এক।।
যেখানে দাঁড়িয়ে আমি সেখানে খাদের মধ্যে নেমে যাচ্ছে জ্যোৎস্নারা। তারা ছুঁতে যাচ্ছে জল, মনের আগুন। তার একটু পাশে রাত দোল খাচ্ছে অচেনা বটের ঝুরি ধরে। পাখিদের কলরব এখন শোনা যায় না। স্তব্ধতার ভাষা রপ্ত করে সুর ঢেলে দিচ্ছে উন্মুক্ত আকাশ। অন্ধকারের ভাষায় গান গাইছে সব। খোলা মাঠ, চেনা পথ, অচেনা গাছের পাতা। শিকড়েরা মাটির গভীরে নিজেকে গেঁথে তুলে আনছে জোছনার মায়াবী তরল। পাতায় পাতায় ছড়িয়ে দিয়েছে তার দম্ভের পৌরুষ। পাতা জানে না সে কখন কী চায়? সারাটি দিন সে বিলিয়ে দেয় নিজেকে। প্রকৃতির সংসার বাঁচিয়ে রাখার দায় নিয়ে সে নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখে। জ্যোৎস্না সে হাসি দেখেনি কখনো। পাতাদের শীৎকারে মেতেছে শিকড়। জ্যোৎস্নার মায়াবী মুখোশ পরে পাতারা ভোলায় শিকড়ের জীবন যন্ত্রণা।
যেখানে দাঁড়িয়ে আমি ঠিক তার নিচ থেকে শিকড় নেমে গেছে অন্ধকারে। আমার শিকড় নেমে গেছে অন্ধকারে। পাতাদের চাপা কান্না অহংকারের শরীরে মেখে ভুলছি আত্মপরিচয়। খাদের গভীরে নামা জ্যোৎস্নারা ডেকে যাচ্ছে। কুহেলিরা পিছু নিচ্ছে এই জীবনের। নিজেকেই এই অন্ধকারে কুয়াশার রহস্যে আবৃত করে দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে আছি আর জ্যোৎস্নার খাদে নেমে যাওয়া দেখছি। পাতার বিষাদ শীৎকার শুনছি আর অবসাদে মাথা ভারি হয়ে আসছে। একটু আলো চাইছি আমি, অনেকটা আগুন। আলোতে একবার মুখ দেখবো নিজের আর আগুনে পুড়িয়ে দেবো এই অস্তিত্ব। খাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক আততায়ী পুড়ে যাক। মরে যাক। পরজন্মের প্রত্যাশা না করেই ভুলে যাক ইহজন্মের পাপ, অভিশাপ।
দুই।।
চোখ বন্ধ করে আমি অন্ধকারকে দেখার চেষ্টা করে থাকি। শুধু অন্ধকার নয়, আরও অনেক কিছু দেখা যায়। সব চেয়ে বড় কথা, অন্ধকার দেখার চেষ্টায় দেখে ফেলি আলো। যে আলো মায়ার জাল বুনে চলে অবিরাম। ঘুমের ভিতর স্বপ্ন, স্বপ্নের ভিতর ঘুম ভাঁজ করে রেখে দেখি ভাঁজগুলোর ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যায়। আমি যত বেশি করে অন্ধকার দেখতে চাই, তত বেশি আলো কেঁপে কেঁপে ওঠে। সে আলো সূর্যের নাকি চাঁদের তা বুঝতে শিখিনি এখনো। শুধু দেখি আলো খুঁজতে গেলে অন্ধকার আর অন্ধকার খুঁজতে গেলে আলো দেখা যায়। একটু ভুল হল বোধহয়। এ আলোগুলোকে আগুন বলাই ভাল। থেমে যাই। আর অন্ধকার না খুঁজে তাড়াতাড়ি বুঝে নিই অন্ধকারের ভিতরে থাকে অদম্য আগুন। আমাদের প্রত্যেকের ভিতরেই সেই আগুন খোঁজার অবদমিত ইচ্ছারা ছটফট করে। বারান্দার খাঁচায় ঝুলতে থাকা টিয়ার মতন। সুযোগ পেলেই ছুট। ছুটতে ছুটতে ইচ্ছারা একটা খোলা মাঠের কাছে গিয়ে হাঁপ নেয়। খোলা আকাশে ইচ্ছার আগুন ডানা মেলে দেয়। আকাশ পুড়ে যায় চূড়ান্ত কামনায়। আমরা কেউই সে আকাশ দেখতে পাই না। আকাশ ততক্ষণে ডানা লাগিয়ে উড়ে গেছে মহাকাশের অন্ধকার মহাজগতে। যেখানে আলোরা আগুনের সাথে সংসার করে।
তিন।।
