বিশ্বজিৎ বাউনা-র এক গুচ্ছ কবিতা
হত্যাদৃশ্য অনুযায়ী
সাজানো এ বধ্যভূমি, ছায়া পড়ে আছে সে তরবারি।
লোলুপ অন্ধকার ওৎ হয়ে জেগে ওঠে কাছেপিঠে।
বিস্ময়ে দেখি, যেভাবে ধারালো আদর শেখায় নারী,
তেমন নিহত তির নিয়ে হরিণ শুয়ে আছে মিঠে।
আমি তার পায়ের কাছে বিছিয়ে দিই বেয়াড়া ঘাস,
মৃত চোখ গড়িয়ে দৃশ্য ধুনে দিই হাতের আদরে।
পোঁচ থেকে চলকে ওঠা রক্তে ভিজে যায় বাতাস।
মুঠো মুঠো সতেজ মাংস কোঁচড়ে নিয়ে ফিরি ঘরে।
তখন দিন নেতিয়ে যায় ক্রমে দূরের গাছ থেকে,
দেহপটে সব ক্লান্তি ধুয়ে নিয়ে বসে থাকি দাওয়ায়।
তৃপ্ত ভোজনের গর্তে কে বালির কথা লেখে?
পানকৌড়ি রতি শেষে দুজনের ধীরে তুমূল ঘুম পায়।
হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি আমি সেই নিজে,
হত হরিণ হয়ে শুয়ে আছি। রক্তে গিয়েছি ভিজে।
অভ্যন্তরীণ
আমার এই অন্ধকারে আমি স্বপ্নের মতো একা।
কাগজের নদী ঠেলে বৈঠা থেকে গড়িয়ে জলের ধস
এ কোন মৃত মাটির ডাঙায় ফেরায় মূক বয়স?
দেখি আজ, অন্ধকার গিলে খায় সব মুঠি মুঠি লেখা।
সে উপায়হীন ফিরিয়ে দিতে এসে গুল্ম শোক
আয়ুর নীচে রেখে গেছে তা-হীন ডিমের মতো চাঁদ।
কৃপা সুন্দর সময় এসে রেখে যায় ঘুঘুর ফাঁদ,
শূন্যতার ছটফট নিয়ে আমি মরাগাছ। সে প্রেতলোক।
এই যে সন্ন্যাসী পাঁজর কাঠের মতো ঘুণলোভী,
ফলনশীল রোদ জুড়ে তবু পোকার বিস্তার
প্রত্যহ কুরে খায় আড়ালের কৈফিয়ত, প্রশ্নের ক্ষার।
আসন্ন দুর্দিনে তোমাকে বোঝাতে পারি না সবই।
কাক আজ ডেকে ওঠে, খুলির ফাটলে রোদটুকু নিয়ে।
দাউদাউ পুড়ে ভাসি তোমার হৃদয়ের ভিতর দিয়ে।
বুমেরাং ফণা
এই যে পানকৌড়ি ভাঙ্গা দুপুর দহনে চুপ সমঝোতা,
ভাবি, কোন বৃষ্টি এলে ধুয়ে যাবে সব সংক্রামিত ক্ষত।
আঘাতে আঘাতে যে সংসারে হয়ে আছে নীরবে ভোঁতা,
তার উজাড় বুঁদ থেঁতলে কেউ কি হতে পারে উন্নত?
দেখি আজ জলের শিরায় ভিজে নেই পাখিদের উড়ান।
গুমরানো মুখ নিয়ে বসে আছে আমাদের সব গৃহী দিন।
মুখরা বাতাসে দাউদাউ পুড়ে গেলে যে যার প্রাপ্য মান,
অন্তর্দাহ জলে ভেসে যায় বিষিয়ে সব অতীতের ঋণ।
কে একা কতদিন নিরাময় বোধে সহ্য করে দুর্ব্যবহার?
একবারও কি ঘুরে দাঁড়াবে না দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে?
আজ তছনছ করে ভেঙে দাও সব সব গ্লানির পাহাড়,
কি লাভ মৌনতার? যদি না একটু সুখ শান্তি পেলে।
যার যত অবহেলা অপমান ক্ষত হৃদয়ে হয়ে আছে বোনা,
একদিন সব ফেরৎ আসে, হয়ে সে তীব্র বুমেরাং ফণা।
নিরেট শূন্য দিয়ে চেরা
ভেঙেচুরে আছে জল, মেঘ পুষে রেখেছি নিজের পিঠে।
আতাপাতার নীচে ছায়া ঝুলে আছে একা যতদূর পারে।
আধপোড়া মাংসের মতো চাঁদ শূন্যতায় একা পুড়ে মিঠে,
আমাদের জেগে থাকা রাতে শেয়াল ঢুকে আসে লোভী হাড়ে।
তোমার অশ্রুর কাছে যেতে চেয়ে ব্যর্থ হই খুব।
পুরাতন শোক খসে নামে ভিক্ষা-মুঠির ঝুলিতে।
কথা বুলিয়ে নিতে গিয়ে আদর দেয় ক্ষত'য় ডুব
তেমন তাকানো কি আজো একই আছে বিচ্ছেদের শীতে?
