বিজ্ঞাপন



narjole rajbari fn

নাড়াজোল রাজবাড়ির পয়লা পার্বণ ।। দেবাশিস ভট্টাচার্য

 

মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পূর্বে এবং ঘাটাল মহকুমার দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি প্রাচীন জনপদ নাড়াজোল। কাঁসাই ও অদূরবর্তী কাঁকি নদী এবং উত্তরে প্রবহমান শিলাবতী এই উর্বরভূমি পরিণত করেছে। সুদীর্ঘকাল ধরে এই জনপদ অবিভক্ত মেদিনীপুরকে সমৃদ্ধ করেছিল। ৬০০ বছর আগে উদয়নারায়ণ ঘোষ নাড়াজোলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ণগড়ের রাজপরিবারের সাথে এঁদের আত্মীয়তা ছিল। কর্ণগড়ের রানি শিরোমণির মৃত্যুর পর মেদিনীপুর জমিদারি, খাঁন পরিবারের দখলে আসে। তারপর থেকে নাড়াজোলের রাজবংশ বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী। কিন্তু রাজবংশের ধারাবাহিক ইতিহাস আজ অন্ধকারে বিলুপ্ত। জেগে আছে বিরাট রাজপ্রাসাদ, ভগ্নমন্দির, হাওয়া মহল, রাসমঞ্চ, গড়-দূর্গ, আর পরিখা। এই বংশের রাজারা দেশরক্ষা, লোকরক্ষা ও লোকহিত কর্তব্যে গৌরবান্বিত ছিলেন। এই রাজবাড়িতে সুভাষচন্দ্র বসু, ক্ষুদিরাম বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো, কাজী নজরুল ইসলামের মতো অনেক বিশিষ্ট মানুষের পদার্পণ ঘটেছে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে যোগাযোগ ছিল নাড়াজোল রাজবাড়ির। রবিঠাকুরের সাথেও চিঠিপত্র আদান-প্রদানের ইতিহাস রয়েছে।

narajole rajbari 2

নাড়াজোলের নগর-সংস্কৃতির বিকাশে রাজপরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা নাড়াজোলকে সঙ্গীতে, চিত্রকলায় সমৃদ্ধ করেছিলেন। বিষ্ণুপুর ঘরানার রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় নরেন্দ্রলালের গৃহশিক্ষক ছিলেন। মহেন্দ্রলাল খাঁন বাংলার পদাবলী সাহিত্যে এক স্মরণীয় নাম। দশম রাজা মোহনলাল খাঁনের সময়কাল থেকে বিভিন্ন সময়ে উৎসব পার্বণের সূচনা হয় নাড়াজোলে।

narajole rajbari 3

বারো মাসে তেরো পার্বণ হতো নাড়াজোল রাজবাড়িতে। উৎসব ছিল বারোয়ারি। মহেন্দ্রলাল পদকর্তা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন বঙ্গসমাজে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় "গোবিন্দগীতিকা"। মহেন্দ্রলালের ভাই উপেন্দ্রলাল খাঁন প্রতিষ্ঠা করলেন শিবমন্দির। গাজনের পূর্বদিনে সন্ন্যাসীরা রুক্ষ্ম মাথায় গেরুয়া রঙের ধুতি কোমরে বেঁধে চলেছে কলসি ভরে জল ভরতে। গলায় তাদের জবাফুলের মালা। মহেন্দ্রলাল খাঁন ঠিক করলেন ১ লা বৈশাখে করবেন নববর্ষের উৎসব। নতুন বছরের আনন্দকে ভাগ করে নেবেন আত্মীয় কর্মচারী ও প্রজাদের মধ্যে। সেই সময় হতো গোয়ালাদের গোষ্ঠ বিহার। এই অঞ্চলের গোয়ালারা বিকেলবেলায় সুসজ্জিত গরুর গাড়িতে রাজবাড়িতে আসতেন। সঙ্গে থাকতো ঢোল, কাঁসি। মহেন্দ্রলাল গোয়ালাদের আসতে বলতেন দুপুরে। ১ লা বৈশাখ সকাল থেকে বেজে উঠতো নহবত। নাটমন্দিরে বসতো আসর। পটের গান, পালাগান, কীর্তন ইত্যাদি। মধ্যাহ্নে  ভুরিভোজ। নাড়াজোলের ময়রারা তৈরী করতো মুগের জিলিপি, লাড্ডু, গুপচুর আরো কত কি মিষ্টি।narajole rajbari 4

 

