মেদিনীপুরের রথযাত্রা ।। ভাস্করব্রত পতি
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। ধারে ভারে এগুলো বেশ কয়েক কদম এগিয়ে। তবে জেলার মধ্যে বিখ্যাত মহিষাদলের রথ, রঘুনাথ বাড়ির রথ, নাড়াজোলের রথ, বগড়ির রথ, মহাপ্রভু মন্দিরের রথ ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ছোট ছোট রথযাত্রার আয়োজন করা হয়।
এবছর ২২০ বছরে পা দিল মহিষাদলের রথযাত্রা। জাঁকজমক আর ঐতিহ্যকে পাথেয় করে আজও সমানভাবে চলছে এখানকার রথযাত্রা উৎসব। সর্ব ধর্মের সমন্বয়ে আজও মানুষের ভিড়ে টানা হয় রথের রশি। আম, কাঁঠাল, জিলিপি, মাদুর, পাখি আর চারাগাছে জমজমাট হয়ে ওঠে রথ প্রাঙ্গন। লক্ষাধিক মানুষের ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে ওঠে মহিষাদল। ১২১১ বঙ্গাব্দ তথা ১৮০৪ সালে মহিষাদলের রাণী জানকী দেবীর পোষ্য মতিলাল উপাধ্যায় (পাঁড়ে) রাজপদে অভিষিক্ত হন। তিনিই মহিষাদলের সতেরো চূড়ার রথ নির্মাণ করেন।
মহিষাদলের রমণীমোহন পঞ্চায়েত এলাকায় একশো বছর আগে জমিদার ভুবনচন্দ্র হাজরা শুরু করেছিলেন রথযাত্রা। এখন লোহার রথে বসেন রাধাকৃষ্ণ। দক্ষিণ কাশিমনগর ঠাঠারিবাড় থেকে কাউকুণ্ডু পর্যন্ত রথ টানা হয়। গুরুপূর্ণিমাতে মহিষাদলের রঙ্গীবসান থেকে টানা হয়পিতল ও কাঠের ২০ ফুট রথ। এটি ১৯৫৫ সালে স্বামী মুক্তানন্দজী চালু করেন। রাম মন্দিরের রাম, সীতা, লক্ষ্মণের অষ্টধাতুর মূর্তি রথে বসেন।
সুতাহাটা একতা পরিষদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে ৩৬ ফুট উঁচু রথ। ২০১৫ এর ১১ ই মে শুভারম্ভ হয়। ময়নার গোপালচক, পাঁশকুড়ার ধুলিয়াপুর, এগরার বালিঘাইয়ের রথ, নন্দকুমারের কোলসর, বরগোদা, চণ্ডীপুরের হবিচকে হয় রথযাত্রা। এগরার চৌধুরী বাড়ির তিনশো বছরের প্রাচীন। তমলুকের ডিমারির রথযাত্রাও ৫০০ বছরের প্রাচীন।
তমলুকের মহাপ্রভু মন্দিরের রথযাত্রাতে প্রথমে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রাকে স্নান করিয়ে ছাপান্ন ভোগ এবং ছত্রিশ ব্যাঞ্জন দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন করানো হয়। এরপর বিশ্রাম। বিকেলে রথে চড়ে নিয়ে যাওয়া হয় তমলুক রাজবাড়ির গুণ্ডিচাবাটিতে মাসির বাড়ি। আবার উল্টো রথে ফিরে আসেন। ১০১০ বঙ্গাব্দে খঞ্চিতে চক্রবর্তী পরিবারের মাঘী পূর্ণিমায় শুরু হয় ইয়ার রসিক রায় জীউর (রাধাকৃষ্ণ) রথযাত্রা। এখানে উল্টোরথ হয় আটদিন পরে।
কোলাঘাটের বাঁশদা গ্রামের মণ্ডল পরিবারের বৃন্দাবন জীউ দেবের রথযাত্রা ৩০০ বছরের পুরনো। শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের ২৫ - ৩০ টি গ্রামের মানুষ এখানে আসেন। কোলাঘাটের রাধামাধব জীউর মন্দিরের রথ প্রায় ২৫ বছর ধরে চলছে। মেছেদায় ইসকন মন্দিরের রথযাত্রা চলে নয়দিন ধরে।
