খুকু ভূঞ্যা-র এক গুচ্ছ কবিতা
অন্নপূর্ণার হাসি
পাখির ঠোঁট থেকে খসে পড়া খড়কুটোর মতো নিঃস্ব করে দাও
যত বেশি যন্ত্রনা থাকবে ঝড়ের সঙ্গে সখ্যতা ঘটবে অনেক বেশি
সময়ের পঞ্চমুখী ফনা, পাঁচ দিক থেকে ছোবল দিলে সামাল দিতে পারবে না ধানকাটা হাত
এভাবে সরে এসে প্রশ্ন কোরো না সূর্যোদয় ভালো লাগে?
মায়ের মুখে ডুবে আছে সমস্ত ঈশ্বরীর মুখ,ভাসান
কতবার হলো আমারও বোধন বিসর্জন
জন্ম মৃত্যুর কোলাহল পেরিয়ে দাঁড়িয়েছি মহাকালের নিচে
যদি দিতে চাও ফুল্লরার ঘরকন্না দিও,আর অন্নপূর্ণার হাসি
মায়া গভীর হলে
আকস্মিক চোখ টলটল
ভেজা দৃষ্টি একের পর এক ছায়া ধরে আনে
নীড়ের একদিক ফাঁকা হলে মা পাখির কাঁপন থাকে না হৃৎপিণ্ডে
একপায়ে দাঁড়ানো তালগাছে ঝুলে থাকতে থাকতে ভাবে
বাঁসা খালি পড়ে থাকে একদিন, একদিন ---
মৃন্ময়ী কাঁদে মাটি ব্যথায়
জানতে পারে না তৃতীয় চোখ কখন ভেসে যায় ভাসানের জলে
তবু কি তীব্র মায়া
দূরে শ্যামাসঙ্গীতে রামপ্রসাদ বলে ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়
যার জন্য মরো কেঁদে সেকি তোমার --
মায়া গভীর হলে ভালোবাসা আরো রঙিন হয়
কেউ থাকে না তবু স্নায়ুতে স্নায়ুতে ডাকাডাকি
অশ্রুঘাস বেড়ে যায় চোখে চোখে
আদুল মন ক্রমশ বৃক্ষ হয়ে ওঠে
তার আসার সময় হলো
ঘোড়া পোকাটিও ঘুমিয়ে পড়ো এবার
তার আসার সময় হলো
না না হাতে বাঁশি নেই মাথায় ময়ূর পাখা
দেখতে অবিকল মানুষ অথচ মানুষের থেকে আলাদা
তার জন্য আমি জেগে আছি ভরা অঘ্রানে
বাঁশ পাতায় লেখা হচ্ছে চাঁদ পাঁচালি
মাটির ঘাস শুধু জানে সে একান্ত আমার
কয়েক ঘন্টার জীবন
তাকে বলা জরুরি এবার আমাকে শাপমুক্ত করো
নক্ষত্র ঢেলে দাও আঁচলে
আমার মানস ঈশ্বর রোদের পদচিহ্ন খুঁজছে অশ্রু দগ্ধ চোখে
ঈশ্বরীর ছায়া পেরিয়ে
ভাত রাঁধতে রাঁধতে ভাবি যদি মূর্তি হতাম --
বাঁশ খড়ের কাঠামো গড়ে মাটি লেপে দিত কেউ সারা গায়ে অতঃপর
রঙ পড়ত সারা শরীরে
হঠাৎ চক্ষুদান
দেখতে পেতাম,দীপ জ্বেলে আরতি করছে পুরোহিত
কাঁসর ঘন্টা বাজছে, দ্রিম দ্রিম ঢাকের আওয়াজ
বধূ ঈশ্বরী
সমস্ত শরীরে আলো বজ্র
ত্রিচোখ থেকে ঠিকরে আসছে বরাভয় জ্যোতি
লুকিয়ে স্বপ্ন দেখা প্রেমিক হাতজোড় করে প্রণাম করছে
মাতা পিতা করজোড়ে --
পিতামহ প্রপিতামহ --- আত্মীয় স্বজন পড়শী --
দীপ ধূপ কাঁসর ঘন্টা নৈবেদ্য আমার স্বজন
গর্ভগৃহ আমার বাসভূমি
মাঠ আকাশ আলপথ মুক্তি প্রতিদিনের পূজার চাপে--
আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলো হাওয়া
দেউল বন্দী ঈশ্বরীর ছায়া পেরিয়ে অনেকদূর --
যেখানে মাঠভর্তি ধান, আকাশ ছুঁয়ে আছে দিগন্তের ছাদ
প্রেমিক দাঁড়িয়ে জামফুল নিয়ে ঘাসঢাকা আলপথের বাঁকে
জানি তুমি নিভে যাবে
হেঁটে যাওয়া আলপথ, রোদের ঘরকন্নায় বেড়ে ওঠা ঘাস
সবুজের আভা লিখতে লিখতে
কত মৃত্যুচিহ্ন তার গায়ে মাথায়
কত না বার্ধক্য বৈধব্য
ঘাস প্রজন্ম রয়ে যায় সীতার বরে
ঝরে যায় মানুষ ঝরা পালকের মতো
জানি তুমি নিভে যাবে একদিন সন্ধ্যার দীপশিখার মতো
তাই বলে ভরা দুপুরে-
