সোমনাথ প্রধান-এর এক গুচ্ছ কবিতা
খেলা
বাচ্চারা রাধাকৃষ্ণ রাধাকৃষ্ণ খেলছে।
একজন কৃষ্ণ, বাকিরা তাকে না বলে
নিজেদের মধ্যে চুপিচুপি একজনকে রাধা বানিয়ে
বলছে - কে রাধা বলো না!
কৃষ্ণ যদি মনস্তাত্বিক উপায়ে তাকে খুঁজে পায়,
তবে সেই রাধাই আবার কৃষ্ণ হয়ে রাধাকে খুঁজবে।
এভাবে রাধা কৃষ্ণ হবে, কৃষ্ণ রাধা হবে।
বাচ্চারা বিশ্বপ্রেমের খেলা খেলছে।
আমি একবার কৃষ্ণ হয়ে রাধাকে খুঁজছি,
আবার রাধা হয়ে দেখছি, কৃষ্ণ খুঁজে পায় কিনা!
শয়তানি
এখন মুগ্ধ হতে সঙ্কোচ হয় সুলগ্না!
যদি দেখি সুউচ্চ দুপাড়ের নদী,
স্রোতে তার ছিটকে নাচে চোখ,
স্নিগ্ধ হয় ইচ্ছে।
তারপর কিছু পথ মাটির নিচে লুকিয়ে
সে নদী কোথায়
বিরাট প্রজাপতি বুকে নিয়ে
মাটির উপর জ্বলে ওঠে।
তাকে ছুঁতে হন্যে হই যখন,
আমার মুগ্ধ হওয়াকে শয়তানি বলো তুমি!
নামকরণ
সেসব দিন
খেলা যখন ছিল তোমার সনে,
পার্কে বসে রোজ দুজন দুজনকে নাম দিতাম।
একদিন তুমি আমায় বললে আকাশ,
আমি তোমায় বললাম' নীলিমা ',
একদিন আমায় ডাকলে অনন্ত বলে,
আমি তোমার নাম দিলাম 'মাধুরী',
একদিন বললে পলাশ,
আমি বললাম 'চৈতী ' ...
চলছিল বেশ।
হঠাৎ হল তোমার অভিমান! এবং ভয়ানক।
ভাঙতে ভাঙতে দিন, সপ্তাহ, মাস...
আবার যখন এলে,
আমায় ডাকলে আমার মায়ের দেওয়া নামে,
আমিও তোমায় ডাকলাম
তোমার মায়ের দেওয়া নামে...
আশ্চর্য!
এত আনন্দ আগে তো কখনও লাগেনি!
অভ্যাস
সলজ্জ জিজ্ঞেস করি,
আপনি কি কবিতা পড়েন?
এই অরণ্য, নদী, পাহাড়ের সংসার
সামলাতে সামলাতে,
পড়েন কি নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, বনলতা সেন,
বা সোনার তরী!
আপনি বললেন, পড়ি!
এবং মরি...
- তার মানে?
- মানে মৃত্যু!
- মৃত্যু?
- হ্যাঁ
যাঁরা কবিতা পড়েন ,
তাঁদের কাছে মৃত্যু একটা অভ্যাসের নাম...
বুক শেলফ
মধ্য রাত্রিতে প্রিয় বই না পেয়ে
বুক শেলফ তন্য তান্য করে খুঁজছি,
এখানে ওখানে, সহস্র এবং নানারকম স্পর্শের পরিভাষায়।
শেষে পেলাম। উফ্! হাতে যেন স্বর্গ এল।
চরম অগোছালো বুক শেলফ,
তবে অগোছালো ভাবটা অসম্ভব সুন্দর লাগছে,
মনে হল,
ভোর বাসরে এভাবেই আমার পাশে শুয়ে থাকো তুমি!
মনে হল,
আজ যদি শেলফটার জায়গায় তুমি থাকতে,
কত নতুন নতুন স্পর্শে শিহরিত হতে,
বৎসায়ন মুনি থাকলে
অবশ্যই সেসব স্পর্শের ব্যাখ্যা লিখতেন
তাঁর অপূর্ব শাস্ত্রে...
ফুল ও মাংস
তোমার জন্য
রোজ কয়েকটা করে ফুল নিয়ে যেতাম।
একদিন বললে, রোজই তো ফুল আনো,
একদিন মাংস আনবে তো!
তবে মজা করছো ভেবে তারপরেও
ফুল নিয়েই গেছি।
এভাবেই চলছিল।
হঠাৎ তোমার বুক থেকে একদিন
কম্পিত তিস্তার
তীব্র জ্যোতি লাগল এসে আমায়,
অসামান্য কী সব উত্তাপে
নিজেই যেন রান্না হয়ে গেলাম!
বুঝতে পারলাম,
ক্রমশই আমি সুস্বাদু হয়ে উঠছি!