তারপর রাজাবদল- পালাবদল- রংবদল হয়ে সময়ের তরণীতে ভেসে গেছে ১৩৭ টি বছর। কিন্তু নাড়াজোলের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল একেবারেই নষ্ট হয়নি। সংগীত চর্চা এই অঞ্চলের প্রাণ। কান পাতলেই ঠুমরি দাদরার তাল ভেসে আসে। এই রকমই কয়েকজন গান পাগল মানুষ তৈরি করেছেন 'বন্দীশ' নামের এক গোষ্ঠী। আমিও সেই গোষ্ঠীর একজন। আমরা প্রতিবছর আয়োজন করি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর। একদিন চায়ের আড্ডায় ঠিক হয় নববর্ষের আড্ডা বসানো হবে। রাজবাড়ির পরম্পরাকে আবার নতুন করে দেখা।

narajole rajbari 5

১৪২৪ বঙ্গাব্দের ১ লা বৈশাখ নাড়াজোল রাজবাড়িতে ১৩৭ বছর পর বসলো নববর্ষের আড্ডা। আম্রপল্লব ও কলাগাছ দিয়ে সাজানো হলো নাটমন্দিরের দালান। কবিতা- গান -আলোচনায় ভরে উঠলো সারা সকাল। মধ্যাহ্নে পান্তাভাত, বেগুন পোড়া, আলু পোস্তো, শাক ভাজা, কাসুন্দি সহযোগে প্রীতিভোজ। এই মেনু ১লা বৈশাখের স্পেশাল প্রতিবছরের জন্য। আর থাকতো আমপোড়ার শরবত।

narajole rajbari 6

১৪২৫ বঙ্গাব্দের আমাদের আড্ডা আরো প্রচার পেলো। ১৪২৫ এর আলোচনার বিষয় ছিল 'নববর্ষের একাল-সেকাল' । সঙ্গে পটের গান, বাউল গান, শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন। ১৪২৬ এর আলোচনায় ছিল ‘বাংলা নাট্যমঞ্চের গান’ ।  ভাদু, টুসু, ভাটিয়ালির সুরে মিশে গিয়েছিল পদাবলী কীর্তন। আর অবশ্যই মেনুতে ছিল পান্তাভাত বেগুন পোড়া। ১৩৭ বছর পর নতুন ভাবে নাড়াজোল রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত এই নববর্ষের আড্ডায় অংশ নেন লোকসংস্কৃতি গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী বন্ধুরা। আগ্রহী শ্রোতাদের ভিড় নতুন করে প্রাণ পেয়েছে এই রাজবাড়ির আনাচকানাচ। বছরের বিভিন্ন সময়ে নাড়াজোল রাজবাড়ির ভগ্নপ্রাসাদ, হাওয়ামহল, সারিবদ্ধ শিবমন্দির, দেবী জয়দুর্গা, রাসমঞ্চ, নাটমন্দির, রথ দেখার জন্য লোক সমাগম হয়। গবেষকদের এই রাজবাড়ির প্রতি ঔৎসুক্য হারিয়ে যায় নি এখনও। রাজকীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন আজও টানে মানুষকে।  তবে নতুন করে এই নববর্ষ উদযাপন নাড়াজোল রাজবাড়ির প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে।

narajole rajbari 7

১৪২৭ বঙ্গাব্দে আমাদের পরিকল্পনা ছিল ১ লা বৈশাখের অনুষ্ঠানটি নাড়াজোল রাজের লঙ্কাগড়ে অবস্থিত জলহরিতে করার। 'জলহরি' কথার অর্থ সামারহাউস। মোহনলাল খাঁন ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন জলের মধ্যে একটি সুরম্য প্রাসাদ। এই প্রাসাদেই এবছর বসতো নববর্ষের আড্ডা। পরিকল্পনা মতো নৌকার ব্যবস্থা করা ছিল। কিন্তু বিশ্বমহামারী আমাদের সেই আয়োজনে ব্যাঘাত হানলো। পৃথিবীর এখন গভীর অসুখ। করোনার সংক্রমণ থেকে মনুষ্য সমাজকে বাঁচতে হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নাকি গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ। কিন্তু এই পথ আমাদের মানসিক অবসাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তবুও জেগে আছি, জেগে থাকবো। পৃথিবী আবার মধুময় হয়ে উঠবে একদিন। আর নিশ্চয়ই পরের বছর দেখা হবে ১লা বৈশাখের আড্ডায় নাড়াজোল রাজবাড়িতে।

                               

 

*  নাড়াজোল রাজবাড়ি৯৭৩৫৩১২৪৭১

* চিত্রশৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়

 

narajole rajbari 1

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...