মেদিনীপুরের তিয়রবেড়িয়ার পেতলের রথ ।। কেশব মেট্যা

rath pracchad

মেদিনীপুরের তিয়রবেড়িয়ার পেতলের রথ ।। কেশব মেট্যা

 

 

শৈশবে মেলার প্রতি আকর্ষণ থাকবে না, এটা ভাবাই যায় না। কচি পায়ে হাঁটা দিয়ে মেলা দেখতে যাওয়া আর ছোট্ট ছোট্ট জিনিসের জন্য আবদারই তো মেলার প্রাণ। খেলারমাঠ আর মেলারমাঠ পেলেই শিশুরা ডানা মেলতে চায় পাখির মতো। গ্রাম-গঞ্জে মেলার দিনগুলোতে ঘরে ঘরে কুটুমের ভিড়, হৈ হুল্লোড়- কেমন যেন স্বপ্নের দিন। আমার শৈশব-হারানোর মেলা মানে তিয়রবেড়িয়ার রথের মেলা। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল পাঁশকুড়া বাস রাস্তার জগন্নাথপুর বাস স্টপেজ থেকে পশ্চিমে প্রায় ৭০০ মিটার। রথযাত্রা উপলক্ষে স্কুল ছুটি থাকতো বলেই কয়েকদিন আগে থেকেই আমাদের একটা অস্থিরতা কাজ করত। ফলে দুপুর হতে না হতেই উসখুস করতাম, এই বুঝি রথ টানা শুরু হয়ে গেল। এই বুঝি মেঘ জমেছে আকাশে, বৃষ্টি এলো বলে। জগন্নাথপুর বাস স্ট্যান্ডে নেমে লাল মোরামের রাস্তা ধরে রাশি-রাশি লোক ছেলে মেয়ে হেঁটে চলছে। যদিও এখন সেই রাস্তা হয়েছে ঢালাই। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে বড়দের হাত চেপে ধরতাম। মনে হতো আর কতদূর! শৈশবের সমস্ত পথই যেন বেশি বড় হয়ে ওঠে। তারপর যখন রথের সামনে অনেক কষ্টে হাজির হতাম; দেখতাম জনসমুদ্র। মাইকে অনবরত ঘোষণা চলত– অমুক মাইতি অমুক অধিকারী, বাড়ি অমুক গ্রাম, বয়স এতো, এই রঙের জামা, মা বাবার সাথে এসেছিলে। হারিয়ে গেছো। তুমি মাইক অফিসে এসে যোগাযোগ করো। কিংবা অমুক জায়গায় তোমার বাড়ির লোক খোঁজাখুঁজি করছে।

 

রথের রশি একবার ছুঁয়ে কী অনুভব হতো জানিনা, তবে আমি রথের মধ্যে খুঁজতাম একজনকে। সে আমার সহপাঠী। গুড়, খই দিয়ে বানানো নাড়ু কিনে রথের উপর বসে থাকা পুরোহিতদের উদ্দেশ্যে অনেকেই ছুঁড়তেন। পুরোহিতরাও ওরম নাড়ু দর্শনার্থীদের দিকে ছুঁড়ে দিতেন। সেই নাড়ুই নাকি প্রসাদ। এই নাড়ু-প্রসাদ ক্রিকেট বলের মতো ক্যাচ করে নিতে হয়। সেই প্রতিযোগিতায় আমরা পারবো কেন? অস্হিরচোখে চারিদিক খুঁজতাম- বন্ধুটি কোথায়? সে যে বলেছিল রথের উপরেই থাকবে, আমাকে দেখতে পেলে নিশ্চিত আমার দিকেই কত নাড়ু ছুঁড়বে !

 rath1

 

তিয়রবেড়িয়ার রথ নিয়ে লিখতে বসে এইসব স্মৃতিই মনে পড়ে গেল। এবার আসল কথায় আসি। মেদিনীপুর জেলায় পেতলের রথ কিন্তু আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। তিয়রবেড়িয়ার সামন্ত পরিবারের এই রথ আনুমানিক ১১২ বছরের প্রাচীন। জানা যায় ঘাটাল নিবাসী বলরাম সামন্ত তিয়রবেড়িয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি বন জঙ্গল থেকে কলাপাতা কেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রথম পত্নীর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয়বার বিবাহ হয়। দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত কলকাতার বড়বাজারে ভূষিমালের ব্যবসা করতেন। সেই ব্যবসায় ক্রমশ সফল হয়ে তিনি অর্থবান হলেন। পূর্ব মেদিনীপুরের মালিদা গ্রামের প্রায় একহাজার বিঘা জমি কেনেন। ব্যবসা ও তাঁর জমিদারীর প্রভাব বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। তিয়রবেড়িয়ার গ্রামেই এই সামন্ত পরিবারের পাশেই এক ব্রাহ্মণ পরিবার থাকতেন। তাঁদের কূলদেবতা মদনগোপাল জিউ। সেই ব্রাহ্মণ পরিবার অর্থ কষ্টে কূলদেবতার পুজো চালাতে পারেননি। তখন সেই পুজোর দায়িত্ব নিলেন জমিদার ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত। তারপর তিনি সেখানে অষ্টধাতুর রাধার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। স্থাপন করলেন শালগ্রাম শিলা ও গড়ুরদেব। পরে এই জমিদার ত্রৈলোক্যনাথ পেতলের রথ বানালেন। লোকমুখে তখন শোনা যেত ‘লঙ্কাবেচে রথ কিনলেন ত্রৈলোক্যনাথ’ । আসলে কলকাতার ভূষিমাল ব্যবসাই তাঁর এত সম্পদ এনে দিয়েছিল। যদিও তিনি রথ করতে চেয়েছিলেন তাঁর জমিদারীর ভেতর তিয়রবেড়িয়ার পার্শ্ববর্তী গ্রাম আড়খানাতে। পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে রথ করলেন তিয়রবেড়িয়াতেই।

