রাজেশ্বরী ষড়ংগী-র এক গুচ্ছ কবিতা
দাগ
মানুষের জীবনে কিছু দাগ থেকে যাওয়া ভালো–
কিছু অন্ধকার
কিছু বিনিদ্র জাগরণ।
মেঘডাকা বিষণ্ণ সকালে ঝিরিঝিরি রোদ নামে,
ফুলের ভেতর ওঠে গান পাগল নিঃসঙ্গতায় দাগ পড়ে অক্ষরের গায়ে।
তবু আমাদের এই অন্তিম ইচ্ছেগুলি ছায়ার শেকলে বেঁধে
আত্মার বাউল হতে পারে না কখনও।
চুয়া ও চন্দন
ঝর্ণার দিকে যাওয়া বারণ ছিল না কখনও
জলের নদীতে পা ডুবিয়ে বসেছিলে এতকাল
কেন মনে মনে মেঘ জমিয়েছো? নীরব অভিমান
পাহাড়ের দিকে তাকাও, ফুটে উঠবে কথা
শরীর থেকে বেরিয়ে আসবে সুগন্ধি নাভিকুণ্ড,
চুয়া ও চন্দনের দাগ।
মৃত্যুর শহরে
কান্নার ঘুম ভেসে আছে বালিশের গায়ে
শরীরে হিম ঢুকে পড়ার আগে
আমরা যেন বাঁচিয়ে তুলতে শিখি।
সবকিছু তছনছ হয়ে যাওয়ার আগে-
এই মৃত্যুর শহরে, একটা হরিণ নেমে আসুক
আর চোখ ঝাপসা করে, আনন্দলহরী হয়ে
ঢুকে পড়ুক সবুজ বিকেলে
তরঙ্গ-১
জল একটি সহজ বাক্য
যার স্নানে বসে আমরা প্রতিদিন গানের ভুবন জুড়ে সরল তরঙ্গ শুনি,
অক্ষর ভেসে ভেসে যায়
রহস্যময় এ জীবনে যত বেশি স্পর্শ বাজে
তার সামান্য অবগাহন স্বযত্নে তুলে রাখি স্বরের কোমলে
ফোঁটা ফোঁটা শব্দ ঝরে অনাগত পাতাটির গায়ে
তরঙ্গ-২
কথা বলা বাকি আছে মন
অখণ্ড তিলক ভেঙে আজন্ম জেগে আছে তিমির নয়ন
পোড়ানো যায় না তার শোক, শিল্পগান।
ছাইভস্ম কুসুম ললাটে
রেখো কিছু হরিতকি আয়ু, আলো প্রবণতা
জলের সহজ ধ্বনি, ভাসাও শিয়রে।
শস্যভার
এতোদিন ঘুমিয়েছি লতায় পাতায়
ব্রহ্মের আগুনে আগুনে
ছাইভস্ম মেখেছি দু'হাতে
চিতা থেকে জেগেছে জল, নিভন্ত শরীর
দেখেছি দু'হাতে খরা, মন্ত্র লাগা আলোটির দাগ
কৃষ্ণ মাটির মতো অফুরন্ত পুড়ে গেছে পিঠ
অমলিন শস্যভারে পড়ে থাকা আয়ু--
এই সব রক্ততাপ ব্যথাহীন হাওয়াটির মতো
সেলাই করেছি একা অবশ নিভৃতে
সে-সব আগুন কেউ বোঝেনি কখনও।
সম্ভাবনা
আসলে আমরা সব স্বনামধন্য চাঁদ,
পাতালের লোক
চক্ষু দিয়ে গান লিখি,
জলের ভেতর মেঘ অন্তরালে টানে বুকের মধ্যে জ্বলা দু-এক টুকরো শীতল আগুনে
সৌধের মিনারে বসে তুমি বিমূঢ় অহংলিপি কেনো,
পসরায় সাজিয়ে রাখা গন্ধের ঘ্রাণ।
আমদের সমস্ত শীতে বাঁধা থাকে দু'টুকরো ধানের বাগান--
তাতে পাখি আসে, আর পরিযায়ী আলো সম্ভাবনা
বনে চন্দন ফুটে আছে-১
ধান্যমতী সন্ধের কাছে
কুশপত্র চেয়ে এনে পেতেছো সংসার।
বৃক্ষমায়া, তোমাকে লালন করে গান,
কতদূর তার সুধা ঝরে, জানো?
মাটির ছন্দও কান পেতে বৈরাগ্য চায়
যেন তার ধ্বনির আলো
অতিসামান্য খড়কুটোয় বাঁধা,
ডানার সারল্যে পরিযায়ী ভ্রমণের সুখ
বনে চন্দন ফুটে আছে-২
বনে চন্দন ফুটে আছে, তুমি এখনো জানো না?
রাজহংসী গোলাপের মতো এখনো জেগে আছি ঘন অন্ধকারে,
তাচ্ছিল্য কুড়োতে কুড়োতে সবটুকু জমিয়ে রেখেছি।
কাকে কী বলবে তুমি? কাকে তুমি সুধা ঢেলে জড়াবে হাওয়ায়?
এসব প্রতিচ্ছবি রেখেছি জলে
অথচ তোমার শান্ত করতলে
অনায়াসে চোখ রেখে ডুবে মরা যায়
গচ্ছিত শব্দের পাশে
প্রতিটা যাপনের শেষে একটা মৃদু মুহূর্ত থাকে
একটা না পাওয়া যন্ত্রণা, একটা ভালোবাসা,
কিছু পাথর ভেঙে পড়ার শব্দ ।
শিশিরলতায় গচ্ছিত এই সমস্ত ধ্যান
কোলে তুলে নিয়ে বসি ।
হারানো প্রাপ্তির পাশে রাখা থাকে আপন মেঘ কুয়াশারা
দেখা আর না দেখার কোমল আয়নায় চোখ রেখে--
চলো ভ্রমণে ফিরে আসি।