অন্তরা দাঁ-এর এক গুচ্ছ কবিতা
বেডরুম
সাদা বেডকভার আজ সমুদ্র-বক
জানালার নীল পর্দায়
মন্দারমণির হাতছানি
ভরা শ্রাবণে ডুববে এবার শহরতলী
আমার সিন্ধুনীলের অতলে
তোমার নোঙরখানি গাঁথো।
মাংসের দোকান
হাড়-মাংসের স্তূপে
দোকানি গুঁজে রাখে ধূপকাঠি বউনির সময়
আজ রোববার!
সুগন্ধ জড়ায় যদি রক্তে
খদ্দের ভাগবে নিশ্চিত
কাঠের সিংহাসন
ওপরের তাকে তোলা
টুনি-বাল্ব জ্বলে, নড়ে
ঈশ্বর চোখ মটকে সাবধান করছেন যেন !
হে অন্ধকার ক্ষুধা !
মাঝরাতে রাত এসে টোকা দেয় দরজায়। তখন ভাঙা চাঁদ জানলার শিক ধরে উঁকি দিয়ে গেছে ক'বার। ভাড়াবাড়ির পলেস্তারা খসে পড়া দেওয়ালে বালির নোনা। মেঝেয় চূড়ো ক'রা আছে বাসি তেলচিটে জামাকাপড়। তক্তাপোষের অসমান পা'গুলো ইঁট দিয়ে উঁচু করে ভারসাম্যের বৃথা প্রচেষ্টা, নীচে এলুমিনিয়ামের থাল-বাসন, কলাইকরা সানকি, ডাঁটিভাঙা চিনেমাটির কাপ। একটা কলতোলা টিনের তোরঙ্গে, দু'খানা গরম চাদর বাবার পুরনো ফ্লানেলের জামা, একজোড়া ছেঁড়া দস্তানা, কে যেন কবে এনে দিয়েছিল, ব্যবহার হয় না আজকাল। আগমার্কা ডালডার হলুদ বয়ামে লাল চালের বেঁটে মোটা মুড়ি ঢালা আছে। চিমসানো আলুর গাদায় নেংটি ইঁদুরের ছোটাছুটি।
কেরাসিন স্টোভের তিনটে সলতে পুড়ে গেছে। নিভু নিভু আঁচে সেঁকে নিই খিদে। ঘোলাটে মদের মতো তেষ্টা পায় আজকাল। নাভি থেকে জন্মদাগ বরাবর নীচে আরও নীচে...
খুঁড়ে খুঁড়ে তুলি যত বালি আর কাদা।
নীচু রাস্তায় জল জমা হয়। এবার বর্ষা থেকে গেল অনেকদিন —তারা উদারা মুদারায়। রেললাইনের ওপারে বস্তি থেকে ধেনো মাতালদের হল্লা আর মেয়েদের ইনিয়েবিনিয়ে কান্নার সুর মিশে যাচ্ছে উদলা হাওয়ায়। পাওয়ার কাট। ঘামাচির মত বিপন্ন অস্বস্তি নিয়ে মধ্যবিত্ত যাপন।
তবু আহারে জীবন ! অজাগর বোধ দুয়ারে আঁচল পেতে শিথিল, কোনোদিন আর প্রগাঢ় কামনায় জর্জরিত হবে না জেনেও ভুখা ইচ্ছের মিছিল সার বেঁধে মস্তিষ্কগামী সম্ভাবনার উল্কাপাত লাভাস্রোত বইয়ে দেয়।
অনুর্বর মাটিতে জলসেচ করো হে তৃষ্ণা !
দেশভাগ
ফেলে এসেছে খেলনাবাটি
নাকফুল দুবিনুনী বিকেলবেলা
চিকন-শরীরে হরিতলার মাটি
লেগে আছে
ডাঁটো হয়ে ওঠা লাউডগার
মাচার কাছে
ডাগর-চোখের আদুর ভাই
ওপারে দাঁড়িয়ে আনমনা
তার টসটস চোখ কা'র তরে ?