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তুমি কি শ্মশানের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলে -
অনেক কথা বাকি থেকে গেল
তোমার ব্যর্থতার কথা আমার পরাজয়ের কথা
সারাজীবন আমাদের অশ্রু বন্ধক রইল শুধু পরাজিত জীবনের কাছে
যে জেগে আছে
কিছু ভুলের ক্ষমা হয়না
হাজারো তুমি করজোড়ে দাঁড়ালে মাথা ঝুঁকিয়ে ভীষণ অপরাধীর মতো
তোমার অন্তর অনুশোচনায় দগ্ধ মর্মাহত
ক্ষমা পেয়ে গেলে হয়তো যাকে তুমি নদীর বুকে ছুঁড়ে দিয়েছো
কিন্তু যে তোমার ভেতর জেগে আছে অতন্দ্র প্রহরী
তার কোনো সকাল রাত্রি নেই
শুরু শেষ নেই
জন্ম মৃত্যু নেই
কেবল তোমাকে দেখছে নিথর মূক
তুমি তাকে না জানিয়ে একটার পর একটা ----
ঝুঁকে পড়ছে তোমার জন্ম কলঙ্ক ক্রমশ অধঃপাতের দিকে
যাকে ভাঙতে চেয়েছো
হাত ছুঁয়ে আছে অঙ্কুর ধান
তুমি খরার গল্প লিখতে লিখতে যদি মরুভূমিতে পথ হারাও
ফসলের কোনো দায় নেই
দেখো আজ চাঁদ নেই
দূরে মিটমিট করছে নক্ষত্র
দেখা যায় না পরস্পরের মুখ
তবু যদি ভাবি সে কাল চাঁদ এনে দেবে
সূর্য শুইয়ে দেবে উঠোনে
মূহুর্তেই ধনী হয়ে যাব
যাকে ঝুমঝুমির মতো ভাঙতে চেয়েছ ডেকো না
দূরে দাঁড়িয়ে দেখো
মাটি ঈশ্বরী হয়ে উঠছে ক্রমশ উঠতি বালিকার মতো
ছায়াসঙ্গী
ছায়ার কোনো পিছুটান নেই
আমাকে পেছনে ফেলে সে এগিয়ে যাচ্ছে
তাকে ধরার জন্য যত এগোচ্ছি সে তত সূদূর
আমার পায়ে লেগে লাল মোরামের ধুলো
সে চলেছে ঘাসের বুকে মাথা রেখে
কানশিড়ে আকন্দ নাকমাছি ফুল ছুঁয়ে
হাঁটতে গিয়ে আমি হোঁচট খেলাম
সে ঝুঁকে পড়ে শ্মশানের সাদা কাপড়ে মুখ মুছছে
ভাঙা কলসিতে ঠেকে যাচ্ছে তার মাথা
মৃত্যুকে যত স্পর্শ করছে অমর হয়ে যাচ্ছে
ছায়ার কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই অনুভূতি নেই
তাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছি অথছ জানি না
আমি তার কে, অথবা সে আমার --
আমার আগে যে ছুঁয়ে দিচ্ছে রোদ
আমাকে ডিঙিয়ে কোথায় যেতে চায় সে
ভাবতে ভাবতে সূর্য নিভল
ডুবে গেলাম সঙ্গী বিচ্ছেদের দিশাহীন দহে
দুই পিঠে আগুন
সূর্য নয়, এক অগ্নিময় পুরুষ অনাদিকাল জ্বলতে জ্বলতে নিদারুণ প্রার্থনা
আমাকে তুলে নাও প্রেম যেখানে জমে ক্ষীর
শিশির ভালোবাসা স্নিগ্ধ নরম
আমাকে জুড়িয়ে দাও কৃষক জননী, পুষ্প প্রেমিকা
আগুনও বসন্ত চায়
ঘাস লতাপাতার নিবিড় স্পর্শ
কেন তুমি বোঝনা পশ্চিমের মাঠ
তোমায় শস্য সম্ভবার গন্ধ যোগাতে আমার প্রেমিক হওয়া হলো না
দেখো দুই পিঠে আগুন
আমাকে কোলে নাও জননী, শুদ্ধা বসুন্ধরা
স্বতন্ত্র
কিছু ইচ্ছেকে স্বাধীন করে রাখতে চাই
যা আমাকে প্রতিনিয়ত ভাবাবে জীবন অত সহজ নয়
চাইলেই ত্যাগ করব অথবা গ্ৰহন
কেউ এসে সবসময় চোখ রাঙিয়ে বলুক এ রাস্তা তোমার নয়
আঁচলে বেঁধোনা আকাশ
তুমি আমার গণ্ডিবদ্ধ ভালোবাসা ঘর
মুক্তি সাজিয়ে রাখবে চোখ
যা তোমার নয়
কিছু ইচ্ছেকে ছেড়ে দিতে চাই, অসীমের পাখি
ভেজা চোখ কাঁদবে চিরদিন
প্রিয় থেকে প্রিয়তর
তবু অনেক রক্তের ভেতর বাঁচিয়ে রাখব নিজস্ব মাটি ,সিফন ঘাস