আমি আমার ছায়া নিয়ে ঢুকে যাই শ্মশানের খোলসে,
কাৎ হাঁড়ি গড়িয়ে অচেনা বৃষ্টি নামে চোখ থেকে।
ধকধক ক্ষত কে শোনো? তুমি কি এসেছো কাছে বসে?
আক্রোশ গাঢ় হলে ভুল বানানে আর কি নেবে ডেকে?
অপাচ্য আমাকে কেটেকুটে নিয়ে চলে যায় রাগী পিঁপড়েরা।
দেখাতে পারি না তোমাকে, আমি কত নিরেট শূন্যে চেরা।
অর্ধেক মানুষ
বৃষ্টির রেখা ধরে আকাশের কিছু বিশুদ্ধ জল নেমে
মাটির মৌনতায় ভেজায় কেঁচো আর গাছেদের বাড়ি।
খেয়ালী ফড়িং ওড়াতে ওড়াতে রোদ যায় ঘেমে,
গতরাত জেনে গেছে স্খলনের অভিমান কত পাহাড়ী।
হলুদ পাতায় লিখে রেখে সন্ন্যাসী বট তার শোক,
ডালপালা নুইয়ে সেজে থাকে পাখি ফেরা মন নিয়ে রেঙে।
শীত রাতে জ্বলে গিয়ে একা একা নিভে গেছে যে আলোক,
তার ছাই পড়ে আছে বিষহীন সাপের মতো মাজা ভেঙে।
আমি অক্ষরে লিখে নিতে পারি না সব কাঁচের মেঘ,
সময় তাতে রোজ রোজ টোকা দিয়ে ভেঙে দেয় মনোযোগ।
কৃষকের মতো আমাদের চোখে নেই মরশুমি উদ্বেগ,
ভাবি না সাবলীল অভ্যাসে লেপে নিয়েছি কত রোগ!
এত উদাসীন, এত জ্ঞানপাপী, ফেরে না মানুষের হুঁশ।
আর কবিতা না পড়লে সে তো অর্ধেক মানুষ।
অকল্পনীয়
আমাকে গভীরতা দাও অন্ধের শিকড় থেকে উঠে,
যেভাবে গাছ ধ্যানের সম্পদে মৌন বিকিরণ আনে।
তেমন তড়িৎ ফুলের তরবারি আজ যদি ফোটে...
ঈশ্বরের বাগিচায় আঁধার সব খানখান হতে জানে।
বিশুদ্ধ বেদনার মতো পলি আঁকা রেখে যে স্রোত
রক্তের ডগায় বিশ্বাসমুখর হয়ে ওড়ে পাখি।
শামুক সখ্যতায় গেঁথে নিয়েছি যে লীন অতঃপ্রোত
আমি তার লাঙলের ধারাপাতে আগ্রহী মাটি হয়ে থাকি।
জীবনে সহজ হয় না সব, কলহ বাড়ে খুব।
আমাদের মুখোমুখি উপড়ানো দিন ছুরি হয়ে দুলে ওঠে।
সেলাই থেকে সন্ধে খুলে নিয়ে গেছে অহঙ্কারী ডুব,
আজ আমাদের পালকে খালি পতনের মত দিন জোটে।
এত ভাসা-ভাসা সুখ, অক্ষরে হাত ডুবে কেটে যায় খুঁত।
ধাতব ডালে পাখি গুঁজে কে শেখায় তাকে ফুড়ুৎ?
স্পর্শাতীত
এসো পালক, আমার ভুলের পাশে রাখো ডানা।
মাটির মুখোমুখি ভেসে ওঠে কার ছায়া, কার ছুরি?
ভেতরের বানানে আজ ভেঙে পড়ে আছে সব সীমানা,
আমি কাগজে কান্না ছড়িয়ে রাখি, একা পুড়ি।
তোমাকে আরাধনা ভাবি, পাঁজরের সব ফুরফুরে...
