নিরঞ্জন জানা-র এক গুচ্ছ কবিতা
ডাক
একতারা আর মাধুকরী নিয়ে
বাউল কিভাবে জীবন কাটায়?
একতারায় কি এত প্রেম !
আমিও বাউল হবো
আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়াবো,
আউলা বাউলা জীবন কাটাবো বলে
যেই ঘর ছেড়েছি---
অমনি এমন করে তুমি ডাকো
আমি আর মুখ ফেরাতে পারিনি
ফিরে আসি,
ঐ ডাকে যে কি আছে
আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।
হাসি
হাসি কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে
ডোডো পাখির মতো লুপ্তপ্রায় !
স্ত্রী হাসে তো স্বামীর মুখ গোমড়া
আবার কখনো স্বামী হাসে তো
স্ত্রীর মুখে হাসি নেই।
শুধু, একসাথে হাসে
ক্যামেরার সামনে ।
আজকাল
এবার বসন্ত এলে, মাদলিয়া পরবে
পিরিতি ফুল ফুটবে, মহুল লেশায় বুঁদ হয়ে
উয়ার খোঁপায় বন পলাশ দিব গুঁজে ।
বনটিয়া কেঁদে কেঁদে বলে যায়--
গ্রাম নেই গ্রামে, বন পোড়া গন্ধ,
দূষণের প্রাচীর দিয়েছে তুলে। তবু,
আজ যে বসন্ত এলো শীত ঠেলে ঠেলে
আগামী পরবে সে যদি ফিরে যায়
শীতের উঠোন থেকে--
উয়ার খোঁপায় তখন কী গুঁজে দেবে?
মাদলিয়া পরবে তখন পিরিতি ফুল ফুটবে?
বাসা বদল
পাখছানা যেই এ ডাল ও ডাল করে
উড়তে শিখল, অমনি বাসা ফেলে ফুড়ুৎ।
ছোট দাদুর ব্রিলিয়ান্ট ছেলে বিলু
সেই যে বিদেশে উড়ে গেল-- সেও
বাপের বাসায় আর ফিরে আসেনি।
পাড়ার ঘন্টু কাকা সেও ঝোপ বুঝে
কোপ মারে
আজ বামে তো কাল রামে।
যৌবনের নদীও
নাচতে নাচতে চলে যায় মোহনায়,
আমাদের আদুরি পিসিকেও দেখেছি
হাসি হাসি মুখে সেই দাদার বাসায় উঠতে
যখন যার ভরা পৌষ মাস।
একমাত্র মা-ই থেকে যায়
তার অভাবী ছেলের বাসায়।
অভিমান
নারীর বুকে
আস্ত একটা নদী শুয়ে থাকে
ভালোবাসা পেলে বেরিয়ে আসে
স্নিগ্ধ জলধারা
বাঁকে বাঁকে গড়ে তোলে সোহাগের মাঠ
আদরের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়
দুঃখ নদীর চর
সাজিয়ে দিতে পারে জীবন উপত্যকা।
সব কিছু পারে, সে সব-ই পারে--
শুধু পারে না,
অভিমানের পাথর ভাঙতে ভাঙতে
মোহনায় মিশে যেতে।
ফোনেটিক লাভ
রোজ সকালে একটা ফোন আসে
ফোনটা ধরলেই বলে--" হ্যালো !
কেমন আছো, কি করছো?"-- বলেই
কেটে দেয়।
ফোনটা রোজ-ই আসে
তবে, সেদিনেরটা একটু অন্যরকম।
ফোন ধরতেই অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে
আসে ---"তোমাকে রোজ দেখি,
তোমার প্রোফাইলে প্রতিটি জিনিস দেখি,
তোমার কথাও শুনি।
তোমার কথাগুলো ভারি মিষ্টি... তোমাকে
আমার খুব, খু উ ব ভালো লাগে
যে ভালো লাগা দিন দিন
একটা অন্য যায়গায় পৌঁছে গেছে ।
পরের দিন আবার ফোন
সরাসরি জিজ্ঞেস করল ---"তুমি কি
বিবাহিত, না অবিবাহিত?
আমি খানিকক্ষণ চুপ... কি বলব কি বলব
অনেকক্ষণ পর, ভেবে বললাম --
'আমি আমার বউকে জিজ্ঞেস করে বলব।'
মানুষ চাই
বৃষ্টি, তুমি আমার জন্য একটা নদী আনবে?
--কেন? আমার কান্নায় তোমাকে নদী
দিইনি?
-- আমরা তো তাকে মেরে ফেলছি...
বাতাস, তুমি কি আমাকে একটা পাহাড়
এনে দেবে? যার নিজস্ব একটি নদী আছে
--কেন? তোমার চারপাশে তো অনেক
পাহাড়
-- আর বলো না, লজ্জা হয়
যেভাবে আবর্জনার পাহাড় গজাচ্ছে...
একদিন হয়তো নদী হারিয়ে যাবে !
বৃষ্টি ও বাতাস সেদিন একসাথে বলেছিল,
" কবি সত্যি করে বলতো তোমার কী চাই?"
--মানুষ চাই, যে বুঝবে বৃষ্টির দুঃক্ষ
পাহাড়ের কষ্ট, নদীর যন্ত্রণা--- সেই রকম
মানুষ চাই।
মানুষতো তোমার চারপাশে অনেক আছে
-- তাদের দেখতে অবিকল মানুষের মতো।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন দেখে শুনে শুধু হাসি
আজকাল, আর কিচ্ছু বলিনা।
" তুমি যদি আমাকেই দাও
তাহলে দিতে যেতে হবে না,
বাড়িতেই থেকে যাও।"
রং বদলায়, দল বদলায়
মুখ ও বিজ্ঞাপন একই থেকে যায়।
অভাব
আজকাল, মালীবুড়ো বড্ড রেগে যায়।
তার সখের বাগানে
নানা রঙের, নানা রকমের পাখি
রোজ উড়ে এসে বসে, দোল খায়,
কিচিরমিচির করে, গান গায়।
অবশ্য-- এজন্য রাগ করে না।
গাছের ফল ঠুকরে ঠুকরে খায়--
এজন্যও রাগ করে না,
রাগ করে
একটুখানি খেয়ে যায় বলে।
সেদিন মালীবুড়ো রেগে গিয়ে
বলে," হতচ্ছাড়া, তোরা একটুখানি
খাস কেন? পালা !"
পাখিরা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল
খসে পড়ল একটি হলুদ পালক,
পালকটি হাওয়ায় উড়ে উড়ে
বাতাসের গায়ে লিখে দিল--
"মালীবুড়ো, আমরা এত কম খাই বলেই
আমাদের অভাব হয় না।"
ভয়
আগে কুকুরকে ভয় পেতাম
একসময় সাপকেও। তবে,
আজ আর ভয় পাই না।
ওরা হাসতে হাসতে
ভালোবাসতে বাসতে
আদর করে কামড়ায় না ।
আজকাল ভয় পাই
মানুষকে।