একক কবিতা সন্ধ্যা ।। প্রভাত মিশ্র

prabhat

প্রভাত মিশ্র-এর এক গুচ্ছ কবিতা

অনিশ্চিত মেঘ

অনিশ্চিত মেঘ আসে, উড়ে যায় আকাশের পারে...
আছে তো অন্ধকারে ওই পারে তাদের নগরী;
আমরা তো চেয়ে থাকি, চেয়ে চেয়ে থাকি দিনরাত---
ভাবি এখনই নামবে তারা আমাদের শস্যহীন মাঠে।

কালিদাস নেই আজ, কে আঁকবে বিরহীযাপন?
প্রেম নেই পৃথিবীতে, বিরহ কিভাবে বাঁচে আর!
আমাদের সভ্যতাকে মেঘ কিছু বাঁকা চোখে দ্যাখে।
দ্যাখে বৃক্ষ নেই আর, ভাষা নেই পিতৃপুরুষের।

মেঘ আসে, উড়ে যায় আমাদের স্বপ্নের মতোন...
আমরা তো চেয়ে থাকি, চেয়ে চেয়ে থাকি দিনরাত।

বড় দিন

ফুরিয়ে গিয়েছি আমি, তবু দেখি খুঁটে খেতে ব্যস্ত দুটি নবীন শালিক
তাকায় আমার দিকে ভীরু ও সলজ্জ চোখে বিকেলবেলায়---
পড়ন্ত রোদ এসে লুকোচুরি খেলে যায় প্রাঙ্গনে আমার,
ছুঁয়ে যায় চুপিচুপি আমার দীর্ঘশ্বাস...ধ’রে ফেলি আমি।
অনেক ভাবতে থাকি, আজ কখন যে হ’য়েছিল ভোর!
বলি না: ‘অপূর্ব রূপ দেখা দিলে কেন যে কে জানে।’
কিছু তাপ, কিছু শীত ঘিরে থাকে এ-দেহ আমার,
বিস্মৃত হতে থাকি কী ছিল আমার কাজ এখানে ভুবনে!
কী করেছি দিনরাত কী দেখেছি পথে পথে কী শুনেছি পাতায় পাতায়...
ভুলে বসে আছি আজ বারান্দায় একা, একা একা এই দুটি শালিক যেমন
ভুলে গেছে ওই ঘাসে যা ছিল খেয়েছে কাল, আজ কিছু নেই---
খুঁটে যায় অবিরাম বাসায় ফেরার আগে, খালিপেটে দ্রুত খুঁটে খায়...
আমিও অতীত খুঁটি--- যদি সে স্বপ্নগুলি ফিরে পাওয়া যায়।
মাঘ মাসে বড় দিন, আঁধার আসবে সেই সোয়া সাতটায়।

 

পুরাতন থাম

দোষী কপালের দিকে চোখ তো যায় না, বেশ ভালো থাকি।
দর্পণে দেখি না মুখ যখন-তখন,
কেবল চানের পর কোন কোনদিন চুলগুলি দেখি,
সৌজন্যে চিরুনি।
শাদাকালো চুলগুলি...স্মৃতির অতলে ডুবে যাই...
উঠতে পারি না---
জেনেশুনে পান করা বিষ কামড়ায় পেট, বমি-বমি পায়
অপেক্ষা করি না---ভাত খেতে যাই,
লেবুমাখা ভাত খেলে বমি চলে যায়।
লেবুর সুবাস পেতে এ-জীবনে বড় সাধ হয়।

তবে দোষী কপালেরই গায়ে ঠেস দিয়ে বসি সন্ধ্যায়---
কপাল তো নয় বারান্দার পুবে থাকা পুরাতন থাম।
এই থামে লিখতাম আমার নামটি আমি বালকবয়সে।

এই কয়েকবছরে স্যাঁৎসেঁতে ঝুরঝুরে হ’য়ে গেল থাম---
লেখাই হয় না, মুছে মুছে যায়, যতই লিখি না নিজনাম!

