শাশ্বতী ভট্টাচার্য-এর এক গুচ্ছ কবিতা
খাবার
১।
একটা লম্বা রাস্তার গল্পে আমি ছোটা শুরু করলাম।
আপনারা তখন অবশ্য অনেকটাই এগিয়ে।
কারণ গল্পটা আপনারা শুরু করেছিলেন
আমার অনেক আগে।
আমার তখন চাঙ্গা রক্তের ইতিহাস,
আর সবল এনার্জির ভুগোল।
আর আপনাদের তখন আসন্ন জয়ের ইঙ্গিত
আর তৃপ্ত স্বপ্নের হাউমাউ।
আমি বেগ বাড়ালাম, আপনারা কমালেন।
দূরত্ব কমে আসলো।
সামনে শেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে
আপনারা আমাকে লম্বা হতে দেখলেন,
মাঝরাস্তায় গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে
চালাকির সাথে উপহাসের যৌগ মিশিয়ে দিলেন।
আমি দুপেয়ে কাঁকড়ার দল দেখতে দেখতে
এগিয়ে গেলাম আরও।
কাঁকড়া বড় হতে লাগলো, আর আমার ছায়া, বুড়ো...
তারপর একসময় দেখলাম কেউ নেই,
কিচ্ছু নেই, এমনকী আমার ছায়াও
লাইন দিয়েছে পিছনে।
আর সামনে একটা বিশাল বড় খিদে
লকলকে জিভ আর চকচকে চোখ...
আমিও আপনাদের মতো খাবার হয়ে গেলাম নাতো?
২।
খাবার হবার আগে শেষবার পিছন ফিরে দেখি,
তোমরাও তখন শুরু করেছো ছোটা
যে পথ পেরিয়ে এসে আজ
আমিও থমকে দাঁড়িয়েছি।
তোমরা বেড়ে উঠছো,
লম্বা হচ্ছে তোমাদের ছায়া তোমাদের মতোই।
দূরত্ব কমে আসছে সময়ের সাথে।
চলো, এইবার একসাথে ঝাঁপ দিতে হবে।
হাত ধরো, গায়ে গায়ে থাকো।
ঐযে প্রবল খিদে, প্রকট সে বিগলিত হাঁ ...
তার উপর হেঁটে যেতে হবে, আহুতির মতো
অথবা আগুন হও, মেখে নাও মোমের শরীর।
গলনের শেষে যাতে আবারও আগুন খেতে পারো।
লড়াই
এক একটা লড়াই যেন
বিশাল একটা আকাশ।
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর পথ,
ভালোবাসার মতো জ্যোতিষ্করা
মূর্ত দিকে দিকে,
মেঘের মতো চিন্তারা নেমে আসছে
মাথার উপর।
ভিজিয়ে দিচ্ছে একা হাঁটাপথ।
এক একটা একাকিত্ব যেন
এক একটা অসংযত ঝড়…
চূড়ান্ত বৃষ্টির পর
নাবালক হাওয়াটির মতো
ধীরে ধীরে বন্ধু হয়ে ওঠে।
ঘুম
বন্ধ চোখ, ঘুমপাখি গান থেকে উড়ে
চাঁদের ছবিতে মাথা রাখে, পাড়ি দেয় অকপট মেঠো ধূলিপথ।
ওখানে মানুষ জাগে, জেগে থাকে হাড়গিলে শিশু।
চাঁদকে খাবার ভাবে, দুচোখে খরার ছবি এঁকে
যত ঘুম দ্রবণীয় , ফোঁটা ফোঁটা মোমের শরীরে
জ্বেলে রাখে রাতভোর, জেগে থাকে পৃথিবীর মতো,
সোহাগবিহীন কোনও বিরতির একমাত্র ক্ষত।
ঘুমাও মৃতের মতো, ঘুমাও হে শোকস্তব্ধ রাত।
যে এখনও ভেসে আছে, অন্ধকারে, জলের গভীরে
অপেক্ষার রাতদিন, আলো আর স্বপ্নময় পথ
পাড়ি দেবে নবজন্মে, তার ঘুম ভাঙিও না শুধু।
তোমরাও দুচোখ বুজে সে ঘুমের আরাধনা করো।
আমি আছি, জেগে আছি, চোখ হাতে নিয়ে
কখন নজরে পড়ে ঘুমের ভেতর
হেঁটে যাচ্ছে শিশুটিও, কোটরে আগুন
ঘুমাচ্ছো ঘুমাও সব শবের মতোন,
আজ রাতে চাঁদ মেখে নিশাচর হবো ওর সাথে।
চার পংক্তির কবিতারা
১।
যদিও আগাছা তবু
মাথা তুলি, বড় হতে জানি,
তোমার অবজ্ঞা যাকে,
আমি শুধু শক্তি বলে মানি।
২।
লিখেছো অনেক কথা,
ফুল, ফল, নারী, মোহ, সুখ…
যে কথা পারো নি লিখতে
তা ওদের আতঙ্কিত মুখ।
৩।
রাত বাড়ছে, আরও বাড়ছে
দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছি।
জেগে আছে আমাদের
পাশবালিশের ভেজা দেহ।
৪।
জরাজীর্ণ হয়েছে এ পথ
নদীটিও ভুলে গেছে গতি।
সমঝোতা স্থায়ী হয়ে গেলে
চলার লাগে না সঙ্গতি।
৫।
ভয়ের সঙ্গে ঘর বেঁধেছি, বেঁধেছি গাঁটছড়া
শিরদাঁড়াতে শান দিয়েছি সহস্রবার, তবু
চোখ মেলাতে গেলেই কেমন রাত্রি আসে নেমে।
অন্ধকারে বাড়তে থাকে দ্বন্দ্বের আস্কারা।
৬।
কেউ কি দেখেছো মাটির কান্নাকাটি
কত ব্যথা জমে সমুদ্রে ওঠে ঢেউ,
পাথর ভাঙার শব্দে বেঁধেছো গান...
আকাশ ভাঙার শব্দ শুনেছো কেউ?