মাংসকে জায়গা ছেড়ে
সরে যাচ্ছে ফুলগুলো...
ধোঁকাবাজ
দুধ গরম করার সময় অনেকটা জল মিশিয়ে দি,
যাতে আরও একবেলা চলে যায়!
ছেলেমেয়ের পুষ্টির সাথে এভাবেই ধোঁকাদারী করি!
প্রচন্ড গরমে মেয়েটা কাঁদলে
তার কপালে হাত বুলিয়ে ধোঁকাদারী করি!
রোজকার ওষুধ একদিন ছাড়া একদিন খেয়ে
আরোগ্যের সাথে ধোঁকাদারী করি!
ছেলে আইসক্রিম চাইলে বলি, গলা ধরবে;
তার সরলতার সাথে ধোঁকাদারী করি!
হ্যাঁ আমিই ধোঁকাবাজ,
কবিতা লেখার আড়ালে এটাই পরিচয় আমার...
বিত্তের অনটনে যখন দুর্বলতা অবিসংবাদী,
আত্ম প্রকরণ যখন ব্যথায় ভরে যায়,
আমি ধোঁকা দি...
ধোঁকা দি আর কাঁদি!
বাগান
কেউ যদি মুখপানে চেয়ে থাকে,
আমি তাকে নিজস্ব বাগান মনে করি।
লক্ষ্য রাখি, জল আলো বাতাসের
সঠিক সরবরাহ।
সে যেন মুখ ফিরিয়ে চলে না যায়।
কারণ ওই শ্রীমুখে তুষার যুগ নামলে
নিজেকে স্বার্থপর দৈত্য মনে হবে!
তাই ফুলের বিভাসে, পাতার সম্ভাষে
পালন করি নিজের কুশলতা,,..
এরপরেও কেউ কেউ মুখ ফিরিয়ে চলে যায়!
কিছু বলি না, আরও দৃঢ়ভাবে
মালীর প্রশিক্ষণ নিয়ে অপেক্ষা করি।
সে যদি ফিরে আসে কোনওদিন
অবশ্যই মিটিয়ে দেব বকেয়া সব বসন্তের হিসেব।
আসলে মুখ ফেরানো হল অর্ধেক আবর্তন,
এ জন্মে তা পুরো না হলে সে কীসের মানুষ!
তাই যারা এখনও ফেরেনি,
তারা ফিরে আসুক,
তাদের ফিরে আসা হোক
বাগান জুড়ে বাসন্তী জলবায়ুর নাম!
ধৈর্য
ছেলেবেলায় মাষ্টারমশাই বলতেন,
ধৈর্য ধরো বৎস!
এখন বুঝি, কী অসম্ভব ফলদায়ক সে কথা;
আমি শুয়োপোকার অত্যাচারের সামনে ধৈর্য ধরেছি,
দেখেছি, প্রজাপতি একদিন ছুঁয়ে গেছে
শিয়রের মধুকৌটো!
প্রচন্ড দাবদাহে ধৈর্য ধরেছি,
বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে গেছে পিপাসিত পথ!
ভীরু অভিমানের কাছে ধৈর্য ধরেছি,
দেখেছি তার নিবিড় স্পর্শের সাহস!
ধৈর্য ধরাটা বোধহয় জীবনের নাম;
এভাবে ধৈর্য ধরতে ধরতে
প্রজাপতির চেয়ে, বৃষ্টির চেয়ে,
স্পর্শের সাহসের চেয়ে আরও রোমাঞ্চের
সেই শীতল সমাপনকে বরণ করবে সবাই,
দুটো সালের মাঝে
একটা ড্যাস হয়ে রয়ে যাবে
আমাদের ধৈর্য ধরার কাহিনি...
ডুব
ঝুঁকে আছে নীল আকাশ,
দুলে উঠছে সকুসুম কৃষ্ণচূড়া,
সাঁতার কেটে ভেসে যাচ্ছে রাজহাঁসের দল:
আহা!
গ্রামের দিঘিটি,
পরনে তার নীল চুড়িদার,
বুকে খেলে লাল - সাদা ওড়না।
গ্রীষ্মে এখানে স্নান করি আমি;
ডুব দিলে মনে হয়,
রতি স্নিগ্ধ নারী
আমার মুখ নিয়ে ঠেসে ধরেছে
তার স্তনজোড়ায়!
আমি শ্বাস নিতে মুখ তুলি যখন,
কানের কাছে এসে, সে এক বীতশোক ভ্রমর
উড়ে উড়ে গুঞ্জন শানায়:
সে গুঞ্জরনের অনুবাদ হয় না,
যেন রাতের কণ্ঠ থেকে কিছু অনন্বয়ী অব্যয়...
তারপর ফিরে আসি,
সলজ্জ তোমাকে বলতে পারি না,
ডুব দিয়ে আজ
সব দূরত্ব পেরিয়ে যেতে চাই!