একক কবিতা সন্ধ্যা ।। ঊষসী কাজলী

usashi

ঊষসী কাজলী-র  এক গুচ্ছ কবিতা

 

 

বান্ধবগড়ের দুপুর

 

সেই দুপুর আমি পেয়েছি
মনে মনে অনেকেই চেয়েছে যে নিরালম্ব গ্রীষ্মদুপুর
আর আমার কল্পনা করে নিতে বাধা নেই
আমি এখন বান্ধবগড়ের কুঁয়ো দেখব

কত লোকে কুঁয়োর মধ্যেই রেখে দিল হাতঘড়ি ও মধ্যবয়স
তেজিয়ান ঘোড়ার স্বপ্নে কেউ রচনা করল ময়দান

আমি এখন বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই সরিয়ে
চলে এসেছি কুঁয়োর কাছে
বাবলা আর শিরীষের এই জঙ্গল কেমন নিঝুম
এমন ছায়া আগে দেখিনি—
তামাক পাতার ঘ্রাণে ছুটে যাইনি কোথাও
তবু বান্ধবগড় খুঁজেছি
কত কোটি বছরের ঠান্ডা জল জমে আছে কুঁয়োর ভেতর?
এই নিদাঘ দুপুরে বান্ধবগড়ের কুঁয়োর ধারে আমি
বিকেল অব্দি জিরিয়ে নেব।

 

 

 

জঙ্গলের রাস্তা

 

মসৃণ পথ ছেড়ে আমরা এখন
আনকোরা জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে পড়েছি
আমাদের রসদ সম্পর্কে আছে আশ্চর্য রকমের
আস্থা ও দম্ভ
মাথার ওপর আকাশের জায়গায়
সবজে কালো জাফরি চাঁদোয়া
ঘন নীল বনের ভেতর শ্বাপদ ফাঁদ
সাগ্রহে জড়াচ্ছি আঙুলে
ছুঁয়ে দিচ্ছি অচেনা বিষলতা, ইতস্তত
পা পড়ে যাচ্ছে ছোটো বড়ো গর্তে
রোমাঞ্চে আমাদের তিরতিরে বুক
ফুলে ফেঁপে উঠছে
জঙ্গলের রাস্তা ক্রমে জটিল ও সঙ্গিন
আমরা মসৃণ পথ ছেড়ে এসেছি বহুক্ষণ।

 

 

 

এপ্রিলের ভেতর

 

এসো,
দেখি— কী আছে এই এপ্রিলের ভেতর!
মার্চের দিনগুলি আমাদের কেটেছিল দোটানায়
স্পষ্ট করে বললে, আমরা লড়াই চেয়েছিলাম
অনুকূল ছিল আবহাওয়া
শুধু প্রস্তুতি সারা গেল না বলে
দিনগুলি কেমন অবলীলায় যেতে দিলাম!

সূর্য এখন উল্লম্ব, তেজে ঢালে রৌদ্র
ক্লান্ত, নির্বীজ কাটা ফসলের মাঠ
ঠা-ঠা দুপুরের কাছে হাঁটু মুড়ে কারা
ছায়া চায়, বুনোহাঁস ওড়ে ইতিউতি—

আমরা বিমূঢ়, আকাশের দিকে চাই
থেকে থেকে বাজকুড়ুলের ডাকে চমক ভাঙে
এপ্রিলের ভেতর আমাদের যাত্রা
কোন পথ নেবে!
দেখি, একটি-দুটি কৃষ্ণচূড়ার রক্তফুল ফোটে
এই এপ্রিলের ভেতর, আর ঝরে যায়।

 

 

 

ফুলগাছ নেই

 

কোথাও কোনো ফুলগাছ নেই
আমরা রাখিনি দৈনিক পরিচর্যা ও
ফুটে ওঠা দেখবার মতো বেতাব খেয়াল
আমাদের দরকার ছিল মাত্র ব্যালকনি
সিঁড়ি ও দু'কামরা ঘর, বসবাসের—

লম্বা লম্বা রাস্তাগুলো মসৃণ করতে আমরাই
বরাত দিয়েছি, গাছগুলো তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলার
তারা অনাবশ্যক ডালপালা মেলে আর
অবাধ্য বুক উঁচু করে আকাশের সঙ্গে
কী যে কথা চালাচালি—
যা নিয়ে আমাদের সন্ততির অনর্থক কৌতূহল
আর অপচয়ে যেত যৌবনকাল

আজ কোথাও কোনো ফুলগাছ নেই, ভাবো
নিজে থেকে জন্মাতে ভয় পায় যাতে
ছড়ানো হয়েছে নিবিষ্ট রাসায়নিক,
গবেষক সাফল্য এনেছেন নির্বীজকরণে

অন্যদিকে প্লাস্টিক আর রকমারি ফুলে
আমাদের ঘর, দেওয়াল, টেবল ও ফুলদানি সাজানো
দেখো, কেমন কাজ কমিয়ে ফেলেছি আমরা!

