একক কবিতা সন্ধ্যা ।।  অলক জানা

alak jana

অলক জানা-র এক গুচ্ছ কবিতা 

 

 

পতিত চল্লিশ তারার লেখচিত্র

১১
চোখ ও মনের যুগল দৌড় যতটা কুলোয় ততটাই পুঁজি---গাছ, গাছের মতোই সহিষ্ণু, মানুষের সঙ্গে মিলে এমন কোন সাম্য আকৃতির প্রাণী পৃথিবীতে নেই। নিজেকে অনেকবার সজ্ঞান ঠকিয়েছি---এটাও রীতি---কবি ইচ্ছে করেই দুঃখের জন্য বিরহী চাতক ! মধ্যরাতে তারাদের কলহে উল্কাপাত, কার ঝরে পড়ার কথা, ঝরে যায় কে? মোহাড় চৌরাস্তা থেকে বাঁশপাতা গ্রামের দূরত্ব-৬ কিমি, একবার ঘুরে এলে জীবনের অর্ধেক ক্লান্তি কেটে যায়, কিছু মুখের সঙ্গে দেখা হওয়া জরুরি, কিছু মুখ প্রত্যাশা রেখে সরে যায় বহুদূর, যেভাবে থাকার কথা কাদা জল ছায়া রোদ নির্যাতনের সংসার নিয়ে সেভাবেই দিনপাত, কতকিছু হারিয়ে এখন বেবাগ হালকা আমি বাকি পরমায়ুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করি নির্ভার মেঘ।

 

১২
মুখের মধ্যে একটি বিষ বোঝাই দাঁত গচ্ছিত রেখে কেমন পরমায়ু খরচ, মানুষ কামড়ের প্রদাহে হার মেনে যায় সাপের বিষ ও ধন্বন্তরির অব্যর্থ দাওয়াই। প্রচণ্ড ধ্বংসের চেয়ে আমি নিজেকে বেশি ভয় পাই, মাঝেসাঝে নিজেকে তাই ক্লীব মনে করা অসংগত নয় ? রাস্তায় বাঁক মানে চোখ থেকে সরে যায় দৃশ্যপট, সচেষ্ট তুমি নিক্তিতে মেপে নাও ভালোবাসা, তবু আমার নীরবতায় ঢিল পড়লে একটা নির্ভরযোগ্য
হাত খুঁজি, অপেক্ষা সাজাই----সন্দেহ একটি সযত্নে পালিত আদিভৌতিক বিষের নাম, মুখ থেকে যা একবার গড়িয়ে পড়লে আমরা পরস্পর নীল হয়ে যাই।

 

১৩
আরশোলা কবে যেন পাখি হ'তে চেয়েছিল ?
ডানা ও সন্ধিপদে লেগে থাকবে ভেজা মেঘের ঋতু অথবা আকাশের অগভীর নীল ঘাম, দূরাশার জন্য ঝুঁকির জীবন বিফল হলে-- একদিন নিজস্ব জাত খুইয়ে বসে প্রতিটি জন্ম।

পাঁচজন পাণ্ডবের, দ্রৌপদী-ফোরসাবজেক্ট ;
এক-দুই-তিন দুরমুশ করলে স্বর্গ যাত্রার একমাত্র বিশ্বস্ত ভরসা, চতুর্থ বিষয়ের হাত।

কবি নগ্নতা চেয়েছে কবে ? সর্বত্র
ছড়ানো শস্য খুঁটে নিতে অনিকেত ঘুরপাক, চোখের সংকীর্ণতায় প্রতিটি সম্পর্কে নিঃশব্দ ঘুণ বসত। অন্যকে বঞ্চিত করে
যদি নিজেকে জিতিয়ে নেওয়া বলে
মনে রেখোঃ তুমি এক আশ্চর্য স্বেচ্ছাচারী,
এই জয়ের নাম নাগাসাকি একাকিত্ব!

