তুলসীদাস মাইতি-র এক গুচ্ছ কবিতা
ভাঙা সাজঘর ও আরশিতে মুখ
ভাঙা সাজঘরে মুখোশ খুলে আরশির মুখোমুখি হই।
এই মুখ, এই চোখ, এই সৌখিন শরীরে লেগে আছে যে কালির দাগ
তা মুছে ফেলি নির্বিকার।
নির্ভার এই দৃশ্যে সুখ আছে। আছে নিজস্ব আয়োজনের আলো।
এই অদৃশ্য আলোতেই
অন্ধকার গলিঘুজি পেরিয়ে পৌঁছে যাই আকাশের কাছে।
অভিনয় ফেলে, সাজানো আবরণ ফেলে
অন্তরের ডাকে এভাবেই নিজের সাথে দেখা হয়।
ভাঙা সাজঘরে মুখোশ ফেলে এভাবেই আরশি খুঁজি।
ললিত পঞ্চম
এক বসন্ত সন্ধ্যায় একা চাঁদ।
ললিতের সপাট তানে তার অভিমান যখন পঞ্চমে
একান্ত সোহাগে নিভৃত নক্ষত্রটি তখন
তাকে ছুঁয়ে গেলো।
কেউ দেখলো ঈশ্বর। কেউ দেখলো প্রিয়মুখ।
এই দৃশ্যে ভেসে গেলো অজস্র কবিতা ও
সঙ্গীতের কলতান।
নদী ও সেই বৃদ্ধ বৃক্ষ
নির্জন ঘাটের কাছে বৃক্ষটি ক্রমে বৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
শিকড় ছুঁয়ে নদীটি বয়ে গেছে তার জন্মের বহু আগে থেকেই।
বৃক্ষটি জানে হঠাৎ ভেসে আসা বৃষ্টিরাশি কেমন করে ফুপিয়ে ওঠে।
সে জানে নতুন চর ও সবুজ ঘাস-গুল্ম মিশে গিয়ে দ্বীপ হয়ে যায়।
নৈঋত কোণে পড়শি শ্মশানভূমি,
অজস্র দাহকর্মের কোলাহলও লেগে আছে তার প্রাচীন শরীরে।
এসব দেখতে দেখতে শান্ত নদীটি কখনো কখনো অস্থির হয়ে ওঠে।
নোঙরহীন নৌকোদের দেখে তার এখন শাখা বাড়িয়ে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে।
বর্ষা- নদীর বুকে সেও ভেসে যেতে চায়। কিন্তু পারে না।
এভাবেই দিন পেরিয়ে- রাত পেরিয়ে - বছরের পর বছর পেরিয়ে
বৃক্ষটি আরো বৃদ্ধ হয়ে যাবে।
চোখের সামনে নৌকোরা ভেসে ভেসে বেড়াবে।
জীবন শেষ করে মানবশরীরও পুড়ে নিঃশেষ হবে।
শুধু বৃক্ষটির ইচ্ছে পূরণ হবেনা। তার সবটুকু স্বপ্নকাল ডুবে যাবে মহাকালের অতল ঘুমে।
সামান্য মানুষ
ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারি সব ছেড়ে। ইচ্ছে হলে নিজেকে আটকে রাখতেও পারি নিজের তৈরি কারাগারে।
প্রথমটি তেমন সহজ নয় বলেই শেকল পরতে চাওয়া।
এই ঘরদোর, এই নিকুঞ্জ ছায়া এমনকি তোমাকেও
ছুঁয়ে আছি বহুকাল।
স্মরণকালের রঙ দিয়ে একেছি সুদীর্ঘ মায়া। ব্যসনের আরাম যখন গ্রাস করেছে আমার পথগুলিকে তখন মনে হয়েছে আমিও আসলে একটা জীব মাত্র। অন্য কোথাও যেতে পারি অনায়াসে 'কিন্তু কেনো যাবো?'
আহারে বিহারে 'এই বেশ ভাল আছি ' বাক্যবন্ধটি ভালো না লাগলেও তার অনুশীলনে সুখ আসে।
কে নিয়ে যায় আমাকে রাত্রির সরাইখানায়? কে নিয়ে যায় আমাকে সার্কাসের মাঠে- বারের খেলায়?
এই সহজ প্রশ্নের মধ্যেই আমরণ যুদ্ধের অভ্যেস
রাজার মতো বসে আছে বুকের সবকটা অলিন্দে।
কোথায় পালাবো আর!
