তালাবন্ধ। আপাতত দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে একটা তারিখ পর্যন্ত । কিন্তু তারপর ? খুলে যাবে কি - মুক্ত হবে কি একটা অধিক জনসংখ্যার দেশ স্বাভাবিক গতি -আবার স্বাভাবিক হবে কি ছটপটে ঘিঞ্জি একটা দেশ - যার নাম ভারত । আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে । তবে খুলবে - সেই আসায় এখন চুপচাপ ঘরবন্দী শতকরা সত্তর শতাংশ মানুষ । স্রেফ চুপচাপ । আতঙ্ক আর আশঙ্কা । এই দুমাস আগে যারা মন্দিরে মসজিদে গির্জায় প্রার্থনা জানাতো, হত্যে দিত , তারা এখন কোন দেবতার কাছেই যাচ্ছেন না । বুঝে গেছেন সকলে - দেবতা রক্ষা করতে পারেন না আর - তালা খোলা তো দূরের কথা , যখন একটা ভাইরাস কুরেকুরে খাচ্ছে মানুষের ফুসফুস , কুরে খাচ্ছে মানুষের নিশ্বাস তখন দেবতাদের কিচ্ছু করার থাকে না । তারাও বন্দী তালার ভেতর । নিজের রক্ষার জন্য নিজের চেষ্টাই শ্রেষ্ঠ পথ । অবশ্য যদি রক্ষা করার মানসিকতা থাকে । কেননা মানুষই মানুষকে রক্ষা করতে পারে । একটা সভ্যতাকে মানুষই ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচতে পারে , তাই মানুষই সভ্যতার প্রতীক ।
তবে ? এই তবে থেকেই বুঝতে পারছি এটা কেবল বাহ্যিক । গালভরা সুত্রের মতো । প্রয়োগ করবে কে ? পরিস্থিতি এমনই মানুষকে রক্ষা করার মানসিকতাও রাজনৈতিক। একটা ভাইরাস আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আরও কত ভাইরাসের মুখোমুখি । ১. দারিদ্র্য ২. শিক্ষার প্রতি বিরূপ মানসিকতা ৩. অনুন্নত স্বাস্থ্য পরিসেবা ৪. প্রশাসকের গাফিলতি।
এছাড়াও আরও কত ভাইরাস জেগে ওঠছে এই সময় । আমাদের এখন যা প্রয়োজন তা হল পরীক্ষা করা , পরীক্ষায় বসা । তা আর হচ্ছে কই ? ন' কোটি মানুষের বাস এই পশ্চিম বঙ্গে - প্রতিদিন টেস্ট হচ্ছে মাত্র সীমিত সংখ্যক । সরকার বলছেন পরিসেবা নেই । সরকার স্বীকার করছেন নাকি লুকোতে চাইছেন ? সে কারনে বুঝতে পারছি না কার সংক্রমণ আছে । আমার পাশের মানুষটি সংক্রমিত নয় তো - কিংবা আমি । যে কারনে আমি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে আমার পরিবারকে, আমার প্রতিবেশি পাড়া কে, আমার গ্রামকে । তার দায় অবশ্যই প্রশাসনকে দিতে পারি - একক হিসেবে আমিও , কেন না আমিও তো এই বিপন্নতার অংশীদার ।
কী আশ্চর্য দেখুন -আমরা একজনও চাইছি না আক্রমণের আশঙ্কা দীর্ঘস্থায়ী হোক - সকলেই চাইছি দ্রুত নিরাময় - আবার মুক্ত হাওয়া, মুক্ত আলো - সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ । প্রশাসক থেকে নিম্নবিত্ত । বাধাটা কোথায় ?