ভালোবাসার মতোই একদিন সবাই ঘেন্না
শিখে যায়, নিঃশ্চল বিশ্রাম চেয়ে
ঘুমিয়ে পড়ে বাতাস, তখন শিশির শুভেচ্ছা
মুছে দেয় ধুলোর দুর্মুখ, তুমি বাতাস
ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে দেখো ঝড়,
খুলে দিচ্ছে নিরাপত্তার আগল সমগ্র,
তোমার বাতাস প্রেমের ভেতর হঠাৎ
জন্ম নেয় নিটোল অক্ষয় অমাবস্যা।

 

১৪
এভাবেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় নিজস্ব কক্ষপথ,
মনস্তত্ত্ব ও দর্শন মিশেলে আমার নির্মাণ ও যাপন, হারমোনিয়ামের মতো ছড়ানো পথের সপ্তম সুরের ডাকে অবিকার, নিজস্ব একটি পথের এজলাসে আমার চাঁদদেখা ছাউনি----- আমাকে চিনে নেবে পথের ধুলো, গাছ ও গাছের ছায়া। এশিয়ার ভেতর কত দাগ, দ্বন্দ্ব, ভাগাভাগির আকাশ ও জমিন তবুও সীমান্ত পেরিয়ে চিল-চিৎকারে সদর্পে বলতেই অভ্যস্ত আমরা এশিয়া মহাদেশের সভ্যসুধী, পালিত এসব দ্বিচারিতা কতখানি স্বস্তির না সুখের ? সমগ্র একটি মহাদেশ মানুষের মতো ক্ষত গোপন রেখে ইস্ত্রিকরা জামাকাপড়ে
কেমন তার মুখে বিনয়মিষ্ট হাসি খিলখিল।

 

১৫
প্রতিটি শব্দের থাকে নিজস্ব বাড়িঘর
চঞ্চল উড়ুক্কু মাছের মতো থাকে ইচ্ছে---
বৃষ্টির ফোঁটা ও রোদের অভিসার,
চিহ্নমাত্র পথে পড়ে থাকলোই বা
পাখি ও মানুষের মতো দিনশেষে বাড়িফেরা এক মীমাংসিত সংবিধান, এর বাইরে, তবুও এর বাইরে অসফল কিছু ফুল পাতা গন্তব্যের আগে ঝরে যাওয়ার নিয়তিতে বিশ্বাসী।
এত কবি, এত নাশকতা হড়পা বাণের নিয়মে
তছনছ করে বিরচিত বাসর, তুমি না চিনলেও আমি তাকে আদিগন্ত জানি সেই স্বেচ্ছাচারী বিভীষিকা, প্রতিটি শব্দের থাকে নিজস্ব বাড়িঘর, শরীরের তুমি, মননের তুমি উভয় তুমিকেই আপ্ত সহায়ক শব্দে সজোরে আজ বেঁধে রাখতে চাই।

 

১৬
পুরনো উত্তেজনা প্রবল ও ভীমবেগে সম্মুখে এসে দাঁড়ালে, কোন আগল তাকে নিরস্ত্রের জন্য যথেষ্ট নয়, মাথা থেকে শরীরে গড়িয়ে নামে বাঁধন হারা মনোযোগ, একরোখা স্রোতের বাঁশবন। পাঁজরে শবের গন্ধ, বয়ে বেড়ানো স্বভাব জানেনা একটি ফুলের ভবিতব্য,
ফুল মানে সূর্যের প্রসন্ন ক্ষমা, স্বর্গীয় শিবির
যে আঘাতে আঘাতে নির্বাক অনাহত,

 

১৭
অনেক দিন যে আমাকে ক্লিওপেট্রার মতো ভালোবেসেছিল, বহুদিন যে আমাকে ভালোবাসেনি উর্বশীর মতো, ঋতু বদলের সঙ্গে  সংগোপন প্রিয় অসুখ বয়ে বেড়ানোর জন্য নির্বাচিত আবাদের শ্রেষ্ঠ জমি, শরীর ও মন----
সমস্ত অভিপ্রায় অনুযোগ চূড়ান্ত হলে পথ জুড়ে মহাশূন্য বৈরাগ্য, তখন নির্মোহ পশ্চাতে
পড়ে থাকে ক্ষমতায়ন, রাষ্ট্র ও প্রথম শীৎকার, তিতিক্ষায় এত ধ্বনি এত নির্ভার দ্বৈপায়ন আলো
মানুষের চেয়ে এসব তত্ত্ব বেশি বোঝে পান্থশালা ও জংগল, তাই কোন ক্ষতর বিজ্ঞাপন নেই
কে কখন আসে যায় মনে রাখতে নেই প্রতীক্ষালয় জানে, অথবা চোরাকারবারির হেঁচড়ে উপড়ানো চন্দনের গর্ত থেকে আবারো জন্ম নেয় নতুন চারাগাছ।

