স্টাফ নার্স
এস এস কে এম হসপিটাল
সারা বিশ্বের সাথে সাথে কলকাতাও আক্রান্ত করোনাগ্রাসে। করোনা মুক্ত পৃথিবীর জন্য লড়াই সারা বিশ্বব্যাপী। সেই অসম কঠিন লড়াইয়ে আমি একজন সৈনিক।
সকাল থেকে ডিউটির ব্যস্ততার পর ক্লান্ত শরীরে বিকেলটা ঘুমিয়েই কেটে গেলো। ঘুম ভাঙার পর দেখি জানালার পাশের গাছগুলো হাওয়ার কনসার্টে মাথা ঝাঁকিয়ে সঙ্গ দিচ্ছে। মাঝে মাঝেই আকাশের বুক চিরে আলোর ঝলকানি আর তার সাথে শব্দ। পায়ে পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ভেজা হাওয়া এসে লাগলো চোখে মুখে। দোতলার বারান্দার জানালা থেকে দেখছি নিয়ন আলো কেমন পিছলে যাচ্ছে নীচের বৃষ্টিস্নাত পিচ রাস্তায়। অদ্ভূত শান্ত চারিদিক। এমন অস্বাভাবিক শান্তিও কি মনকে অশান্ত করে তোলে? হবেও হয়তো।
অনেকেই মেসেজ করে জানতে চাইছেন এখানের পরিস্থিতি কেমন?! আগের থেকে কি ভালো? কেন সেসব কথা লিখছি না।... কি বলি বলুন তো?!! কি হবে বলে?!! তাতে কি কিছু বদলাবে? আমরাও ধোঁয়াশায় ঢাকা সরণী বেয়ে চলেছি। ভয়, আতঙ্কে , চিন্তা আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলোকেই প্রভাবিত করছে বুঝতে পারছি। অধৈর্য্য, অস্থিরতা এসব তো আছেই। কাছের মানুষগুলোর উপর উপচে পড়া অকারণ অভিমান নিজের বিরূদ্ধেই নিজের অভিযোগ বাড়াচ্ছে।
কেমন যেন মনে হচ্ছে, মেট্রো করে শহরের এ প্রান্ত ও প্রান্ত চষে বেড়ানো যার নিত্য দিনের ব্যাপার ছিলো, সেটা কি স্বপ্ন ছিলো? নাকি এটা স্বপ্ন?! বকবক করতে করতে শহরের রাজপথ, ফুটপাথ পার করে গলি পথেও পায়ে হাঁটা দিনগুলো কি সবই কল্পনা?!! এই বন্দী জীবনই কি বাস্তব?!! ফুটপাতের দোকানগুলো ছিলো আমাদের আড্ডাখানা। কিজানি, তারা কেমন আছে? কি করে চলছে ওদের?!! লেক মলটা কি পোড়ো বাড়ির মতো অন্ধকারে ঢেকে আছে?!! আচ্ছা, ওখানে কি সত্যিই আলো জ্বলতো কখনো? নন্দন চত্বরে সত্যিই কি আমাদের হাসি আড্ডা খুনসুটিতে বাতাস চির বসন্ত হয়ে থাকতো? নাকি সবই গল্পকথা?!!!
মনকেমন করছে। মনে হচ্ছে যেন আমাদের জিওনকাঠিগুলো কেউ লুকিয়ে রেখেছে। তাই তো এমন থমকে গেছে জীবন। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, যেন কোনো কল্পবিজ্ঞানের গল্প স্বপ্নে দেখছি। হয়তো ঘুম ভেঙে দেখবো সব একই রকম আছে। মেয়ে আর প্রিয় মানুষটার সাথে হাসি মজা দুষ্টুমি খুনসুটিতে আবার ভরে উঠবে জীবন। আবার আগামী ট্যুরের প্ল্যান করবো। পাহাড় বেড়ানোর ভাবনায় লোকজনকে জ্বালাবো। পকেট আর ছুটি না সায় দেওয়ায় উবের বুকিং করে বিদেশ যাওয়ার জন্য কতো বাজেট হবে সেসব দেখার জন্য উবের সার্চ করবো!!! আরো কতো কিছু...!!!
বাইশ দিন পর আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা। করোনা যুদ্ধে সামিল এই ক্ষুদেগুলোও। যারা দিনের পর দিন আমাদের ছেড়ে আছে। হাজার মনখারাপেও ফোনের ওপারে হাসি মুখে বলে গেছে। "আমি ভালো আছি মাম্মা। তুমি চিন্তা কোরো না। ঠিক মতো খাবে। হাত ধোবে বারবার।" আমার কান্না লুকোনোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বারবার। হাসি মুখে থাকার সাহস দিয়েছে বারবার।
কোভিড যুদ্ধ জিততেই হবে রে সোনা। তবেই তো তোকে জাপটু করে হাম্পুস দিয়ে আদর করতে পারবো। সোমবার আবার হাসপাতাল যাবো। জানি না কবে আবার আসবো তোর কাছে। আবার কবে তোর সাথে দেখা হবে। তবে ততোদিন আমরা অপেক্ষা করে থাকবো আবার দেখা হওয়ার জন্য।
আজ একটা গানের কথা মনে পড়ছে খুব। সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া "কোনো এক গাঁয়ের বধূ"। সেই যে হঠাত্ আসা ডাকিনী যোগিনীর জন্য কেমন করে সাজানো গ্রাম নষ্ট হয়ে গেলো। আচ্ছা আমাদেরও কি সব আশা স্বপ্নের সমাধি হয়ে যাবে?!!! না না। আমাদের এতো কষ্ট, এতো লড়াই বৃথা হয়ে যাবে?!! কক্ষনো না। আমরা জিতবোই। আমরা আবার নতুন করে বাঁচতে শিখবো। আমরা সবাই ভালো থাকবো। ভালো রাখবো। ভালো হোক সব। আলো হোক সব।