rath211

 

সামন্ত পরিবারের এই রথ প্রায় ৮০ মন পেতল দিয়ে বানানো। রথের পাঁচটি চূড়া। চূড়ায় লাল রঙের পতাকা সজ্জিত থাকে। মাঝের চূড়ার লাল রঙের পতাকার মাঝে হলুদ রংয়ের সুদর্শন চক্র আঁকা। মাঝের চূড়াতে একটি ঘন্টা রয়েছে। মাঝখানের চূড়ার মাথায় অধিষ্ঠিত গড়ুরদেব। রথের নাম গড়ুরধ্বজ‌। রথের উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। সামনে ২ টি পেতলের ঘোড়া। সারথী সাত্যকী। রথের ৬ টি চাকা, যা লোহার তৈরি। রথের উপর চারকোনের মন্দিরে ৪ জন ঋষি– গদাধর, নিত্যানন্দ, শ্রীবাস, অদ্বৈত আচার্যের মূর্তি। মাঝে কূলদেবতা মদনগোপাল জিউ ও রাধারাণী এবং শালগ্রাম সজ্জিত থাকে। নীচের ধাপে চারকোনে নৃত্যরত চারজন পরীর মূর্তি রয়েছে। মূল বিগ্রহের পায়ে নূপুর থাকায় সামন্ত পরিবারের মেয়েরা কেউ পায়ে মল পরতেন না। তবে কালের নিয়মে এসব রীতি অনেকটাই হালকা হয়েছে।

 

rath3

জমিদার ত্রৈলোক্যনাথ নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর ভাই রমানাথ সামন্তের দুই ছেলে দুর্লভ সামন্ত এবং অমূল্য সামন্ত তাঁদের বাবা ও জেঠুর নামেই তিয়রবেড়িয়াতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই স্কুল বর্তমানে জগন্নাথপুর ত্রৈলোক্য রমানাথ উচ্চ বিদ্যালয়। রথের সময় এই স্কুলকেই মাসীবাড়ি করা হয়। রাস্তার সঙ্কীর্ণতার কারণেই রথের সময় বাদ্যযন্ত্র সহকারে পালকি করেই মাসীবাড়ি আনা হয় কূলদেবতাদের। রথের দিন পুজোর পর দুপুর থেকে স্কুলের সামনের মাঠেই আটচালাকে কেন্দ্র করে রথ তিনবার অথবা পাঁচবার ঘোরানো হয়। পুরীর মতোই উৎকল মতে ৯ দিনের দিনে এখানে উল্টোরথ হয়।

rath4

 

 

কথিত আছে আগে নাকি কামান ফাটিয়ে রথ টানা হতো। এমনকি এই উৎসবের সময় আড়খানার শিবপুকুর থেকে মাছ ধরে আমিষ ভোজের ব্যবস্থা থাকত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। একটা সময় তিয়রবেড়িয়াতে তালপাতার পেখ্যা বিখ্যাত ছিল। বৃষ্টি বাদলার দিনে পেখ্যার ব্যবহার ছিল বেশী। কালের নিয়মে সেসব এখন অতীত। এখনও মেলাতে মাদুর, চাঁচি, বাঁশের ঝুড়ি, কুলো, ঢুচনি, ঠ্যাকার পসরা বসে। রথের মেলায় জিলিপি, পাঁপড় ভাজা, ঘুগনির দোকান যেমন রমরমিয়ে চলে তেমনি তিয়রবেড়িয়ার রথ মানেই হরেক রকমের ফুল ও ফলের চারাগাছ বিক্রির নার্শারী দোকান। প্রতিদিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেও রথযাত্রা ও উল্টোরথের দিন মানুষের ভিড় প্রমাণ করে দাসপুরের তিয়রবেড়িয়ার এই পিতলের রথের মাহাত্ম্য কোনো অংশে কম নয়। আধুনিক সময় গ্রামীণ সভ্যতার অনেক পরিবর্তন ঘটালেও তিয়রবেড়িয়ার রথের মেলার উন্মাদনায় কোনোরকম ভাটা ফেলতে পারেনি।

 

তথ্য ঋণ–
সুমন সামন্ত, তিয়রবেড়িয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর।

মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...