আমার কপাল আর এই থাম আমি আজ একার্থে ভাবি---
কপাল যায় না দেখা,
এ-কারণে আমি কখনো ঠেস দিই, কখনো বা মাথা ঠুকি থামে
নির্জন অন্ধকারে একা একা প্রতিসন্ধ্যায়।

 

পথ

তোমাকে ভোলার কথা ভাবতে পারি না
যদি বহুদিন পর
দেখা হয়ে যায় পথে, চিনবে না যদি ভুলে যাই।
পথ তো অনন্তনাগ---
শুয়ে আছে সারাবিশ্ব আদিকাল থেকে,
আমাকে থামিয়ে দেয় তার বিষদাঁত!
জেনেশুনে পান করা বিষ আছে অন্তরে আমার,
বিষে বিষক্ষয় হবে---আমাকে চিনবে।
কথা কি বলবে কিছু? অকস্মাৎ উঠে যাবে বাসে?

পথ তো অনন্তনাগ, শুয়ে আছে সারাবিশ্ব আদিকাল থেকে,
আমি আছি পথে।
হয়তো আবার বহু-বহু দিন পর কোনদিন দেখা হয়ে যাবে,
চিনবে না যদি ভুলে যাই।

তোমাকে ভোলার কথা ভাবতে পারি না।

 

সময় ফুরায়, স্রোত

স্বপ্ন দেখার দিন ভেসে ভেসে চলে গেছে যেখানে যাবার...
শ্রাবণের ভরা নদী, পোড়া কাঠ নড়ে ওঠে জলের উপর।
বিকেলে দাঁড়িয়ে আমি, কেন যে দাঁড়িয়ে জলের প্রণাম নেওয়া তীরে।
হায়, এই জলস্রোত একটু অপেক্ষা যদি করে,
নেমে যাব জলে আমি, গায়ে গা লাগিয়ে তার ভেসে চলে যাব---
আমাকে নাচাবে খুব, ডোবাবে ওঠাবে, চাইবে তলিয়ে দিতে জলে।
আমারও সাহস আছে, সময়ের সাথে আমি যুদ্ধ করে জিতে যাই হেরে।

যাব আমি, যাব আমি হে স্রোত তোমার সাথে, দাঁড়াও একটুখানি তীরে,
সোনার শেকল-ছেঁড়া পাখি-পাখি দিনগুলি... জানিয়েছি বিদায় তাদের
দাঁড়াতে বলি নি, জানি তো তাদের তুমি আনবে না তীরে।
কিন্তু আমাকে তুমি ফিরিয়ে আনবে, এইটুকু বিশ্বাস আছে।
যাব আমি, যাব আমি হে স্রোত, তোমার সাথে, দাঁড়াও একটুখানি তীরে।

ওপারে সূর্য নামে, ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ, দিবসের ক্লান্তিতে লাল...
যাব আমি, যাব আমি---সময় ফুরায়, স্রোত দাঁড়াও একটুখানি তীরে।

 

ছাতা

জানি তোমার মতোন কেউ নেই আর জগতে আমার।
ফিরেছিলে দ্বিপ্রহরে একা একা এক সোমবার
মেঘ ছিল না কিন্তু চকিতে বৃষ্টি এলো রোদের ভিতর
ফিরে গেলে... তাকাই নি, সময় সত্তর :
আমি তো শব্দ খুঁজি নারীতে, বিপ্লবে... আর যাকে পাই কাছে
শব্দ খুঁজি কবিতার, শক্তি যা টাঙাতেন গাছ থেকে গাছে।
তখন তোমাকে নয়, ভালোবাসতাম আমি রোদ, বৃষ্টি, পথ...
ফিরতে পারলে তাই, আমিও ছিলাম সহমত।

এক সপ্তাহ গেল... কেটে গেল প্রায় দুই হাজার সপ্তাহ,
ক্রমশ পাঁজরখানি জ্বালাতে চাইল এসে ভস্মঢাকা দাহ।
যে কোন রৌদ্রদিনে তোমার ছায়াকে দেখি একা হেঁটে যেতে
যে কোন বৃষ্টিদিনে বিস্মৃত হই আমি সাথে ছাতা নিতে
বেরিয়েই মনে পড়ে, ভাবি। পথে তো রয়েছ তুমি ছাতা---
যেতে যেতে গাছে গাছে আজ আর লিখি না কবিতা।
কী হবে কবিতা লিখে, কবিতা কি হবে আর আমার একার,
জানি তোমার মতোন কেউ হবে না এ জগতে আমার।

 

ঠিকানা

হারিয়ে গিয়েছি ভাবো? হারাবো কোথায়? মনে আছে তোমার ঠিকানা।
স্বপ্নগুলি ছেঁড়া ঘুড়ি পাড়ায় পাড়ায় গাছে গাছে
পাখি এসে ঠোকরায়, সাথে নিয়ে যেতে চায়
আকাশে যাবার ছিল এসব ঘুড়ির...