 

 

 

সুগন্ধী বিপনী

 

একটা সুগন্ধী বিপনীর বিজ্ঞাপনে
মোহিত আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি—
উলটো হয়ে স্বপ্নে শব্দগুলো ওঠাপড়া করেছে রাতভর।
শ্বাস বন্ধ হওয়া তীব্র ঘ্রাণে
ঘুম ভেঙে আমারই চুলের ভেতর
ডুবে মরে যেতে চেয়েছি
যত হত্যা, ঘাতকের সফল ছুরি-
প্রবঞ্চনার রস মেশানো আরকে
দু'এক বিন্দু সুগন্ধীর সমীকরণ সমাধান হয়ে যাচ্ছে

যা বলছি তা ঠিক চাইনি
যা লিখেছি তাও নির্মাণ যেন
আর রক্তের বদখত নেশায়
সুগন্ধী রুমাল ওড়াচ্ছে ভোর—
বলছে, কাল আমাদের জন্মদিন অথবা মৃত্যু
রঙিন লজেন্স-মোম-কেকের ভেতর
আরও অনিদ্রা আরও সুগন্ধী বিজ্ঞাপনই ঠাসা থাকবে।

 

 

 

ডিরেকশন

 

এইখানে এসে তারা হাত ছেড়ে দেবে পরস্পরের
এইখানে একটি প্লাটফর্ম চাই, একটু নির্জন
এত উজ্জ্বল নয়; আলো চাই, মরা বিকেলের
ট্রেন-ছেড়ে-যাওয়া শব্দ আর ছায়া।
বেশি কথা নয়, শুধু অবয়ব খেলা করবে মসৃণ
আগে ও পরের গল্প সকলেরই জানা—

গোল-গোল চোখে শুনে নিচ্ছে ইউনিট

ডিরেক্টর বোঝাচ্ছে, এইখানে এসে তারা
কীভাবে ছেড়ে দেবে পরস্পরের হাত।

 

 

 

তিরিশোত্তর

 

এক হাতে মজে যাওয়া নদী
অন্য হাতে অসহায় দুপুর
কাকে নিয়ে কী করা যায় ঠিক জানি না
শুকনো খটখটে এই ঋতু গান গেয়ে
ভিজিয়ে দিতে না পারার ব্যর্থতা লুকোনোর অনুশীলনে আছি

বৃষ্টির কথায় আভূমি মনে পড়ছে
জমি আবাদের পূর্ব শোক
রসুনের কোয়া থেকে খোসা ওড়ে
পেরিয়ে আসা জল তত সহজ ছিল না
গলে যাওয়া সুখ ভারি পাথরে গড়ালে
মজা নদী আর দুপুরই পড়ে থাকে ঠিক!

নাকি ন্যুব্জ সেতুর দোলন লিখতে চাইছি
অথচ এই তিরিশোত্তর চুপচাপ শিরীষের শিরায় শিরায়
শান্ত হারের ইঙ্গিত ছাড়া
আর কিছুরই কোনো ক্রম সাজাতে পারেনি।

 

 

ইচ্ছে

 

দু একটি তারা ওঠা চুপচাপ আকাশের নীচে
আমি ঘুমিয়ে থাকব

মানুষের শোক ও তাপের পাশে মজা নদী
ওই পাড়ে শিশুদের আঁতুড়ঘর, গুলঞ্চ বন
গ্রাম থেকে কোথায় কারা চলে গেল
তাদের বুকের ধুকপুকটুকু রেখে

মধ্যরাতে বিপন্ন হাওয়ারা পাক খায়—
আমি তাদের গতি বুঝতে চেয়ে বিমূঢ়
ফিরে আসছি, কাঠবাদাম আর কৃষ্ণচূড়ার দেশে

একটি দুটি তারার আকাশ
এখানে আমি চুপচাপ, ঘুমিয়ে থাকব।

 

 

 

গানের রাস্তা

 

এমন বর্ষার দিনে তোমার হস্টেলে গিয়ে
জেনেছিলাম
আর কিচ্ছু না ; অতুলপ্রসাদী শোনো তুমি
চা করো দুধ ছাড়া, ডাকো সঙ্গকে শুধু চায়ের আলিসে
গান শোনো একা একা, অতুলপ্রসাদী

কত প্রযত্ন লাগে তোমার বয়সে যেতে
এই ভেবে আর সব ফেলে শুধু 'তোমার বয়সে যাব'
এই কথা ঘসে ঘসে রাতদিন
আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাটা সুতো
তোমার বয়সে এসে, আজ আমিও পেয়েছি খুব
অতুলপ্রসাদী; জানো—
গ্রিলের ওপারে যত এপারেও
শুনি 'এমন বাদলে তুমি কোথা'
ভাবি, তোমার বয়স আজ
আমার বয়েস থেকে
কত পাক ঘুরে আমাদের গানের রাস্তা লিখে যায়

 

 

রোহিণী নক্ষত্র থেকে

 

রোহিণী নক্ষত্র থেকে আমাদের গ্রহটিকে দেখায়
ক্ষুদ্র ও স্থির

এখানে আমাদের জন্ম, মৃত্যু, তরঙ্গ ছোটো ছোটো
এখানে প্রেমের পাশে গুমোট, চাপা ক্ষোভ
খর্বকায় হাত পা, ছড়ানো সশব্দ উল্লাস
তারই পাশে ফুটে থাকে নয়নতারা ফুল

এসবই আমাদের নিজস্ব ঘটনা
দূর রোহিণী নক্ষত্রে এসবের আঁচ পৌঁছায়নি, কোনোদিন

মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...