সুবর্ণ আদিত্য-এর এক গুচ্ছ কবিতা
অস্তিত্ব
যেকোনও দুর্দশায় আমাকে স্মরণ কোরো—আমি ঈশ্বর নই যে সাড়া দেবো না
ফুলেদের আয়ু থাকে না
সমস্ত দুপুর খুলে তোমার কোলের বারান্দায় শুয়ে থাকি। মৃত্যুর গরিমায় টালমাটাল ঘ্রাণ ময়দানে ছায়া টেনে তারস্বরে চেঁচায় অবনত বৃক্ষ। ফলের শ্বাস ও ফুলের পতনে হুক খুলে দারস্থ হয় মধ্যরাতের বিস্তারিত গল্প।
লাল লাল কোয়া নিয়ে নরম ডালে ডালিম প্রার্থনা করে শীত। যেভাবে জেগে থাকে নাগলিঙ্গম, প্রতি ভোরে। আমাকে ভালোবেসে নাকফুল পরা মেয়েটা দিন দিন যোগ্য হয়ে ওঠে, ধ্যানে। মগজের মনন থাকে, ফুলেদের আফসোস থাকে; আয়ু থাকে না।
ফারদুন—তোমাকে গোলাপ নামে ডাকা হয়ে উঠবে না?
গন্ধ চুরি ও হাওয়া নিরঙ্গম
ঘুমের ভেতরেও ঘুমিয়ে গেছিলাম...দেখি, একটা স্বচ্ছ সাদা কাঁচ ঘেরা ঘর। চারপাশে সৈন্য-সামন্ত। বেয়াড়া শতশত ফাইল এনে রাখছে আমার সামনে। কে আমি? সামনের বিশাল মার্বেল পাথরের টেবিলে নেমপ্লেটে আমার নাম। মাথার উপরে ফটো বাধাই করা। বিভিন্ন ট্যাগ বলছে আমি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
অন্তত কুড়ি বছর এগিয়ে এসেছি জীবন থেকে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও একজন কৃষক হিসাবে সফল ছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই কাজ শুরু করে দিলাম। ভাল বীজ বাছাই করে, জমি প্রস্তুত করে—ফসল বুনতে থাকলাম। সব চারারই সমান যত্ন-আদর ও পরিচর্যার পাশাপাশি উপড়ে ফেললাম আগাছা।
সারাদেশ আমাকে দেখে হেসে উঠলো—আমি ফসলের হাসি দেখে কেঁদে ফেল্লাম।
বিপন্ন মকর
এইপথে জুঁইফুলে ঝরে যাওয়া আনত শিৎকারে পেখম তুলে ধরা যৌনময়ূরবনে পড়ে থাকে ধ্যান। ধরা ও ধরণীর রঙে লেখা আকরিক কিংবা সদ্য যুদ্ধফেরত যুবক—কেউই সমুদ্রের বাগানে গান গায় না। কেবল সন্ধ্যা হলেই যে যার স্কন্ধে চাপড়ে দিচ্ছে সমূহ তামাশা।
অতশত ভাবনার পরে শুধু গন্তব্যের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে ম্রিয়মাণ ভাঁটফুল, উদ্যত আগুন পার্বন আর প্রসাদের
গ্রীবায়, নাভিমুখে থেকে গেল হেঁটে আসা
তীঁর ও ফলক।
মুখস্থ করা রায়, সেলাইমেশিন আর টাইপরাইটার নিত্যকার কাজকর্ম চালিয়ে যেতে যেতে একদিন ভেবে রাখে বমি।
কখনও কোনোদিন ঠিক উগ্রে দিবে রাষ্ট্রের
মুখ ও চোখ বরাবর।
ঢেউ তুলে দাও
ঢলে পড়তে গিয়েও আচমকা বিঁধে যাই—
নৌকা, কিসের লোভে বান মারো?
অথচ, যে হাওড় তোমার পায়ে লুটায়
ঋতুস্রাব নিয়ে
যেন পায়ের আলতার ঈর্ষায় ঘাঁই তুলছে
বর্ষার পুঁটি মাছ
ছলকে যাচ্ছে পুনর্বাসনে যাওয়া পূর্নিমার রাত
কথিত মশহুর, পবিত্র তুর্কির কাছে এসেও দূরত্ব হাসে
আরো শীতলক্ষ্যা কিংবা টেমস নদী
কাঁদো কাঁদো হয়
তোমার আলোভর্তি নাভির কাছে
কেমন বান মারো তুমি—!
