আদি...
( উৎসর্গ: কাজী তৌফিক নওয়াজ আদিত্য )
তোমার নিমিত্ত এই লেখাঘোর, অঝোর শ্রাবণ
মেঘে-ঢাকা মর্মভেদী, মায়াঘন করুণার গান
দিগ্বিদিক আলো করে — ছুঁয়েছে সে হৃদয় গহন
বিস্মৃতির পরপারে, 'এই আছে, এই নাই' টান
সহজে যায় না ভোলা, 'আদি,আদি'... অন্তহীন সুর
অশ্রুপাতে ভিজে যায় — হে বেদনা, প্রিয় উপশম
তোমাকে লালন করি, শূন্য গৃহে সুদূর-বিধুর
একাকী থাকার মতো দুইচোখে এনে দাও ভ্রম ৷
আদিত্যভ্রমণে সুখ, নিরবধি, নদী বহমান
অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি, অনুবাদ, চিত্র, চলচ্ছবি
স্থগিত রইল সব... শোকের ভিতরে রহমান...
আত্মার অহমে বাঁচি—আমাকে বলো না তুমি 'কবি' ৷
দিন যায়, রাত যায় — একাকার অঝোর শ্রাবণ
মাটিকে নিবিড় করে হয়ে ওঠে 'আদি'-র ভুবন...
অক্ষমতা
অক্ষমতা, বক্ষে দাও ৷ পক্ষপাত, কথা কম হোক ৷
চোখে-চোখে সখ্য গড়ি। দক্ষতাকে বলি : এসো কাছে,
প্রীতরঙে ত্রিশরণ — স্মরণমাত্রই গাছে-গাছে
পক্ষীকূল, বিধূনন — একে-একে কুসুমিত শ্লোক...
না-আমি বেরোতে পারি, অাঁখিপদ্মে বিল্বদল, তারা...
পুরোনো সুরের কাছে কীরকম পাগল স্বভাব !
মা, আমি জানিনে কিছু, "যত পথ তত মত" ধারা
তোমার চরণে নিত্য — অন্ধকার, আরক্তিম জবা ৷
মূর্ছিত, নিথর, ধু ধু — অবিরাম শূন্যতার পারে
দেখি সে-জগৎবিন্দু — চৈত্যন্যের মহাসমাহার,
অনুজ্জ্বল-সমুজ্জ্বল — দিক-দিশা, যে-পারে, সে-পারে...
'আমিত্ব' কোথায় ? স্বামী, যুগে-যুগে সবকিছু তার ৷
অক্ষমতা, বক্ষে দাও — আরও আরও পাথরের ভার,
ব্যথায় ভরিতে চাহি — সব সুখ তোমাকে, আবার...
পাথেয়
এই তাহলে মাধব, মধুরা তোমার... বঙ্গদেশে
ক্ষণে-ক্ষণে সুপবন বহে যায়৷ প্রফুল্ল কাননে
তুমি দেখা দিলে যেই : সূর্যমুখী একগাল হেসে
কেমন রাঙাটি হল -- মন জানে৷ এ- সন্দেশ জনে-জনে
দিলে তো সন্দেহ ভারি৷ বাড়িঘর সতত জাগর...
অগত্যা গহন, চুপ৷ স্বপ্নবৎ পরিহুরি পাঠে
হৃদয় নিলীন হলে -- কৌতূহলে এসেছে সাগর
আপন ঢেউয়ের তালে, দিলখোলা, শান্তিপুরি তাঁতে...
পাথেয় এ-টুকু, জানি -- মাধব-মধুরা মিলে, দোঁহে
না জাগিলে বঙ্গদেশে, বৃথা এই ভোরের দোয়েল...
