সুস্নাত জানা-র এক গুচ্ছ কবিতা
মানবী
স্বর্গীয় ভাস্কর্য যেন শুয়ে আছে খাড়ির উপরে
মাঝে মাঝে ঢেউ এসে ছুঁয়ে যায় চরণযুগল
সে যে আলোকিত চন্দ্রমার মুখচুম্বন করে
চন্দ্রকিরণ। আর স্তব্ধের নীলিমা জুড়ে রব উঠে
গগৈ স্রোতের বেগে ঘুর্ণির অসীম বৃত্তে নেচে
ফের পাকে পাকে তোমারই অনন্ত যাওয়া আসা
এক নারীর সৌন্দর্য যেন শুয়ে আছে পাথর শরীরে
ভাস্কর নিপুণ ছানি মেরে গড়ে তুলে একনাথ দেহ
একাকি মনের সঙ্গে এই কথা অন্তহীন বয়ে চলে
অনন্তের পথে, পাথর ও বালির যুগ্মে মিথুন মূর্তি
মহাকাল মন্দিরের দ্বারে প্রহরায় রাত্রিদিন, শুধু
ভক্তের আকুল আর্তি আকাশ জুড়ে জাগায় আরাব।
আরোহী
মৃত্যুর দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে একবার ইচ্ছে করলো বিপ্রতীপে হাঁটি
অমনি সদর দরজা হাট করে খুলে বেরিয়ে পড়লাম
ভাঙা হাড়, গলার কাছে থেতলে গেছে সব
পা আর টানতে চায় না হা্ঁটুকে, কোমর কঁকিয়ে উঠে
সারা গায়ে অলস যন্ত্রনারা ছোবল বসিয়েছে
শুধু কেবল চোখ বলে চলো দূরে কোথাও
দীগন্তের পরপারে নীলিমা কেমন আতুর চোখে ডাকে
বাঁকের কাছে নদী হঠাৎ বোহেমিয়ান আজ
আত্মকেন্দ্রিক মন আজ কী অদ্ভুত সেবাপরায়ন স্বর্বস্বত্যাগী
এরকম অহংকারেই তো মৃত্যুকে উপেক্ষা করা যায়
চলো বিপ্রতীপে জীবনের উল্লাসে।
যুবভাষা ডট কম
সব পৃষ্ঠা ক্রমাঙ্কের নীচে আমিও লিখে রাখি ডট কম
এবং আমার এই রচনা বিন্যাস সবই ই- নোটে লেখা
কলমের নিব ভোঁতা হয়ে জং, খাতার পাতায় রাখি পাস্তার প্লেট
বরং স্বচ্ছন্দ এই মন নিজেকেই এঁকে রাখে মোবাইল নোটে
সব নোটেশন হলো ইউনিকোড
সে আক্রুতি বা অভ্র কী বাংলা, বা তোমার সফটওয়্যার কোরালই হোক না কেন
আমার কবিতা গল্প ঠিক পৌঁছে যাবে সেকেণ্ডের ভগ্নাংশ সময়ে।
মিস্ কাস্ত্রোকে আমি কাল রাতে পাঠিয়েছি বাংলা সনেট
আজ সকালেই মর্নিং টাইমসে তার ইংলিশ ট্রান্সলেশন ছাপিয়েছে ওরা।
মিসিসিপি থেকে এক ইমেল এসেছে দুপুরে
আমার ভাবনা নিয়ে উড়ে যাওয়া পাখির ডানায় ভাসে বুকের গোলাপ
গোপনে তোমার জন্য পাঠালাম এই ইনসটাগ্ৰাম,
ভালো থেকো প্রণয় লোভিরা।
তারা বৃষ্টির রাতে
ছিন্ন কাতর মেঘের মধ্যমায়
জেগে আছে শুধু তারা বৃষ্টির রাত
রাতের আকাশে চন্দ্রমাহীন শোভা
অন্ধকারের পাতাল ছায়ায় আঁকা।
যে প্রেত বাসনা আমাকে জাগিয়ে রাখে
তাদের শরীরে অনন্ত কামনা
ভরাকোটালের অশ্রুতে ভরা নদী
দুঃখ তাপের বালুরাশি শুষে খায়
বিগত যুবক বন্দী বলাকা সে যে
পড়ে আছে মৃত ফসিলের মতো একা।
যে আলো জাগছে আমার অক্ষিগোলকে
জানি তারা মৃত তারাদের অভিমান।
প্রত্যাশা ছুঁয়ে এখনো রয়েছে জেগে
পৃথিবীর প্রিয় মাটির আকাঙ্খায়।
নীল ভালোবাসা
নীল আলোর জন্য আমার কোনো মায়া নেই
নীল সমুদ্রের জন্যও না
নীল বৃষ্টিও আমাকে আলোড়িত করেনি কখনো
শুধু নীল আকাশ আমার ভেতরে ঢুকে আমাকে তছনছ করে দেয়
আদিগন্ত নীলিম হয়ে উঠে ভালোবাসার অন্তহীন গোপন সংরাগে
তখন বেদনা সাঁতরে অবিরল উড়ে চলি তোমারি উজানে।