আলো, অন্ধকার আর অদম্য আগুন। বিষাদের মুখোমুখি এ জীবনের চাহিদা। নিছক স্বার্থের কাছে ভালোবাসা কতটা নতিস্বীকার করে বেঁচে থাকে? সমস্ত ভালোবাসার মধ্যে স্বার্থ আর স্বার্থহীন অন্ধকার খুঁজে চলে আগুন ও আলো। আলো যেই চেনা গলি ছেড়ে ঢুকে পড়ে অন্ধ গলিতে, অন্ধকার ভয় দেখাতে থাকে। মুক্ত চিন্তা লোপ পেয়ে যায়। ভুলে যাই অন্ধকারের ভিতরে থাকে আলো আর আলোর ভিতর ও বাইরে এক অদম্য আগুন। আমাদের সবারই সেই আগুন প্রয়োজন। নিজের নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রয়োজন। অথচ আমরা চেনা গলি ছেড়ে অন্ধকারে ঢুকতে ভয় পাই। সাধারণত ঢুকিও না। অথচ অন্ধকারে না ঢুকলে আলো পাওয়া যাবে না। আলো না পেলে তার আগুন পাবো না আমরা। গভীরতম অন্ধকারের ভিতরে শিকড় নামিয়ে খুঁজে দেখি জ্যোৎস্নার মায়াবী তরলে ভেসে যাচ্ছে মাটি। এক অদ্ভুত আলোয় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কেউ শোনার নেই, কেউ বলার। সকলেই সীমার ভিতরে দাঁড়িয়ে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে। অন্ধকার যেন তার গলি দিয়ে ঢুকে না পড়ে ঘরে। অথচ অন্ধকার এলেই যে সেই মোহময় আলো আমাদের ঘর আলো করে দেবে তা জানার জন্য এক শিকড় জীবন কাটানো দরকার। মাটির অন্ধকারে থেকে পাতা, ফুল বা ফলের রঙ দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু তার দম্ভের পৌরুষ সমগ্র গাছটির আলো হয়ে যাওয়ার অহংকার নিয়ে মেতে থাকে অন্ধকারে।
শিকড় নামাচ্ছি ভয়ে। ডুবে যাচ্ছি অন্ধকারে। মাটির রসালো আলো ছুঁয়ে বেঁচে থাকছি অন্ধকারে। আলোর আগুন মেখে শুদ্ধ করছি নিজের জীবন। অদম্য আগুন আজ আমাকে পোড়াও। যাকে ভালবাসি তাকে আলোয় ভাসাও।
চার।।
আলো, আলো আর আলো। শুধু আলোই যখন চোখে পড়ে তখন ভয় পাওয়া দরকার। পাতাদের আলো যদি শিকড়ের গায়ে এসে পড়ে তবে তো তার ভয় পাবারই কথা। মাটির তলের আলো আর উপরের কোনোদিন এক ছিল না, আজও নেই। মাটির উপরে উঠে এলে শিকড়ের মৃত্যু অনিবার্য। এ কথা ভুলে গেলে, আলো নিয়ে মেতে থাকলে মুস্কিল। অথচ আমি তাতেই মত্ত। অতল গভীরে প্রবেশের পথ ভুলে গেছি। নামতে পারছি না নিচে। ছুঁতে পারছি না অন্ধকার। চোখ ধাঁধিয়ে গেছে আলোয়। অন্ধকার ঠেলতে ভয় পাচ্ছে শিকড়। আলোয় মুখ লুকাচ্ছে পাতা। ক্লোরোফিল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে তার জীবন। গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে আর তৈরি হচ্ছে আলো আর আগুনের জন্য। নিজেকে নিয়ে খেলার সুযোগ হারিয়ে, কাউকে সে সুযোগ দিয়ে যেতে প্রস্তুত করছে। এ ইতিহাস নয়। জীবনের ধারাবিবরণী। নিজেকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাও। আবিষ্কার করো নিজস্ব অন্ধকারের আলো। আবিষ্কার করো সেই অফুরন্ত অদম্য আগুন যা চাঁদের আলোয় শীতল করে দেয় মন। যে আগুন প্রতিবাদের, প্রতিরোধের কথা বলে পথে নেমে। কিন্তু এই লং জার্নির শুরু যে অন্ধকারের পথে তা তো আমরা সকলেই ছেড়ে এসেছি। এখন ভুল আলোর পথে পা বাড়ানোর খেলা। আর এই ভুল পা বাড়ানোর ভিতর দিয়ে নিজেকে ভুল বোঝানো। ব্যর্থতার সাফাই গাওয়া। আলোর মোহে জড়িয়ে অন্ধকারের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা থেকে জীবনকে বঞ্চিত করা।
শিকড় বঞ্চিত করছে পাতাদের। পাতা গাছকে। অন্ধকার আলোকে আর আলো কখনো কখনো অন্ধকারকে। আলোর মুক্তি, পরিচিতি এবং অমরত্ব যে লুকিয়ে থাকে অন্ধকারের ভিতর সে বোধের গণ্ডির বাইরে থেকে আমরা সবাই নিজেকে অবাঞ্ছিত করে ফেলছি। আলোর কাছে, আঁধারের কাছে, আগুনের কাছে এমনকি জ্যোৎস্নার কাছে অবাঞ্ছিত জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।