সময়, সীবন
ফেসবুকে বেশ সুখে থাকা দায়। কেন না ইমেল
কবিতা আহ্বান করে। ছাপা হলে দিতে অপারগ
প্রিয় সৌজন্যসংখ্যাটি৷ এমন হিসেবী সম্পাদক
আমি ভূ-ভারতে দেখি নাই, প্রভু৷ ফলত হিমেল,
এই হেমন্ত-হাওয়ায় ''মা ফলেষু কদাচন" স্থির ৷
প্ররোচনা ভুলে আমি রচনাকে করজোড়ে ডাকি :
সে কি আসে ? নিজের ভিতরে এক আচাভূয়া পাখি
সম্পাদনা-বেদনায় হয়ে ওঠে আলোকিত তীর৷
তিরবিদ্ধ হলে মন —সৌজন্য-শ্রীসুজনেষু, খাঁটি।
লেখাটি পাঠাই আর একা-একা হিমকুয়াশায়
শিশিরপাতের মতো — কোনও এক অচিন আশায়
বসে থাকি নিঝ্ ঝুম... যেমন আঁধার জুড়ে মাটি ৷
ফেসবুকে বেশ সুখে থাকা দায় — কেন না জীবন
নকশি কাঁথার মতো — দাবি করে সময়, সীবন...
শাল্মলী
এই রাত্রি জাগরণ এনে দেবে রুমির উচ্ছ্বাস
ইতিহাসাশ্রিত এমন ভুবনে তুমি বারবার
হেঁটে যাও জয়ের প্রতীকে৷ অলীক ঘরানা, প্রিয়
বাস ছেড়ে বিপ্রদাস, কতদিন প্রবাসে বিভোর
থেকে অনুবাদে রেখে যাবে স্বীয়-স্মৃতিরেখমালা...
মুক্ত পিয়াশালে হাওয়া হাহারবে ওড়ায় গোধূলি
সন্ধ্যা কাঁপে৷ রাঢ়-বাংলার পথে, যাত্রা দেখে ফেরা —
ওই বালকের চোখে-মুখে অপূর্ব রামকিংকর !
দেবদত্ত-মুক্তভাষ — হেলাফেলা শিশুতোষ-সূক্ত
কবেকার উপকথা, রূপময় কুসুম তোরণ...
সমুদ্রসফেন-বালু — কালোজল, ছলাৎ নিক্বণ
বানানে সতর্ক প্রাণ — ভুলে থাকি গঠন ভঙ্গিমা ৷
আগে-পরে শিরোধার্য — গতি কি আশ্চর্য, সাবলীল
ভাবো, নীরবে দাঁড়িয়ে-থাকা ওই অটুট শাল্মলী...
টগর
যে কথা বলেছি আজ মনে-প্রাণে তাই আস্থা রাখি।
দুজনের রাস্তা এক — পরম্পরা, অনাদি, প্রাচীন...
স্নায়ুতন্ত্রে দীর্ঘ-আয়ু, নীড় বাঁধে ইথারের পাখি
সাবলীল উষ্ণতার ঢেউ তুলে পরদানশিন
এসেছে মনের মধ্যে — চারিদিকে খুশির আতর
"আতুরে নিয়ম নাস্তি" — আমি সে-বিনয় অনুভবে
বক্ষ থেকে একে-একে ছুড়ে ফেলি কঠিন পাথর
ভালবেসে একটি কোমল চারা লাগিয়েছি টবে৷
স্নেহের সিঞ্চনে তুমি — ভূমি-ভূমা, আরও কত কিছু...
কাঙাল না-হলে বলো তন্নতন্ন করে এ-নাগাল
হৃদয়ে আগলে রাখি — গোধূলির কাছে মাথা নিচু
দুচোখ নিমীল করে দেখি সেই মহারুদ্রকাল
অনন্ত সৃজন, দ্বিজ — চণ্ডালিকা -চন্দ্রাহত ঘোর
অন্ধকারে তারা নয় — রাশি-রাশি ফুটেছে টগর।
নুন
সমুদ্র হাওয়ায় আজও মিশে আছে অন্ধকার স্মৃতি...
ছন্দের বারান্দা জানে : পাশাপাশি, হেঁটে যাওয়া ঘোর
সহাস্য মঞ্জীর, বিভা, কে যে কার, ছুঁয়ে আছে দোর
জগৎ জানে না — শুধু মনে পড়ে পুরনো সে-চিঠি
নিঝুম সাঁকোর মতো চুপচাপ, স্তব্ধ বালিয়াড়ি
অমুদ্রিত কথাগুলি হু হু করে সমুদ্র ফেনায়
প্রতিটি চরণে ঢেউ— বেজে ওঠে নিজ মূর্ছনায়
লবনাক্ত প্রেম, ওই ফিরে যাওয়া ভাব, আর আড়ি
এই নিয়ে ছন্নমতি, সারাদিন অসমাপ্ত গৃহ
সম্পর্ক তৈয়ার হয় মনে -মনে —ভিন্ন সামুদ্রিক
ঝাউডালে শীর্ণচাঁদ-নিশীথিনী, তুমি দশদিক
আমাকে বেষ্টন করে—নদীর অধিক সেই প্রিয়
মোহনায় টেনে এনে— দুচোখে জাগিয়ে ছিলে খুন
সেই থেকে ভালবাসা, সমুদ্র হাওয়ায় ওড়ে নুন...
