নিমাই করণ-এর এক গুচ্ছ কবিতা
সনাতনী গান
ত্যাগ আর তিতীক্ষার পায়ে কোনো কি ঘুঙুর লেগে থাকে না
জীবনের যত ব্যঞ্জনা, যাপনের যত ত্রুটি–
সেগুলিই কি বৃহৎ হয়ে আঁকা থাকে মধ্যবিত্ত শিরার ভিতর!
নতুবা এই পড়ন্ত বেলায়–
কেন দিগন্তরেখার নীচে দেখে যেতে হবে রক্তসূর্য।
ভেবে দেখো আমিও তো একদিন সেনানী ছিলাম
বিজয়মালা আমিও তো পরেছি একবার,
জনতার জয়ধ্বনি শুনেছি উচ্চারিত
অথবা একবুক আশা নিয়ে একদিন মাটিকে করেছি মানুষ
দীর্ঘতর ছায়া দেখে যাব বলে–
এক দোদুল্যমান পৃথিবীর স্বপ্নচারী হতে হতে–
কত রাত গভীর করেছি।
তাই এই জীবন সন্ধ্যায়–সমাপ্তি সংগীত গাওয়ার আগে–
আমি আর একটি আগমনী অথবা স্বাগত ভাষণ শুনে যেতে চাই।
নিজের জন্য নয়, শেষ নির্বাণের রাস্তায়–
একটি কল্পলোক বেঁচে থাক,
বেঁচে থাক–আরো এক সনাতনী গান।
এলিজি
একটি আমার জীবন ছিল ভাবের জীবন
বাস্তবে সে মিলতে গিয়ে ফুল ফোটেনি
ভাবনা ও ভাব এক না হলে হারাতে হয়
পোড়াকাঠে চিহ্নগুলি রেখে গেলাম।
এখন আমি বসে আছি তোমার মতো
আমার চিতা পুড়ে যাচ্ছে নদীর ধারে
মাটির সঙ্গে মানুষ হবো ভেবেছিলাম
এখন দেখি মানুষ পুড়ে মাটিও পুড়ে।
ব্যতিক্রমী সময়
লুকিয়ে লুকিয়ে যে মানুষটি কাঁদে
আমি তাকে বলি সাধনায় আছো,
আজ নয় কাল–
তোমার বাগানে পাখি গান গেয়ে যাবে,
মানুষটি সা-রে-গা-মা সাধতে সাধতে–
রাত দিন কাটিয়ে দেয়;
ছেলের জন্য মেয়ের জন্য করেও নিজেকে সাজায়।
লোকটি ঠিক লোকের মতোই
চা খায়, চশমা পরে,
ঘড়ি দেখে অফিসমুখী হয়,
তার ব্যতিক্রমী সময় তাকে বাঁচিয়ে রাখবে!
ঘণ্টা-মিনিট-সেকেণ্ডের পর–
আরও একটা সময় থাকে–
যেখানে মানুষ ঠিক মানুষ থেকে যায়।
বিসর্গ জীবন
সময় সুতোয় নেমে আসে অন্ধকার,
বাস্তব ঘেঁটে, বুঝে গেছি এই–
সুঁচের ছিদ্রের কাছে মানুষ বড় নত হয়।
মেঘ মেঘ খেলা, ঢেউ ঢেউ ভাঙা,
অবিশ্বাসী জেনে গেছে আর্থিক হৃদয়!
মরে বেঁচে পাঁজর হয়েছি।
এই বোধভূমির কাছে তুমি আসবে না জানি।
নিকট স্থাপত্যগুলি চুরচুর, ভেঙে যায় সৌকর্য্য প্রণালী।
হে নিবিড় পাঠমালা! বুঝে গেছি নিকট নিষ্ঠুরতা,
এবার স্বাগত কথন শেষে,
যোগ বিয়োগ কষে কষে
এখানেই রেখে যাব–বিসর্গ জীবন।
ছবি
ভজা বাগদির ঘরের দেওয়াল
শিল্পীর তুলি দিয়ে আঁকা,
পূর্বে পদ্ম ফুল, দক্ষিণে হাত,
উত্তরে কাস্তে হাতুড়ি তারা।
পৌষ সংক্রান্তি,
লক্ষ্মীর পদচিহ্ন কিন্তু আঁকা হল না,
আমি বললাম, শিল্পী– সৃষ্টি করো,
শিল্পী বলল জীবনের ছবি
আমি বললাম কি–?