দুই হাতের তালু জুড়ে রোজ রোজ অভাব ঢালি।
তুমি আসবেই ভেবে, সন্দেহ নিত্য নিজেকে কুরে,
ফোকলা কাঠের মতো হয় শূন্যের বর্ণালী।
আগুনের তলানিতে পড়ে থাকি, ছাই যেন মরা বিছে।
পায়রার মতো পুরানো ঢেউ খড়, সব কার্নিসে।
ভালোবাসতে গিয়ে আজ যদি নেমে যাই আরো নিচে,
তুমি কি কোনো চুমু রাখবে না আমার বিষে?
আজ এই ধবধবে ক্ষত হিম বিন্যাসে অবিচল,
কিভাবে আমাদের না-ছোঁয়া হয়ে আছে অতল?
ক্ষয়ের নৈকট্যে
ক্ষয়ের নৈকট্যে খুঁজে পাই ভাঙনের সমঝোতা।
মোচন তো সহজ মায়াবী আলো, পলায়ণকারী।
অবর্জিত ঠোঁট যা তুঁত পাতা খেয়ে হয়েছে ভোঁতা,
রেশম স্নিগ্ধতায় ডুবে লালা আজ তার বাহারী।
আজ এ লুণ্ঠন আলোড়িত নিবিড় পালকে উজ্জ্বল,
আমাকে অন্ধ করে ফেলে রাখে মার্জিনে মেঘ ভেঙে।
সীমায়িত সাধ ওড়ে। আপাত ক্ষণস্থায়ী, সফল...
রক্তের মৌনতায় আত্মহত্যার মতো চুপ রেঙে।
পাতা পতনের আয়ুকালে দাঁড়িয়ে এ বৃক্ষ ঋণ,
আরোগ্যের ইঙ্গিতে গড়ায় ঈশ্বরী জল যেহেতু।
চোখের কোটরে রোপিত সাধনার মতো গহীন
আমার নাব্য পঙক্তিতে জেগে তুমি অক্ষর-সেতু।
চিরকাল নির্মিতি পীড়ন, মর্মে শিকড়ের ফলা।
বক্ষের নীচে গাঢ় ক্ষত, ঊর্ধ্বে ঢেকে রাখি না-বলা।
অণ্বেষণ
কারা সব আগুন রেখে গেছে আমার এই পোড়া মনে,
এ আগুনের কোনো দায় নেই, শুধু ধূসরতা ছাড়া।
বেদরদে ঘোড়া ভিজে যাওয়া রবিবারের বাগানে
সাপের ফেলে রাখা মায়া নিয়ে চুরমার শেখে ইশারা।
কতটা আঙুল খুলে দিতে পারি বিকশিত আহ্লাদে!
লাগামহীন আদর নিভে গেলে মাটি পড়ে থাকে একা।
হরিণী জ্বর নিয়ে এই উন্মাদ পঙক্তির অনুবাদে
হিংসার মতো ফিরে এসে ভেজা হাত সেঁকে নেয় তার লেখা।
না-পাল্টানো ছুঁয়ে আছি এতদিন জাদুকরী কাগজে,
হলুদ হেঁটে এসে ঠেস দিয়ে বসে আছে সারহীন ক্ষেতে।
প্রশ্নে পড়ে থাকে না-খোলা দেরাজ, কেউ কেউ বোঝে
ঘোরের ভিতর টিকটিকির লেজ-কাটা এই শীতে।
নির্বাচক সব উন্মাদ, আমি ঝুলে আছি ক্রুশকাঠে।
ফসল এড়িয়ে ছোঁ তার খুশি আজ পোকাময় মাঠে।
ক্ষত মনোযোগী
মরা ঘাসের ভিতর বিকেল ঝুলিয়ে সমঝোতা
চুপ হয়ে আছে। কাম্য বৃষ্টি নেই প্রত্ন প্রহরে।
যে যার আড়ালে লুকিয়ে রাখা আহত কথা,
আজ মুগ্ধতা আঁকে বাহ্য পরজীবী অক্ষরে।
চাতক দিয়ে লিখে আসা হয়নি লতানো জল।
অভিমান গড়িয়ে পড়ে কার সে ছদ্ম খরায়?
শূন্যতা ফেনিয়ে উঠে আজ দাগ দাগ সম্বল,
মুঠিজুড়ে খাবি খায়। মৃত গিরগিটির দ্রাব্যতায়
আমার উদাসীন সন্ধ্যে নেমে এসে বিলীন।
কোন আক্কেলে বুকের পাখি খুলে বলা যায়
উড়ান থিতু বিন্দুতে জমেছে পাললিক ঋণ?
রোদ, হিংসে হয়ে থিতিয়ে আছে আমপাতায়।
বেবাক ক্ষত হৃদয়ে, আর আমি ক্ষত মনোযোগী,
তোমাকে আরোগ্য ভাবি, তত বেড়ে যায় রোগ-ই।