পাঁশকুড়ার দক্ষিণ চাঁচিয়াড়া গ্রামে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ১৭২০ সালে চালু করেন কাশীজোড়া রাজবংশের রাজা জিৎ নারায়ণ রায়। এখানে মেলা চলে ১২ দিন ধরে। প্রায় ১৫ ফুট উঁচু রথ। পাঁশকুড়ার রঘুনাথবাড়ির রথযাত্রা হয় বিজয়া দশমী তিথিতে। এটি রঘুনাথ জীউর রথ। প্রায় ১৫ দিন ধরে মেলা চলে। এখানে আরেকটি রথ আছে। জগন্নাথ দেবের এই রথ আষাঢ়ে টানা হত। এখন পুরোপুরি বন্ধ।
রামনগর ২ ব্লকের মৈতনা পঞ্চায়েতের ডেমুরিয়ার জগন্নাথ দেবের রথ ৩০০ বছরের প্রাচীন। স্থানীয় জমিদার করুণাকরণ চৌধুরী এখানে জগন্নাথ দেবের মন্দির তৈরি করেন এবং রথযাত্রা চালু করেন। এটি হিন্দু মুসলমানদের সম্প্রীতির রথ। মেলা চলে দশ দিন ধরে। কাঁথি ২ ব্লকের মৈশামুণ্ডা গ্রামের পণ্ডাদের রথ প্রায়২৬৫ বছরের প্রাচীন। পুরীর জগন্নাথের মূর্তি গড়া শবর জাতির বংশধর যদুমনি জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি বানিয়েছে। কিশোরনগরের রাজা যাদব রাম রায়ের পরিবারের পক্ষ থেকে পণ্ডাদের দেওয়া হয় জগন্নাথ ঠাকুর এবং ১৩৭৭ বিঘা জমি। এখানে নেত্রোৎসব আয়োজিত হয়।
১৭১০ সালে শুরু হওয়া ঝাড়গ্রামের লালগড়ের সাহসরায় রাজ পরিবারের রথযাত্রাতে রাধামোহনের জন্য দিতে হয় পোস্ত বড়া সহ আট ধরনের ভাজা। একে বলে 'বাড়তি ভোগ'। এই রেওয়াজ চলছে ৩০০ বছর ধরে। এখানে রাধামোহন, শ্রীমতী এবং জগন্নাথের জন্য আতপ চালের এবং গোপীনাথ জীউ, গোবিন্দ জীউ, ধাম গৌরাঙ্গ ও সাক্ষীগোপালের জন্য সেদ্ধ চালের অন্নভোগ হয় রথের সময়। এখানে বাবু পাড়ার মন্দির থেকে সপার্ষদ রাধামোহনকে নিয়ে আসা হয় রথতলায়। সোনার অলঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে মাসি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। শ্রীপাট গোপীবল্লভপুরের রথ চালু হয় ১৬১৫ সালে। বৈষ্ণবাচার্য শ্যামানন্দ এবং তাঁর শিষ্য রসিকানন্দ এটি শুরু করেন। এখানে রথের দিনে রাধাগোবিন্দ জীউর মন্দির প্রাঙ্গন থেকে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার তিনটি রথ বের হয়।
কাঁথি ১ ব্লকের মহিষাগোটের উত্তর বহলিয়া গ্রামে মাঘী পূর্ণিমায় রথযাত্রা হয়। একে বলে 'মাঘীরথ'। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রীতি মেনে এখানে রথযাত্রা হয়। জনৈক নেত্র পণ্ডা এই রথযাত্রার সূচনা করেছিলেন। সাতদিন পরে হয় উল্টো রথ। কাঁথি ৩ ব্লকের বাহিরীতে ১৫৮৪ সালে পদ্মনাভ দাসের ছেলে বিভীষণ দাস জগন্নাথ মন্দির তৈরি করেন। কিন্তু সেখানে কোনো বিগ্রহ নেই। এখানে নেত্রোৎসবের পর রথযাত্রা হয়। কাঁথি শহরের আঠিলাগড়ি সেবাইতদের মন্দিরের জগন্নাথ দেবের রথ কাঁথি শহর পরিক্রমা করে। কাঁথি উপসংশোধনাগারের পিছনে ভারত সেবাশ্রম সংঘের রথ বেশ জাঁকজমকপূর্ণ হয়।