শিল্পী বলল–
ভজার বৌটাকে পশ্চিম দেওয়ালে এঁকে দেবো–
যে ঘোমটার অভাবে পদচিহ্ন আঁকতে পারেনি।
আমি শাজাহান নই
তুমি মমতাজের থেকেও সুন্দর
তবুও তাজমহল গড়ার স্বপ্ন দেখিনা আমি
কারণ আমি শাজাহান নই।
আমি বাংলার মেঠো কবি
তোমার সবুজ প্রেমকে ভালোবাসি
ধানের মাউসি পালায় ঘন শিহরণ
পৌষের পালংশাকে প্রেম হয়ে বেঁচে আছ
চতুর্দশীর চাঁদ হয়ে জেগে আছো আমার কুঁড়ে ঘরে।
মমতাজ নেই,
তাজমহলের থেকে তুমি সুন্দর।
শতাব্দীর শেষে তুমি-আমি থাকব না
সপ্তর্ষিমণ্ডলে আমাদের নিমন্ত্রণ।
মাটির প্রেম হাজার ছবি আঁকবে...
বৃদ্ধ কৃষাণ এক লাঙল মই কাঁধে–
কবিতা রেখে যাবে,
লক্ষ্মীর আলপনায় পিঠের উৎসব হবে কৃষাণীর
রোজার আনন্দে ঈদের চাঁদ উঠবে।
আমি থাকব না,
থাকবে আমার মনের তাজমহল।
তুমি মমতাজের থেকেও সুন্দর
তবুও তাজমহল গড়ার স্বপ্ন দেখিনা আমি।
মাটির হৃদয় আছে
মানুষের নয়, মাটিরও হৃদয় আছে
বুকের মধ্যে সবুজ অনুভূতি
মানুষের স্নেহ নিয়ে পালং এর পাখা নাড়ায়,
অঙ্কুরকে বলে–আহা!
মূলকে বলে–এসো,
ধুলোর আঁচল দিয়ে বীজের ঘাম মোছায়।
মানুষের নয়, মাটিরও সংসার আছে
স্বামী তার মাঠের কৃষক
ঘামের বাসর ঘরে শ্রমের আলপনা,
প্রেম আসে মননে–
লাঙলে গামছায়,
দুজনের ভালোবাসায় জন্ম নেয় ফসলের সন্তান।
সমাধি হওয়ার আগে
এই সবুজ মাঠ ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না,
কোথাও যাবো না,
এখানে নিঃশ্বাস রেখে যাবো ঘামের।
সমাধি হওয়ার আগে–
বুনে দিয়ে যাবো বোরোধান।
তারপর ঐতিহাসিক যুগে ফিরে গিয়ে–
অনন্তকালীন কৃষকের কাছে প্রশ্ন রেখে যাবো–
কী পেয়েছ মাটির শিকড়ে?
যার প্রবর্তনায় বহমান পায়ের ছাপ–
রেখে গেছ মাঠে,
মানুষের সার্বিক সুরে তুমি তো–
তোমার দাবী জানাওনি,
কেবল ভালোবাসার যন্ত্রণাকে বুকে নিয়ে–
কৃষাণীর মুখ দেখেছো,
আমি জানি–
এ তোমার উত্তরণ নয়,
তুমি মরণের ফুল হয়ে–
সাক্ষ্য রেখে গেছ যুগে এবং
যুগান্তরের মাটিতে।
কে তুমি
কে তুমি অন্ধকারে আলো দাও
বুকের জমিতে গাঁথো অক্ষরের বীজ
শব্দেরা ফুল হয়
ফসলের নতুন বিন্যাস
কিরণ পড়ে ভাষাতে ভাবনায়।
কে তুমি নদীর মতো নদী
মানুষের মাঝি হয়ে বয়ে বয়ে যাও
হাল আছে পাল আছে
মাস্তুলও আছে
জ্ঞানের বৈঠায় চৈতন্যের নোঙর ভাসাও।
কে তুমি সমগ্র ক্যানভাস
সৃজনের সূত্র ছুঁয়ে থাকো
মন মেঘে মোনালিসা
জীবন তুলিতে তোলো বর্ণময় দোল
কে তুমি? কে তুমি? কে তুমি?
খেজুর হাঁড়ির কাক!
সরস্বতী নদীর তীরে আমার কল্পনা মানুষীর ঘর
তিনি রোজ আমাকে পীড়ন করেন, খাতির করেন,
চিঁড়ে পিঁড়ি দিয়ে বলেন– ভালো আছেন তো?
আমি তো খেজুর হাঁড়ির কাক!
সভ্যতার রস খাচ্ছি,
ভিয়ান দিচ্ছি,
ফন্দিবাজ।