পেরিয়ে যাওয়া কাঁটাতার
মা'র কাপড়ের খুঁটখানা ধরে
মেঘমাখা দুপুর শীতলপাটি
যতদূর চোখ যায়
হাড়-বের করা বুক বাবার
হাপরের মতো ওঠানামা করে
বাপ আর ফেরে নাই এপারে
যেদিন খবর এলো
স্পষ্ট দেখেছে মেয়ে
শাঁখা-নোয়া ভেঙে ছুঁড়ে দিয়েছে মা
কাঁটাতারের ওপারে
যমুনা ধারায় সিঁদূরধোয়া লাল
মিশে গেছে সীমান্তবাহিনী ব্রহ্মপুত্রে
অস্তাচলে সন্ধে রাঙামাটি
উজানভাটি বসতবাটি...
মুখ ও মুখোশ
আনত মুখের চারপাশে নিহিত আছে
বিকালের সকরুণ ছায়া
শেষ রোদ মরে যাওয়ার আগে
ছুঁয়ে থাকে সসাগরা প্রেমিকের বুক
তুমি একা কতদিন ভেঙেচুরে
আলো-আঁধারির ভেতর খুঁজে গেছ
প্রেম, শরীরের আঁচে পুড়ে যায়
অর্গাজমের মিহি মসলিন
গভীর নাভিমূলে প্রাচীন শিলার মতো কামজ ঘ্রাণ
শ্যাওলার আস্তর ভেঙে গড়িয়ে আসে
মোহজল
কায়াহীন অবয়বে স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটি মুখ
মুখোশ খ'সে যায় ।
ভালোবাসা একমাত্র ভ্রম
একমাত্র ভ্রম সে তো ভালোবাসা
আর সব ঝরে ঝরে পড়ে গেছে
কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ির মতো
গ্রীষ্মবেলার উষ্ণ নিঃশ্বাস জ্বালাময়
ধুলোর আশ্রয় খুঁজে
সেখানে কোথাও অজানিতে
ঘোড়ার কেশরের মতো ফুলে উঠেছে
বাসনা তখন আচমকা
রক্তে রক্তে অজস্র বিউগল নেচে ফেরে
কুণ্ঠাহীন লোফারের মতো
বেহায়া বর্বর
অশ্রুনালী চেপে ধরে মুহুর্তের পারদ
বিশ্রুত কথার ঢেউ আছড়ায় তাই
কান পেতে থাকি লাপডুপে
মায়াবী আলোয় ডোবে নাজুক শহর
যাতায়াত নিভে আসে
ক্ষীণকায় বোবা বালিকার কথা
কইবার দুর্মর আকুতির মতো
যোগাযোগ বোধহীন পঙ্গু
এতকিছু সয়ে যায় তবু
দুর্নিবার আলো আর মায়ামত আশা
একমাত্র ভ্রম সে তো ভালোবাসা ।
আহত ভাস্কর্য
রাতভর একাকীত্বের পুকুরে
সাঁতার কাটে মেয়ে
ভেসে থাকে যেন চিতাকাঠ
এতবছর রোজরাতে ডুবেছে সে
জড়িয়েছে মরা দামে
পচা শামুকে কেটে গেছে পা
গেঁড়ি-গুগলির গন্ধ মেখেছে চুলে
দমবন্ধ করে ছোট ছোট মৃত্যুর সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা
নিষিদ্ধ সুখের চৌকাঠে পা
তবু ভালোবাসা'র নোটবুক উপচে
দিন-রাত্তির কবিতার ঢেউ
ঠান্ডা বিছানার বর্তুল কামড়
দু'পায়ের ফাঁকে ভলক্যানো নিষ্ফল
প্রেমিক গোপন তার
সুযোগ মতো আলগা করে পাজামার দড়ি
গ্যালারিতে উপচে পড়ছে সিলিকন বুবস
মুঠোফোন পিছলে যায় অবসরের লালা মেখে
শব্দ হয় না, বুক পেতে রেখেছে এক হৃদয়বতী
অসতী জীবন
যখন চোখের আলো নিভে এসেছে
তুমি অন্তরঙ্গে জ্বেলে দিলে বোধ
তাপিত জখম খুন বেদনার পারদ
বেয়ে ওঠানামা করে জীবনের স্রোত
উথাল-পাথাল হয়ে !
অশনাক্ত ভেবে যাকে তুমি
সন্দেহের গলিতে এসেছো ছেড়ে
সেই সকরুণ উল্লাস যতেক ভয়
কুকুরছানার মত অসহায় পিছু নেয়
তোমার ইচ্ছাধীন শর্তের না-মঞ্জুর
সোপানে দাগছোপ পায়ের
এসে ফিরে যায় এলোমেলো দিন
ক্ষিদে জেগে থাকে অপলক
সে অন্যতর অসতী জীবন
সতীত্বের ঘোলাজল —তাকে যেতে দিও বয়ে
ব্যথাসুখ উচাটন অবুঝ এ মনটুকু নিয়ে ।
জন্মদাগ
স্তনসন্ধি থেকে ঠোঁটে করে
যতবার তুলে রাখো রাত
করতলে জমা হয় মোহ
সিঁড়িভাঙা দিনরাত্রির গল্প
ইনিয়ে বিনিয়ে খুঁজে যায়
তোমার বুকের লীনতাপ, দেহ
তবু, তছনছ করেছ আমায়
দুরন্ত বালক যেমন অবাধ
লাথি মারে যত্নে গড়া বালিঘরে
প্রেমিক তখন ফিনিক্স পাখির
মত উড়ছে জাদুডানায়
জন্মদাগ ভেসে যায় সারাৎসারে...
সকাতর আমি ডেকেছি
আমার নাব্যতার নীল জলে পা ডুবিয়ে তুমি অনড়
সকাতর আমি ডেকেছি তোমায় চাঁদের আলোর বিভাবে
অনুবাদ চাইনা, তোমার প্রাচীন পান্ডুলিপির
অক্ষরে অক্ষরে যে বর্তুল খাঁজ
তাতে আটকে গেছে আমার
সমস্ত যৌবন বাধাবন্ধহীন স্বভাবে
অবগাহনের তিতিক্ষা আজ আগুনচুম্বী
এসো, সমুদ্রসারসের হৃদয় গাঁথি তূণীরে
নীড় নয়, আকাশে আকাশে পাতি
সংসার!
দেশভাগ
ফেলে এসেছে খেলনাবাটি
নাকফুল দুবিনুনী বিকেলবেলা
চিকন-শরীরে হরিতলার মাটি
লেগে আছে
ডাঁটো হয়ে ওঠা লাউডগার
মাচার কাছে
ডাগর-চোখের আদুর ভাই
ওপারে দাঁড়িয়ে আনমনা
তার টসটস চোখ কা'র তরে ?
পেরিয়ে যাওয়া কাঁটাতার
মা'র কাপড়ের খুঁটখানা ধরে
মেঘমাখা দুপুর শীতলপাটি
যতদূর চোখ যায়
হাড়-বের করা বুক বাবার
হাপরের মত ওঠানামা করে
বাপ আর ফেরে নাই এপারে
যেদিন খবর এলো
স্পষ্ট দেখেছে মেয়ে
শাঁখা-নোয়া ভেঙে ছুঁড়ে দিয়েছে মা
কাঁটাতারের ওপারে
যমুনা ধারায় সিঁদূরধোয়া লাল
মিশে গেছে সীমান্তবাহিনী ব্রহ্মপুত্রে
অস্তাচলে সন্ধে রাঙামাটি
উজানভাটি... বসতবাটি