ঘাটালের খাঞ্জাপুরের রাধাবল্লভ জীউ মন্দিরের রথযাত্রার সূচনা করেন বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদের সভাপণ্ডিত ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপক পেলারাম ন্যায়ভূষণ চক্রবর্তী। এই রথে আরূঢ় হননা বলভদ্র, বলরাম এবং সুভদ্রা। নেত্রোৎসবের পর রথে ওঠেন রাধাবল্লভ এবং রাধারাণী। উল্টো রথ হয় নয়দিন পরে। এইসময় দশটি পরিবারের ওপর দায়িত্ব থাকে ভোগ নিবেদন করার। নয় চূড়া বিশিষ্ট চারতলা এবং চল্লিশ ফুট উঁচু এখানকার রথ। বগড়ীর কৃষ্ণনগরে শ্রীকৃষ্ণরায়জীউ মন্দিরের উল্টোরথে বকুল কুঞ্জ পর্ব নামে কয়েকশ বছরের প্রাচীন বৈষ্ণব পদাবলীর কীর্তন গান গাওয়া হয়। নাড়াজোল রাজ পরিবারের রাজা মোহনলাল খান ১৭৪১ সালে নির্মাণ করেন রাম মন্দির। এখানেই রামনবমীর তিথিতে হয় রথযাত্রা। দাসপুরের তিওরবেড়িয়ার ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী রথের প্রচলন করেন কাঠ ব্যবসায়ী ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত।
দাঁতন থেকে ১০ কিমি দূরে জেনকাপুর গড়ের রায় পরিবারের রথযাত্রা চালু হয় ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে। জৈষ্ঠ্য মাসের স্নানযাত্রায় রথ শুরু হয়। এখন ২২ ফুট উঁচু পঞ্চচূড়ার রথে দেবদেবী যাত্রা করেন। দাঁতনের জয়পুরায় রথের সময় জগন্নাথ দেবকে রথোৎসবের সময় নয়দিন ধরে নিজের বাড়িতে আতিথ্য দেয়। ঐ বাড়ি গুলিই তখন যেন হয়ে ওঠে মাসিবাড়ি।
পটাশপুরের টেপরপাড়ায় উর্দ্ধব নন্দ এবং উচ্ছব নন্দ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তিনশ বছর আগে। সেখানেই বাইশ ফুট উঁচু পঞ্চচূড়ার রথ মাসি বাড়ি যাওয়ার সময় বাঁকিমোহনের কাছে রথের কোনও না কোনও অংশ ভেঙে পড়ে। তাই একে বলে 'ভাঙা রথ'। কেলেঘাই নদীর তীরে এই উপলক্ষে বসে মেলা। পটাশপুরের গোপালপুরে ১৩৮৭ সালে রাধাগোবিন্দ জীউর মন্দির তৈরি হয়। সেখানেই ফি বছর রথ টানা হয়। এগরা ২ ব্লকের বাসুদেবপুর অঞ্চলের গড়বাসুদেবপুর রাজ পরিবারের রথ বেশ বিখ্যাত।
মেদিনীপুর শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রায় সামিল হয় জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা। পুরীর আদল মেনে চলা হয়। প্রায় দুশো বছরের বেশি প্রাচীন এই রথযাত্রা। এছাড়াও মেদিনীপুর শহরের পাটনাবাজারের দত্তদের কূলদেবতা শ্রীধরনাথ জীউর রথযাত্রা ৮৭ বছরের প্রাচীন। তবে একসময় বিখ্যাত ছিল চিড়িমারসাইয়ের নন্দী পরিবারের রথ, বড়বাজারের মল্লিক পরিবারের রথ এবং হরি সিনেমার কাছে সাউ পরিবারের রথ। মেদিনীপুর শহরের বিশ্বশুক সেবাশ্রম সংঘের রথ বিখ্যাত। চলতি ২০২৩ এ মেদিনীপুর শহরের গান্ধী ঘাটে নবনির্মিত ইসকন মন্দিরের রথযাত্রা শুরু হয়েছে। জগন্নাথ বলরাম এবং সুভদ্রা কে নিয়ে এই রথ বিদ্যাসাগর হলের কাছে গুণ্ডিচাবাটিতে থাকবে সাতদিন। খড়গপুরের নিউ সেটেলমেন্টের কাছে জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা হয় পুরীর স্টাইলে। এছাড়াও শহরের তালি বাগিচা এবং সুভাষপল্লীতেও রথযাত্রা হয়।
রথযাত্রাকে ঘিরে জেলা জুড়েই চলে সাধারণ মানুষের উন্মাদনা এবং উত্তেজনা। জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার প্রতি মানুষের আবেগ, ভক্তি, শ্রদ্ধার মিশেলে জমে ওঠে রথযাত্রা উৎসব।