা
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় বাহবা দিল কাগুজে বিপ্লবী।
রাতের পর রাত লাশ পড়ে থাক পথের ধারে
ছুঁতেও ভয়ে কাঁপে আত্মীয়-পরিজন
এখানে হত্যা নিতান্তই স্বাভাবিক
সুদিন আসছে ঐ, শান দাও টাঙিতে, নাগরিক কবিয়াল গিটারে।
হত্যা এক মামুলি খবর
লাশ নিয়ে মাথা ঘামাও কেন বুদ্ধু
হত্যার বিচিত্র শিল্প দেখো, লেখো ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের রক্তপাত।