আলোড়িত চরাচর জুড়ে নীলিমায় নীল
নীলাভ রক্তের স্রোতে ভাসে সৃষ্টিধারা।
বিরহ
আমিও অনেক দিন তোমাকে বলিনি কিছু
তুমিও আমার কাছে রাখনি পরিচয়
হারালো অবিরোধে অথবা অনাদরে
সেতুর মতো ছিল যা কিছু সঞ্চয়।
এই তো ভালো বেশ আমারো নেই দাবি
সেলফে জমে ধুলো বইয়ের কোণে কোণে
তুমিও সঙ্গীকে নিয়েই আছো বেশ
বিগত বন্ধুর তালিকা বাড়ে দিন
আহত বেদনার পরছে জমে ব্যথা
তারের কান্নায় মরচে ধরা প্রেম
ঠিকানা ভুল করে প্রেমিক চলে গেছে
অজানা সংকেতে রয়েছি একা বেশ।
বিষাদ
এই দগ্ধের ভষ্মে তুমি জাগিয়ে রেখেছো দিন
বাঁধন আলগা হয়ে তখন কেবল দায়িত্ব হীনের গ্ৰন্থিমোচন
দিন আর রাত্রির প্রয়োজনও ঘুচে যায়
ক্রমশ সংক্ষিপ্ত হয়ে ঝরে যায়
ব্যাহত ব্যথার মতো
তুমি চলে গেলে, হয়তো কোনো আকর্ষণ নেই,
কর্ষণও কবে শেষ, তবু এই রোদ আলো গান - ধরে
না এলেই ভালো হতো বেশি।
জলরঙে জন্মদাগ
জাদু ওড়নায় মুড়ে ঢেকেছো আমার সব দেহ
গান দিয়ে ভাঙি সেই ঘুম- যদি মৃত্যুঘোর-
পাখির ডানায় লিখে স্বপ্নচোখে ওড়ায় সে লিপি
দুধারে পথের যতো দৃশ্যপট চলমান ছবি।
জাতিস্মর ভেবে আমি প্রতিবার নবজন্ম খুঁজি
প্রত্যহের ব্যবহারে আমার সে মোহ ঘুচে যায়
প্রতিদিন সূর্য উঠে তবু, প্রতিরাতে চন্দ্রকলা
ভেঙে গড়ে জোয়ার ভাটায় লেখে জীবনের রীতি।
এরকমই মাটি ঘাস চিনিয়েছে বিমূর্ত পাথর
কেমন সরল হেসে বলে শুদ্ধ যাপনের মানে
এখনো বালক আমি তোমার কৌশলে
প্রতিক্ষণ স্বপ্নে আঁকি আকাশে মেঘের খেয়া,
প্রপিতামহের মুখে ঝুলে আছে শতাব্দীর ছায়া
স্নেহময় বলিরেখা তবু ডাকে, "আয় কাছে আয়.."
সৌরকথা
একমেঘ বৃষ্টিহীন রাত ছায়ার মতন কেটে যায়
শুকনো নদীখাতে শুয়ে আছি কতকাল প্রত্যাশার স্বপ্নচোখে
বরফের চাঁই উষ্ণতার চাপে শূন্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে কোথায় হারায়
ডানার পালকে জাগে পাতাঝরা গান
গান শুধু গান অন্তহীন বেদনার।
আর চোখ মেলে দেখি অজস্র আলোর বিস্ফারে ভেসে যায় চরাচর।
অন্তহীনে কোনো এক।
ভয়ঙ্কর আত্মবিধ্বংসী বিস্ফোরণে
বিরাট আকাশে অসংখ্য জন্ম আর হাজার কোটি মৃত্যুর পর
জন্মহীন মৃত্যুরহিত এই অপার বিস্ময়...
অভিমন্যু
এই ছিন্ন সময়ের মৃত্যু মাখা দিনে রোজা যুদ্ধ করি
অভিমন্যু হৃদয়ে
প্রতিপক্ষ শানিত অস্ত্রাঘাতে ততোবার বিদ্ধ করে আমার শরীর
দেখি এই দেহে এক অদৃশ্য উদ্যম এসে বর্ম আমাকে তাড়িত করে আগামীর দিকে
চূর্ণ স্তম্ভের গায়ে হেলে আছে বিজয় পতাকা
ধ্বংসের নির্বোধ ছায়া মায়াময় মরীচিকা আঁকে
শুকনো পাতার। স্বজনের শবদেহ
বাজের চেয়েও তীক্ষ্ণ হিংসা চোখ রক্তের স্রোতের ক্লিন্ন অবসাদ
পরাজয়ই আমার চরম পরিণতি
আমাকে বিনষ্ট করে তোমাদের চরম উল্লাস জাগে যদি
হোক তবে তুমি থাকো জয়ের বিজয় মালা পরে
আমি থাকি মৃত্যু মহাকালে।
যতোবার তোমাকে চেয়েছি প্রিয় করে হৃদয় পুড়িয়ে
তুমি ততোবারই অন্য কোনো পুরুষের
আমাকে ঘৃণার চোখ ছুঁড়ে দাও