 

১৮
এখনো কিছু প্রবৃত্তি এমনই, রোদের মতো ঘুরে আসে মফস্বল পাড়া, চাল আছে চুলো নেই, কারো আগুন মজুত অথচ খোরাক নেই, তবুও, তবুও---মিছিলে কাতারে কাতারে মানুষের শীতল প্রস্রবণ। সামাজিকতা একটি সাইনবোর্ড মাত্র, এর বিপরীতে, মানুষের স্বভাবে সম্পর্কে উঠে আসে বন----বন মানে, আমাজনের বিষধর সাপ জন্তু জানোয়ারের মুষ্টিবদ্ধ খাসতালুক। নিরাপদ লক্ষণ রেখা ? সে তো পুরান প্রথিত একটি স্বপ্ন, অথবা দূর আলোকবর্ষ, ফুল তুলসী বেলপাতার ভিড়ে যে একেবারে শ্বাসরুদ্ধ মৃতবৎ অন্ধকার।

 

১৯
অনেক লিখেছ, লিখলে খোলাপ্রাণ দু-হাতে
সুদৃশ্য স্বচ্ছ অক্ষরের ঘরকন্না মলাট,
বইপত্র ঠাসা ঘরদোর লেখাজোখা সাথে
খ্যাতি এখন দুয়ারে দুয়ারে, বালাইষাট--
ডাকে উত্তর, ডাকে পূর্বও খুব আন্তরিক
ফুলেরমালা স্মারক মানপত্র উত্তরীয়,
না জানি লিখেছ, অতল অধিক মানবিক
সখী অথবা সাধন সখা রাখবে স্মরনীয়।
নাম ছুটছে, দৌড়চ্ছে গ্রাম থেকে সরকার,
সুস্বাস্থ্যের এ্যাকাউন্ট ভরে যায় অর্থ-কোষে
পক্ষের বুদ্ধিজীবী ? খুলে গেছে কপাল তার
বোকা অকবি কেবল মরে অনর্থক রোষে।

কখনো রবি, শক্তি বা সুনীলের স্বাদ পাই
তবে নিজের লেখায় আপনি কোথায় ভাই ?

 

২০
স্থিরীকৃত একান্ত কোন বিরতির ভেতর
ডান পা, বাম পা-টি ছুঁয়ে স্ত্রীলোকের মতো আচরণ করে, অথবা বাম, ডানের সঙ্গে--
সনের প্রথম বৃষ্টির মতো মনে পড়ে সেই প্রিয় মুখ, তোমাদের শহরেই থাকে আমার প্রেমিকা---
কর্মসূত্রে, নচেৎ বাসা বদল, লঘু চিনি গুরু লিকার একটি লবঙ্গ দানা সমেত চা-এর উষ্ণতা খুঁটে নেয় রোজনামচার ব্যস্ত অস্থির খুটখাট অমনোযোগ। এটুকু ব্যক্তিগত রাষ্ট্রের কাছে ঢের বোকা বোকা তবুও নিস্পৃহ নির্ভার সংগোপন কবিতায় সঁপে অনুতাপ পীড়নে বিশুদ্ধ হতে চাই

 