পুনর্বার নিয়ে যাও সফেদা ফুলের বোটায়
আর খুব ইতস্ততবিক্ষিপ্ত ক্ষুরধ্বনির মতো খামচে নাও শব্দের গতি ও উৎসমূল
এক তাতার—পাতার ফাঁকে সুকৌশলে যুদ্ধাপরাধী হ'য়ে আছে
ছায়া নেমে এলে
মাথা থেকে নামিয়ে দিতে পারে মাথা
যাদের মগজ আছে—
তাদের টলানো যায় না কোনো পাড়ে
নৌকা, বান মারো, আরো ঢেউ তুলে দাও সমুদ্রে
রাষ্ট্র
আগুনমুখর সন্ধ্যাগুলিতে নদীসংগীত বেজে উঠলে আরও হাত বুলিয়ে রাখি মাউথওয়াগন। তেমন রাতেই যুদ্ধ ও যুদ্ধের প্রয়োজনে আমার কাছে সাপ নয় এমন একটা সাপ এলো।
নদীকে পাহাড়ের কথা আর পাহাড়কে সাগরের কথা বলে সেই সাপ এ্যানোকোন্ডা ভাব ধরেছিল যেহেতু অন্যান্য দিকে ঢাল তুলে এগিয়ে আসছিল রাষ্ট্র ও নৃপতি।
হে মাননীয় শুয়োরের বাচ্চা রাষ্ট্র
একজন মানুষ হিসেবে আমি যুদ্ধ থামাবো নাকি সাপ থামাবো?
নিজেই নিজেকে দেরি করিয়ে দিচ্ছি
ইদানিং একটা গীটার আমার অবসরের সঙ্গী। দশটা আঙুল তার কাছে জমা রাখলেই নানান সুর মিলিয়ে কথা বলে। কখনও ভালোবাসা-প্রেম-বিদ্রোহ আবার কখনও গ্রীবায় ঝুলে থাকে করুণ মমতা। তখন তার কেঁপে কেঁপে উঠা কম্পনে তোলপাড়। এতসবকিছু রেখে সন্ধ্যা হয়ে এলে ব্যাগে ভরে গীটারটাকে টানতে টানতে গিয়ে থামি ছাদে। মেঘের কাছাকাছি গেলে তৃষ্ণা পায়। গীটারের ব্যাগ থেকে মদের বোতল বের করে পান করি- সে খুশি হতে পারে না। আবোলতাবোল বলে।
এরপর তার শরীর থেকে কেচি, মারিজুয়ানা, সিগ্রেট আর লাইটার বের করে নেই। তাকে সুর ধরতে বলি, সে মুখ বন্ধ করে রাখে।
গীর্জার ঘন্টা বেজে যায়...একেকটা ঘন্টা বাজে আর ভিন্ন-ভিন্ন ছবি ভেসে ওঠে, নারীর, প্রেমিকার আর নদীর।
কেবল তোমাকে মনে করতে গেলেই গলাভর্তি বিষ পান করতে হয়। গীটার তখন কাঁদে—তার কান্না থামাতে আবার ব্যাগের বুক পকেটে হাত রাখি
স্মরণ করিয়ে দেই ক্যাশমেমো দেখিয়ে, পরিস্কার বাঙলা বর্ণমালায় লেখা ফ্রী গীটার সার্ভিসিং এর মেয়াদ, ক্রয়ের দিন-তারিখ এমনকি মূল্যটাও। তাকে থামিয়ে দিতে গিয়ে দেখি—
নিজেই নিজেকে দেরি করিয়ে দিচ্ছি।
স্বর্গ থেকে আসে প্রেম
আজকাল এমনই স্বপ্ন দেখি—একসাথে চারজনের কম প্রেমিকা থাকলেই অস্বস্তি হয়। ঘুমোতে গেলে অন্তত দুটো কোলবালিশ আর বিয়ে করলে এগারোর সাথে গোটা চারেক শূন্য। এই স্বপ্ন দেখতে গিয়ে এক দূর্ঘটনায় আমি মারা গেলাম। মরে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো পানি আর তেল নিয়ে। পৃথিবীর টাইম এক্সপায়ার হয়ে যাওয়ায় ধংশ হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে আল্লাহ কেয়ামতের ঘোষণা দিলেন। বিচারের আগে ভাষানচরের মত অপরাধী শিবিরে থাকলাম। একরাতে মদ খেয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম। এরমধ্যেই বিচার হয়ে গেছে। আমার সাথে বাহাত্তর হুরের সাক্ষাৎ হলে বুঝলাম আমি স্বর্গে। একেকরাতে আমার সাথে মদ খেতে আসে একেক হুর। তার সাথে গল্প করি। জানতে পারলাম স্বর্গের ধারণা, হুর-পরীর ফর্মূলা ষষ্ঠ শতকে হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সতেরো নাম্বার হুরের সাথে প্রেম হয়ে গেল। আঠারো নাম্বার দিনে তো আর তাকে পাবো না- ভেবে আহত হলাম। সতেরোর প্রেমে জর্জরিত হয়ে প্রতিরাতে শোক পালন করতে করতে আমি জ্ঞান হারিয়ে জমে গেলে আমার হুরেরা ভাবলো আমি ধ্যানমগ্ন, তারা আমার ইবাদত করতে লাগলো। পাড়া প্রতিবেশীরাও আমার অনুসারী হয়ে গেল। এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটাতে ঈশ্বর আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি সতেরো নাম্বার হুরের দাবি জানালাম— অংকের জোতিষ স্যারের মত তিনি ধৈর্য্য ধরতে বললেন। আমি ট্যাব হাতে নিয়ে বললাম তাহলে বাইরে থেকে ঘুরে আসি! আমাকে জানানো হলো অন্যান্য গ্রহের সাথে পৃথিবীও ডিলিট করে দিয়েছে। সার্ভার সুবিধা মানুষের নেই। আইটি স্টেশনের যথাযথ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে সুনুমুনু করে পাসওয়ার্ড হ্যাক করলাম। তারপর পৃথিবী ইনস্টল করে ছয়শো থেকে সাতশো শতক ডিলিট দিলাম।
এরপর থেকেই মানুষ যাকে ভালোবাসে তার সাথেই থাকে।
সবজিমহল
রক্তাক্ত হয়ে যাই ফারদুন—যদিও তুমি একটা প্রমাণ সাইজের
টসটসে লাল টিপ আর পরীক্ষাগারে বর্ষাই গোলাপ নাম নিয়ে দুলছো
তোমার ভেতর চলতে চলতে বন-থমকে যাওয়া ঝাঁকঝাঁক অসমতল পাখিবন্দী জীবন
দেশ কাঁধে করে আসা বেদনা-প্রসব
এইরূপ কুয়াশাসমগ্র শীত আর শুষ্ক হয়ে আসে প্রাত্যহিক ঋতু
আরো কিছু খরার আসন্ন সংবাদে আঙুলের ছাপ নিয়ে
প্রতিবার তোমাকে লুকিয়ে ফেলি; হারিয়ে ফেলার ভয় জন্ম নিতে নিতেই তোমাকে চাষ করি
ফারদুন—কতবার বৃষ্টি এলো তারপর নানাবিধ ফুল-ফল
ঔষধি চারা, পাহাড়িয়া ঢল আর রোদের করাতকল ঘাড়ে চেপে টইটই করে
হেঁটে গেল অনাগত বিধাতা, আরো অনেক অরণ্য—
বেডরুমে চিৎকার করছে থকথক ঘ্রাণ
কম্পণ, বুক হাতড়ে আসে উলঙ্গ ছাউনি
ঐ যে যাপন! বসবাস করে যাবো জীবন
মেঘ, মৌমাছি আর অন্যান্য সন্ধ্যায় দূরাগত প্রেমিক আনো—খাড়া নহর। ফলক আর বীজঃ মই দিয়ে যাই, থোকা থোকা কাঁটায় জন্ম নেয় রক্তালু আত্মজ
সেই নিরঙ্গম শ্বাস, প্রাসঙ্গিক গরিমা আর তুলতুলে সমুদ্রে রোপন করি সুচারু পতন
ফারদুন—আমি নিরেট চাষা বলেই তুমিও চমৎকার বীজসুপ্ত সবজিমহল
শূন্য
সেই জাগরিত সত্তার ঊর্ধ্বে এবং
সকল মানুষ সেই জাগরিত আচার
এমনকি রিপু যেখানে তার ইচ্ছে
প্রকৃত মৃত্যুর উপত্যকায় ঢলে পড়েছে
মূলত চাষ নিই আয়তকার ভ্রুনের
পশুজাত শ্রেণির কাছ থেকে
বাছাই শেষ করে এবং মগজে
স্থান পেলেই তিনি সন্তুষ্ট
এমন এক দালিলিক অন্ধকারে
অন্ধত্ব বিস্তার নিলে তার
এবং তাদের মনেও প্রশ্নের
সঞ্চালন চক্র স্থিতিশীল
সেই প্রলম্বিত আকাশ
যার সীমা পেরিয়ে এসে
সমস্ত এবাদত আমার কাছে লুটায়
আর আমি ধ্যান ও জ্ঞানে
দ্রুততার সাথেই মানুষকে
মানুষ বলতে পারি
পারি না
ভালোবাসার অধিক
তিয়ামাতের শরীর
আরো নানাবিধ শোক
শ্রাদ্ধ হলেই কেবল নিজের কাছে
সব শূন্য হয়ে ওঠে