শেকলে আটকে রেখেছি সব চাওয়া।
আমি এখন শুধুই জীব। সামান্য মানুষ। সাধারণ মানুষ।
বিরাম
আজকাল কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে নীরবতার আশ্রয় নিই।
সকল অভিমান রাগ ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ঘুমের অনুশীলন করি।
চেতনার ভেতর দেওয়াল ওঠে । রক্তে হাড়ে জমে ধুলো।
আত্মপরিচয় আড়াল করে
বিপ্রতীপ চলাফেরা আর নয়।
এবার অবিরাম বিরাম।
এবার শান্তির দিকে যেতে চাই। এবার আনন্দের দিকে যেতে চাই।।
জীবন ও বিবাহ
গাছেদের বিয়ে হবে বলে নিষিক্ত ফল ভাসে জলে । তারপর বর্ষা পেরোলে স্রোত ভেঙে নিভৃত মাটি খুঁজে নেয়।
এভাবেই গাছেদের সমাজ গড়ে ওঠে। জলের ভেতর, রোদের ভেতর থেকে শুষে নেয় বাঁচার আস্বাদ।
ঘর দোর বৃহৎ হলে তারা ভাসিয়ে দেয় প্রেম। উড়িয়ে দেয় সুখ। শেষে নাবাল বাসরে বুক ছুঁয়ে রেখে যায় স্মৃতি।।
জীবন আসে। জীবনের স্রোত মিলিয়ে যায় এক ভুত থেকে আর আর এক ভূতে। এভাবেই বয়ে চলা। বয়ে নিয়ে চলা।
বিবাহও একটি ঘটনা। একে অপরকে বহন করেই জীবন।
তিস্তার পাশ দিয়ে
একদিন তিস্তার পাশ দিয়ে যখন আমার গাড়ি ছুটছিল
তখন আমি দেখেছি বিস্তৃত সবুজ।
বৃক্ষের কাঁখে, পাহাড়ের খাঁজে ও ঝর্ণার রঙে দেখেছি তোমাকেই।
এ আমার প্রলাপ নয়। স্মরণকালের ছায়াও নয়।
প্রজনন পিপাসু পাখিরা সুনিবিড় অরণ্যে যেমন সহজে গেয়ে ওঠে এ তেমনই।
গাঢ় অবেচেতনস্তরে এক এক রকম অনুভূতির বীজ সাজানো থাকে।
তাই তিস্তার রূপ আর তোমার মুখ সেদিন মিলে গিয়েছিল আমার চোখেও।
প্রেমে - অপ্রেমে
অঙ্গুরি বিনিময়ের একান্ত অনুরাগে বুকের ভেতর কান পেতে কেউ বলেছিল একদিন চুরি হয়ে যাবে তার ঘুম।
আসক্ত ছোঁয়াছুঁয়ি আর অবাধ্য আদরের খেলা সাঙ্গ হলে ঘুম রোগের চিকিত্সা করে নিয়েছে সেও। এখন দেবদাস হতে চেয়ে দুষ্মন্ত রাজা হয়ে বসেছে নির্বিঘ্ন আসনে।
সুখ দুঃখের কথা এখন স্পর্শহীন অকাতর অতীত। শব্দহীন ভাষায় অভিমান নেই। বৈরাগ্যের সুখ নেই। ভালোবাসা নেই, তাই শিহরনের ঘ্রাণ নেই। নেই কথা-উপকথার বিকিরণ কিংবা নির্ঘুম রাতের অস্থিরতা।
তবুও অন্যপক্ষ নাম আঁকা আংটি খুঁজে বেড়ায়।
রাগ রাগিণী
নিঃসঙ্গ সন্ধ্যে। ছায়ারাও পটদীপ গেয়েছে আজ।
বসন্ত দিনের রঙ ফেলে সবাই এখন চলে গেছে আস্তানায়।
সারাদিন পলাশ বনে ঘুরে ঘুরে পরবাসী মেয়েটি
চাঁদের কাছে যায়। কোমল গান্ধারে এসে থামে পড়শির আলাপচারিতা।
সাবধানী নূপুরের ষোলো কলা তান।
রাত্রিচর জীবনের প্রস্তুতিপর্ব এখন।
প্রচ্ছদপটের রকমফের।
কলঙ্কপত্রের নৌকো ভাসে কোলাহলহীন জলে।
দৃশ্যত রাগ-রাগিণীর চলাচল আর জীবন অনুসন্ধান।
ধর্ম ও অধর্মের সংকেত
কখনো কখনো অধর্ম গায়ে মেখে বাড়ি ফিরি।
ক্রমশ রাত বাড়লে পবিত্র জলে স্নান সেরে নিই।
ঘুমিয়ে পড়ি সহজ বিছানায়। সুনিবিড় অন্ধকার পেরোতে পেরোতে ভুলে যাই ধর্মের সরল রীতিনীতি।
চিনতে ভুল হয় ধর্ম ও অধর্মের সংকেত। নিত্যদিন শুনি ঘণ্টাধ্বনি, ভক্তির আজান। সন্ধে - সকাল ছায়ার মতো ঘুরে ধূপের গন্ধ কিংবা প্রসাদী সুর।
তবু বেড়ে ওঠা অন্ধ -কোলাহলে চোখ ও কান ঢেকে যায়। মগজেও লাগে বিভ্রম- তরঙ্গ।
অজান্তেই খসে পড়ে ধর্মের বাকল।
বাইরে দাঁড়িয়ে একা বাকহীন, আবহ বাতাসে বন্ধ হয়ে যাওয়া জানালা দরজা খোলার চেষ্টা করি।
প্রকৃত দরজার কাছে নতজানু হয়ে খুঁজি ঈশ্বর।
তবে চাইলেও অন্তরের দরজা খুলতে পারি না।