অপেক্ষা
এই যে অপেক্ষা, ভাব, ধূমায়িত স্মৃতির দেউল
প্রীতিমুগ্ধ কিছুক্ষণ। তারপর সম্ভাবনা, লেখা...
ঘর না ঘরানা — ঢেউ, সুবিপুল, কী ভীষণ একা
একটি ভুলের পাশে পড়ে-থাকা বিরহিণী ফুল
রোহিণী নক্ষত্র যেন— অক্ষৌহিণী সেনা তাকে ঘিরে
মাঘের মেধাবী পটে ফুটে ওঠে শীর্ণকায়া তুলি
আহত সখার প্রতি করুণায় প্রিয় কর্ণফুলি
বিবেক-চেতনা দিয়ে উতরোল — তার দুই তীরে
উপবিষ্ট কবিদ্বয় — ভূতাবেশে রূপারূপ-হারা
অতৃপ্তি, জগৎসিদ্ধি — নীরবে বইছে স্রোতধারা...
শংসাপত্র
সাবলীল শংসাপত্র। সাক্ষরিত৷ প্রীতভাব মুখে।
সম্মুখে পল্লিজীবন — লতাবল্লি, সরলতা ঢের...
দয়ালু সাগর, বিদ্যা — প্রস্ফুটিত পুষ্প আমাদের
সুবাসে ভরিয়ে তুলি — দখিনা হাওয়ার দিকে ঝুঁকে৷
লিখন শৈলির জাদু— চন্দ্রমুখে : অতি বিস্তারিত...
কার্পাসের পাশে কার শুদ্ধমতি, দিগ্বিদিক ওড়ে ?
অস্থির মেঘের দল ভেসে গিয়ে বাতাসের তোড়ে
কোথায় ঝরাবে জল— কোন্ দেশে হবে অনূদিত
উদিত সূর্যের হাসি জানে ভাল, আর পূর্বাকাশ
সাক্ষরিত শংসাপত্র : না-আমি, সে-অপর ভুবন
ধ্রুবতার পক্ষে চির— নিশিদিন এক করে মন
অবরেসবরে দিঘি— নদীতীরে আন্দোলিত কাশ
অবকাশে কথামালা— মালঞ্চ, অনুরাগ, প্রীতি
সাক্ষরিত শংসাপত্রে ঝলমল করে ওঠে স্মৃতি৷
অনুবাদ
( উৎসর্গ : আশিস মাইতি )
অনুবাদে নিমগ্নতা— দেখেছি তোমার ধ্যানী মুখ৷
শ্রাবণ-গহন, দেয়া— জন্মদিনে, অবিরল ধারা
মাটিকে সতেজ করে মোহনীয়া৷ ভুলেছি অসুখ৷
শুধু কি আশিস ? হাসি, মনে-মনে প্রস্ফুটিত তারা...
নিজেকে সাজাই, আর ভিজে যাই প্রিয় অশ্রুপাতে,
শব্দের শরীরে এত জাদু থাকে — কে জানে জীবন !
ভোরের সমীপে এসে, আনমনা, পাখিদের সাথে
কিছু যে আলাপ হয়— বোঝে সেই শিহরিত বন।
জন্মদিন, প্রিয় ঋণ— স্নাত সে সজল অনুবাদে,
শুভদীপ, ফুলমালা— ভেসে আসে চন্দনের ঘ্রাণ...
সৃজন, সুজনে আমি একাকার— অমলিন চাঁদে
কে রেখেছে রূপময় এত-এত জোছনার গান !
বোঝে না শ্রাবণ-মন— ঘনঘোর, এই এক ব্রত;
মাটিকে ভেজাবে বলে, অবিরল, অনুবাদে রত।