২১
নদী পেরলে আর একটি গ্রাম শুরু, ঘুরে দেখার
আগ্রহে চোখ পাবে বাঁশের কাঁপন, শ্মশান চুল্লি
এখনো থেকে যাওয়া দু একটি মাটির বাড়ি, ঠাকুরথান, মাছ চাষের আরোপিত জলাধার, ধান গম সবজি আবাদ থেকে দূরত্ব ক্রমশঃ বেড়ে যায়----
সংরক্ষিত আহারে অভ্যস্ত জনজাতি ইতিহাসকে বুড়ো আঙুল দেখায়, অতীতহীন অভিকর্ষহীন লোকারণ্যে কবি লিখে চলেন, দ্রবীভূত যুগ যন্ত্রণার ককটেল কবিতা, মুঠোয় সারা পৃথিবী ও পৃথিবীর হৃদয়, মিসাইল ও পারমানবিক সত্যাগ্রহে যাহা বিক্ষত আধমরা, তবুও ভালো থাকার চেষ্টায় পার্টি অফিসে পার্টি অফিসে জায়গা করে নিয়েছেন মহাদেব, বাইবেল ও ঈদের চাঁদ।

 

২২
জলের মনোভাব বোঝা এতো সহজ নয়
আপাত সাম্য দেখে কে বলতে পারে এখুনি সবেগে হাঁটতে চায় সে, রোদের ফুসমন্তর, বাতাসের উৎসাহে কখন যেন মন উড়ে যায় দিগন্তে, আমাদের মোহড়বাজার ও মহানগরের দূরত্ব প্রায় একশো কিমি, বাস-ট্রেন, ফেরিঘাট ভ্রমণে ডানেবামে সামনে পেছনে কত জল---
তেষ্টা চিরকাল বহুগামী অসাংবিধানিক, বাঁশপাতা শাড়ির আড়ালে লাজুক নির্ভেজাল ডোবা স্বচ্ছ কোন একটি চোখ, যে নির্নিমেষ খুঁটে নিতে পারে তৃষ্ণার্তের সমূহ মনোযোগ, তবুও রক্ত মাংসের শরীর আমৃত্যু বলতেই পারে না প্রতিটি জলের স্বাদ জলেই সীমাবদ্ধ।

 

২৩
গাছে নাম লেখার বয়স, ফুরফুরে বাতাসের করতলে উড়ে চলে গেছে কত দূর-----!
ছড়ানো আঁচল উদাস মাঠে তিলফুল জ্যোৎস্না অথবা সরিষার আগুন মজুত রেখেছে সেইসব মহার্ঘ ফিসফাস। বাইক থামিয়ে দু-একটি ফটোসুটে প্রথম পৌরুষ গন্ধ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় এখনো নোঙর করে নাকে, শরীরের ভেতর এক নৌকো অবিরাম খুঁজতে থাকে পাড়, অনিচ্ছাকৃত বোকা বোকা জলছবি ভাসে আর মিলিয়ে যায় তড়িৎ মেজাজে।

 

২৪
মনের ভেতর চাপ বাড়লে
ডিসেম্বরের রাত্রিও প্রবল জ্বরমগ্ন,
বিরহটুকু বর্ষার পুকুর স্বভাবে
ভাঙতে থাকে সিড়ি, না জানি
কতখানি অচিরে সময় মিলিয়ে যায়,
সমুদ্র ফেনা। ছমছমে স্পর্শকাতরতায়,
তখন বাড়ির দরজাখোলা ঘর,
কবন্ধ রাক্ষসের মতোই গিলে ধরে
নৈশব্দের শরীর, বলতে পারো
আজ একান্ন মাস আমি
কেবল ছায়ায় বেঁচে আছি।

 

২৫
অন্তরায় শব্দের আড়াল থেকে ঘৃণা বেরিয়ে এলে
একটি সম্পর্কের আয়ু খাটো হয়ে যায়, 
মেরামতির সমস্ত কায়দাকানুন তখন ঠুটোঁ জগন্নাথ,
যে পেরিয়ে গেল তার সব সমর্থন আমার অনুকূলে নয়, কিছু প্রতিশ্রুতি গন্ধহীন ফুল, হৃদয়হীন বাগান,
বরাবর অপ্রয়োজনীয়, তবুও বিকারমগ্ন কোন
দুর্বলতায় সঙ্গী হয়, পুড়ে দেয়, পুড়ে দিতে পারে
গচ্ছিত যত্নের কিছু পাণ্ডুলিপি, অন্তরঙ্গতার অভাব বোধে আর যাই হোক, একজন কবিকে আটকে রাখা যায় না।

মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...