কিন্তু পারছি কই? এই যে বাকি তিরিশ শতাংশ ? তারা বলে বেড়াচ্ছে - দূউউর আমাদের এখানে ওসব ভাইরাস টাইরাস আসবে না । তারা এখনও আড্ডা মারছে বেঞ্চি তৈরি করে । সেখানে বসে বিড়ি টানছে - আর পাড়ার পিসি দিদি বৌদিদের সাথে মস্করা করছে । যদিওবা হঠাৎ করে সিভিএফ টহল মারতে আসে - তবে নিমেষেই হাওয়া । তারপর যথারীতি একই । এ রকম আরও কত ছবি । বেশ আছে - বিনে পয়সার রেশন, ধনজন যোজনার পাঁচ'শ টাকা আর উজালার গ্যাস নিয়ে । রেশন তোলার জন্য ভিড় জমাচ্ছে আর সেই ফাঁকে ডিলারেরা চুরি করে চলছে সেই রেশনের চাল। শোকজ হচ্ছেন বিভাগীয় পদস্থ প্রতিনিধি । কিন্তু সবই প্রহসন । কে বেশি ঠিক? কে বেশি সংবেদনশীল ? কে বেশি নৈতিক ? এমনকি কার বেশি দুঃখ ? এসবের ভবিষ্যৎ কী ? ওই নিয়ে আলাপ আলোচনা আর স্মার্ট ফোনের যতসব মিমিক্রি বুঝতেই পারছে না সংক্রমণ বাড়লে কি ভয়ঙ্কর পরিনাম হতে পারে ।
তারপর আছে লঘু গুরু । কে আর কাকে পাত্তা দেয় । ভোট আছে - গনতন্ত্রের নামে প্রকট হচ্ছে সুবিধাবাদ ।
এত সবের মাঝেও সরকার চাইছেন সংক্রমণ ওভারকাম করতে । কী রাজ্য সরকার কী কেন্দ্র সরকার । প্রশাসক হাতে লাঠির বদলে তুলে নিয়েছেন গান । সচেতনতার জন্য গান গাইছেন তারা । আমাদের নিরাময় দিতে চান । লড়াই করছি আমরাও । এ লড়াই ঘরে বসে থাকার লড়াই । এ লড়াই আমাদের কাছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ । শত্রু কে আমরা জানি না । তার হাতিয়ারও অদৃশ্য । তবু লড়াইয়ে জিততে চাই । জিততে চাই সামজিক দূরত্ব বজায় রেখেই ।
আমি দেখতে পাচ্ছি অতীতের সেই সাদা কালো ছবি - মন্বন্তরের ছবি ; মা রূগ্ন সন্তানের মুখে তুলে দিচ্ছে শুকনো স্তন । তাতে ছিটেফোঁটাও রস নেই - সন্তানের ক্ষুধার্ত কান্না নিয়েই শূন্যে এনামেল বাটি তুলে ধরেছে হাড় সর্বস্ব মা । আসতে চলছে কি সেই সময় ? তার সাথে দেখছি ক্রমশ অসহিষ্ণুতা আর অসন্তোষ । হবে নাই বা কেন ? মতপার্থক্য, মূল্যবোধে'র পার্থক্য, সব থেকে বড় কথা ব্যক্তি বিশেষের পার্থক্য । এর মাঝেই বাড়ছে ক্ষুধার পরিধি । চলছে অর্থহীন তুলনার মাপকাঠি ৷
এখনও নিজেরা ভাত আর সব্জি খাই । বেঁচে থাকলে হয়তো কিছুদিন পরে শুধু ভাতই পাব। খেতে খেতে বারুই পাড়ার বুড়িটার কথা বলি - যে দু বেলা মুড়ি খেয়েছে গত তিন দিন । শুকনো মুড়ি । জল ঢালে নি - যদি নেতিয়ে কমে যায় মুড়ি ! তার করোনার ভয় নেই, আছে পেট খালি হওয়ার আতঙ্ক ।
তবুও প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে এই ভেবে ঘুম আসে যে - আগামী কাল ভোরেই পেয়ে যাব ভাইরাস মুক্তির প্রতিষেধক । সমস্বরে গেয়ে উঠব - আমরাই পেরেছি , জয করছি সমস্ত ভাইরাসের সংক্রমণ । আবারও প্রমাণ হয়ে যাবে - মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই ।