হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর এক গুচ্ছ কবিতা
দুঃখঘর
মাটির যাবতীয় দুঃখঘর আমাদের ব্যর্থতা
সাতসকালে গান গেয়ে যে মাঝি চলে গেছে
আলোর দুয়ার দিয়ে ঝরনা রোদের পাতায় পাতায়
তাকে দেখেনিকো কেউ
দুঃখদুয়ারে যাদের রোজ নামতা মুখস্থ
তারা তার পায়ের শব্দ শুনেছিল
গিঁট খোলা নেই বলে যারা বিরক্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে
তারা মাঝরাতে স্বপ্ন দেখেছিল
কুয়াশায় ঢেকেছিল সবগুলো খোড়ো চাল
চাঁদ ফুটো হয়ে জ্যোৎস্নার জল এসে
ধুয়ে দিয়েছিল সবকটি কলাপাতা
ভাতের গন্ধ এসে কড়া নেড়েছিল
ঘুম ঘুম চোখে জেগেছিল যারা
তারা সব দুঃখের আত্মীয় হয়ে কলাপাতায় গল্প লেখে
দুঃখকথা বেশি পড়ে গেলে
পাতার ক্যানভাস জুড়ে শুধু কালো কালো দাগ
বুক পেট জুড়ে হাজার ক্ষত
হাঁড়ি জুড়ে আল্পনা তবু বেড়ে যায় খাওয়া খুব
খেতে খেতে আকাশ ছাদে চাঁদ দেখেছিল যারা
সব গাছ খুলে দিয়ে তারা ভেসে যাবে আলোগান নিয়ে।
ধ্বংসের ঝোড়ো রেখা
মাথা নিচু করলে যতটা আকাশ আঁকা যায়
তার অর্ধেকেরও কম জমি আমাদের সভ্যতার
বইয়ের পাতায় পাতায় অসংখ্য ঘর
স্কুলের দুয়ারে বই হাতে যারা উঠেছিল
তাদের অনেকেরই আজ বয়স হয়ে গেছে
যারা ভেবেছিল স্কুলের ছাদে উঠে মশান দেখা যায়
তাদের গাছের পাতা কবেই গেছে শুকিয়ে
প্রতিবাদের মতো কঠিন শব্দকণার দানায় তৈরি
একসময়কার রোজকার মুখস্থ পথের চোখে
রুমাল বেঁধে পোশাক বদলেছে গর্তের কৌশল
গাছের ভগ্নাংশে চোখ পড়ে আত্মহত্যার দিনলিপি
আলোহীন স্তব্ধতার পৃষ্ঠায় আঁকা ধ্বংসের ঝোড়ো রেখা ।
বিকেলের বাগানের ঠিকানায়
সন্ধের ছাতিম ফুলের গন্ধের মতো
বিকেলের বাগানে ট্রেন এসে দাঁড়ায়
মাটিতে জমেছে শ্যাওলা খুব
এখানে ওখানে দু'একটা হলুদ পাতা
রোদেলা গাম্ভীর্যের কথা বলে
ছিটেফোঁটা রঙ গড়িয়ে গড়িয়ে
রান্নাঘরের পাশ দিয়ে নদীর ধারে এসে দাঁড়ায়
কথা বলা জলকে থামাতে গিয়ে
নিজের মাথা আর পায়ের ভারে
নিজেই হেসে ফেলে
বটগাছের ঝুরি ধরে কেউ কেউ নেমে আসে
দুপুরের গাড়ির দৌড়ঝাঁপ
এখানে কে যেন কমিয়ে দিয়েছে
সমস্ত চত্বর জুড়ে উড়ে বেড়ায বিকেলের গন্ধ
হৈ চৈ করা বেঞ্চগুলোর গায়ের ঘাম
ৎকবেই শুকিয়ে গেছে
টিনের শেডগুলো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে
কেউ কেউ চলে গেছে বাড়ি
কাছে দূরে দু'একটা আবছা শরীর
সময়ের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষায়
রোদেলা দুপুরের গন্ধের কয়েকটা ভাঙা টুকরো নিয়ে
একদিন কেউ একজন
বিকেলের বাগানের ঠিকানায় নেমে আসবে।
বিষন্ন রোদের সঙ্গে
জনহীন স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলে
একফালি বিষন্ন রোদের সঙ্গে দেখা হয়
সারাদিন টহল দিয়ে সে
একসময় পাতার জানলায় চোখ রেখে
দূর অতিদূর স্বপ্নে বিভোর
কে যেন বলেছিল ছুটির বিকেলে
সব ফুল প্রজাপতি
তারপর হঠাৎ বৃষ্টিতে
সব পাপড়ি বাড়ি ফিরে যায়
সেই বৃষ্টিবিকেলের দস্যি মেঘের রঙ
রোদের চোখে মুখে
ঘসা আয়নার মতো চোখের সামনে
মাটির বিছানায় শিউলির মতো
এলিয়ে আছে বিষন্ন রোদ
কথা নিয়ে কাছে গেলেও পরম্পরা হারিয়ে
কে কখন কোথায়
সামনে পিছনে উঁকি দিয়ে যায়
কথার আস্ত শরীর মুখে নেই বলে
এক পাও আর বাড়ানো যায় না
ক্ষণিকের জন্যে চোখ সরে গেলে
যতটা পর্যন্ত রোদ ঘুমিয়ে থাকে
তারপরের আগুনের কবিতা থেকে
তুমি কত দূরে ।
নদীজলে জন্মের গন্ধ
উঠে আসার কথা ভাবলেই মনে পড়ে যায়
ধুলো ওড়া পথ, পাতা দিয়ে সাজানো খাতা
কে যেন একজন নাম লিখেছিল
সাদা পাতায় আজও কালো ক্ষত
শুধু নামের অপরাধেই হাঁটা পথে হাজার মাইল
উঠে আসার কথা ভাবলেই সামনে এসে দাঁড়ায় নদী
জলের ঘরেই জল ছুঁয়ে আছে আজন্মকাল
মুখের রেখাই ভাষা দেয় জিভের স্বাদ গেছে ঘুমিয়ে
ধুলো উড়ে উড়ে ঘরের বারান্দায় আল্পনা
কত যুগ পরে বাবা মায়ের পায়ের ছাপ
যেন বুকের ওপর সভ্যতার নামাবলী
আমার আঁতুড়ঘর ------ নদীজলে জন্মের গন্ধ ।
আগুনপাতা
ফুলের হাত ধরে ছড়িয়ে গাছ
পৃথিবীর একটা বিশেষ কোণ
জানলা দিয়ে চোখ রাখলে
একটা পুরোনো খোলা বই
পাতায় পাতায় অক্ষরগুলো
গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ছে
রাস্তার ধুলোয় ধূসর পাতা
সবুজ উঠে গেছে কোন কালে
অপর পাতায় তখন যুদ্ধের আয়োজন
মাঝ দুপুরে জড়ো হচ্ছে ক্ষোভ
মালিকের দৃষ্টির বাইরে
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা জল
অসহ্য আবহাওয়ায় জমছে ধুলো
আর জাগবে না জেনে শেষ পেরেকর জন্যে
হাতুড়ির তাল ঠিক করে নেয়
একটা হাওয়ার ঝাপটা ----- উল্টে যাবে আগুনপাতা ।
অপেক্ষার রঙ লাল
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে যে সন্ধে এলো
আমি তার দুয়ার খুলে বসে থাকি থাকি
ছাই রঙের আকাশ বলে গল্পের একঘেয়ে সুর
হাওয়ায় অস্থির পাতার মতো দুলতে থাকে পা
সাতসকালে বড় বিশ্বাসে ডাক পেয়েছিল যারা
তারা অনেকেই চাঁদোয়ার নিচ থেকে সরে গেছে
আকাশের ক্যানভাসে যা কিছু সাজানো
তারা সবাই প্লাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায়
সময় হলেই গাছতলা থেকে সরে যাবে শুকনো পাতা
কানে আসবে কচিপাতাদের গান
খোলা দুয়ারে সাজানো আল্পনার গল্প শুরু হলেই
কোথা থেকে উড়ে আসা পাখি বলে যাবে
অপেক্ষার রঙ লাল ।
শেষ ট্রেনের খবর
আয়না দিয়ে আমার যে নদী বয়ে গেছে
তাকে আমিই তৈরি করেছি একটু একটু করে
শহরের সব মূর্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসে
অনেকটা পথ একা হেঁটেছি
আমার জামা তো আর কারও গায়ে হবে না
সঙ্গে ডাকতে পারি নি একজনকেও
দু'একবার বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল মাত্র
কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন গলি হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল
রাস্তার গায়েই আমার যাত্রা বলে
গলি আমায় নিয়ে সুবিধে করতে পারে নি
আয়নায় ফুটে উঠেছিল গোটা শহরের মুখ
কিছুটা পিছনে গ্রামের ছবিও স্পষ্ট হয়েছিল
আমার লক্ষ্য ছিল একটামাত্র তালগাছে
বিশ্বাস ছিল তাল খেঁজুরেই সাজিয়ে দেব দিগন্ত
সব ঝড় এসে লেগেছিল তালগাছে
উদ্দাম হাওয়ার শত হাতের অভিমুখ বদলাতে পারে
এমন কোনো প্রতিহত গুণিতক আমার নামতায় নেই
মরুভূমির গান শিখে যে ছেলে আয়নায় তাকিয়েছিল
তারও পাও কিছু দূর গিয়ে বালিতে পুঁতে গিয়েছিল
আয়নায় এখন বালি, কাঁচ, সাপের মতো
প্যাঁচানো অন্ধকার, হলুদ বাতাসার মতো চোখ
যে মুখের দু'ঠোট সারা দুপুর
আপন বংশলতিকার গানে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল
পকেটের জমানো টাকা উড়িয়েছিল হাত খুলে
তারা এখন গভীর রাতের স্টেশনের অন্ধকার কোণে
শেষ ট্রেনের খবর এখনও কেউ জানে না।
চিরকালীন কুয়াশা
শেষ ট্রেনে রাতের গভীরে যারা স্টেশনে নামলো
সকালের কুয়াশায় যারা আগেই স্টেশনে নেমেছে
আগামীকাল দুপুরে যারা স্টেশনে এসে নামবে
তাদের কারও মাথার ছাদ নেই
শুধু ঘর নেই বলেই তারা গলা খুললেই
তা দিগন্ত পেরিয়ে সমুদ্রে মিশে আন্তর্জাতিক হয়ে যায়
নক্ষত্রের গ্রাম থেকে যারা হেঁটে এসেছিল
তারাই একমাত্র জানে সূর্যের স্বাদ
পৃথিবীর কোনো উপমায় তারা কান দেয় নি
নিজের গর্তকে ভালোবেসে ছিল খুব
আর নিজে হাতে গর্ত খোঁড়ার প্রক্রিয়ায়
শ্রদ্ধা ছিল বলেই খুব তাড়াতাড়ি তা পাঠ্যে এনে তুলেছিল
স্কুল বাড়ির সমস্ত দরজা একমুখী
ঘর আর উঠোন জুড়ে থাকে
সাপের মতো মাটির গভীর সংস্পর্শে থাকা
শাসকের কিছু বাজার চলতি চটুল হাওয়া
একাকী বড় হয় যাবতীয় মাংসের শরীর
কুসুম রোদ্দুরের তুলির গভীর টানে
ধরা দেয় না রামকিঙ্করের হাসি
নদীর খাতায় লেখা থাকে
কিছু জটিল সমীকরণের সহজ সমাধান
হাত দিয়ে যারা জল খুঁটেছিল
নদীর প্রাসাদে ঢুকে কেউ কোনো ঘর খুঁজে পায় নি
বটপাতায় মাটির ইতিহাস লেখকদের কেউ চেনে না
গাছের মাথায় রোদ ----- আর কয়েক মিনিটের অপেক্ষা
সন্ধে নামার মতো নিঃশব্দে হেঁটে যাবে লেখকেরা
তারপরই হাতে হাতে নেমে আসবে চিরকালীন কুয়াশা ।
নাটক চলছে
একটা কথা বলার পর
আবার একটা কথা বলার মাঝখানে
যে সময়টুকু তার কাছে আমি
অনেকগুলো পাতা রেখে আসি
হলুদ গাছের সবুজ চকচকে পাতা
অনেকেই বলে সেই পাতায় নাকি রোজ নাটক হয়
আমি অবশ্য একদিনের নাটক দেখেছি
সংখ্যা দিয়ে ঘটনার গুরুত্ব কমাচ্ছি না
নাটক মানে তো সেটা নাটকই
প্রথম কথা হাত পা ছড়িয়ে বসতে গিয়ে
একটু টলে যেতেই দেওয়াল ধরে সামলে নেয়
তখনও সে মাটির কাছাকাছি যায় নি
হাত পেতে দেখে নি মাটির সারল্য
অথচ সারাটা পথ শুধু এই দেখার জন্যেই পা চলেছে
মাটির কত কাছে বাস করে মাটির মুখ
পাতায় তখনও দারুণ হৈ হট্টগোল
এমন অবস্থায় দ্বিতীয় কথার প্রবেশ
ঝড়ের গতিপ্রকৃতি বুঝতে না পারায়
পাতার রঙ প্রতি মুহূর্তে বদলে বদলে যায়
পিছন দিয়ে ঠেলে দিতেই পড়ে যায় দ্বিতীয় কথা
অথচ দাঁড়িয়ে দেখবে বলেই এতটা পথ
পায়ে পা দেখা যায় নি একবারের জন্যেও
মাটিতে এখন কেউ নেই
অথচ বাইরে থেকে বাজারের চিৎকার
চুপ
নাটক চলছে ।