নিরাশ্রয় পড়ে গেল গাছের সমাজে।
আমিও মুখ থেকে বিজ্ঞাপন খুলে রঙিন মুখোশে
পুনরায় মঞ্চে এসেছি। হয়তো ভুলেছি আজ আমার ঠিকানা।
হারিয়ে যাইনি, মনে আছে তোমার ঠিকানা।

 


আজ উঠি

এইভাবে বহুদিন বেঁচে থাকা গেল রসে-বশে।
মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়, প্রেম হয় মানুষের সাথে।
বাজার-ফিরতি কারা উঠে আসে বাড়িতে আমার।
সান্ধ্য আঁধারে আমি চেনাচেনা মুখগুলি দেখি---
দাদা, এতদিন কোথায় ছিলেন?
কবেকার কৈশোরের ভাই-বন্ধুরা, মার্বেল খেলার সাথী
শীতলাতলায়...আমি বসে বসে দেখি আর শুনি
তাদের গল্প : দ্রব্যমূল্য, রাজনীতি, খুন, ধর্ষণ---
ধানের ফলন ... চিন্তিত তারা খুব
এ-সময়ে বেঁচে থাকা নিয়ে, মুখ দেখে বেশ বোঝা যায়।

বৃষ্টি থামলে তারা একে একে উঠে চলে যায়।

আজ আবার এলো বৃষ্টি বহুদিন পর সন্ধ্যার মুখে
বাজার-ফিরতি কারা উঠে এলো আমার বাড়িতে
চেনাচেনা মুখগুলি, আগেকার চেনামুখ নয়---
দাদা, এতদিন কোথায় ছিলেন?
দাওয়ায় বসেই এরা শুরু করে দ্রব্যমূল্য, রাজনীতি, খুন...
চিন্তিত এরা খুব এ-সময়ে বেঁচে থাকা নিয়ে,
মুখ দেখে বেশ বোঝা যায়।
বৃষ্টি থামলে সকলেই উঠে চলে যায়।

আমিও ভাবছি উঠি, বহুদিন থাকা গেল এই পৃথিবীতে।

 

দূর ভবিষ্যৎ

দূর ভবিষ্যৎ আমি চেয়ে চেয়ে দেখি ভোরবেলা
এই যে টগর গাছ, শাদা শাদা ফোটা ফুলে ভরা
কাল রাতে এক খণ্ড মেঘলা আকাশ পড়েছিল এইখানে ভেঙে।

কোন কোন শ্রাবণের ভোরে দেখি আমার পাড়ায়
মেঘই থাকে না, কেবল কুয়াশা, কুয়াশাকে ঘিরে থাকে
দিগন্তবিস্তৃত ধোঁয়া, মানুষেরা জাগে না তখনও।

বুঝতে পারছি আমি বদলে যাচ্ছে বাঁচার নিয়ম।
বাসনা বদল হ’লে দুঃখ বদলাবে, বদলাবে
সুখ, ত্রাসের জায়গা নেবে উল্লাস!

এইসব ভাবি, ভয় পাই, অবশ্য সেদিন আমি থাকব না
আর।

 

কাগজের তরী

আমার তো মনে পড়ে বালকবেলার সেই কাগজের তরী
খবর কাগজে তৈরি, আনন্দবাজারই হবে, খালে
ভাসিয়ে দিতাম... গ্রামে গ্রামে ঘেরা খাল, অথচ
গ্রামের কোন খবর থাকত না কাগজে তখন।

সেই তরী একদিন কাঁসাইতে এসে পৌঁছেছে
শহরের পথ ধরে এই নদীর তীরে লোকেরা বেড়ায়

আমিও এখানে আসি, চেয়ে থাকি তীর থেকে দূরে...

কাগজের তরী আজ কার শবদেহ বুকে ভেসে যায় জলের কল্লোলে!

মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...