গৌরাঙ্গ শ্রীবাল এর এক গুচ্ছ কবিতা
মিছিল
মিছিলে কতটা রাস্তা হেঁটেছি তা আমার শ্লোগান জানে,
মুখের ভাষার মাঝে পুঁতেছি পতাকা
কথাকে থামিয়ে রেখে ইঁদুর ধরেছি মিছিলের ফাঁকে,
কালের বিড়াল রাস্তা কেটে পার হয়ে গেছে যোনিপথ।
যে পথে গিয়েছে এক কুকুর হাড়ের টুকরো মুখে
এদিকে-ওদিকে খোঁচাখুঁচিতে ছিঁড়েছে সতীচ্ছদ
ঘটে গেছে রক্তপাত, মৃত্যুর মতো চেতনাহীন—
চীৎকার করেছি শুধু 'দোষীদের শাস্তি চাই'।
দোষী কে? শাস্তি কোথায়? ওরে ভাই
শাস্তি কোথায় পাবি? বরং আয়
ফাঁসির দড়ি খুটায় বেঁধে কাছি টানাটানি খেলি।
আমাদের বুড়ো গাধাগুলি হাসে
আমাদের ছাগলেরা জল ঘোলা করে খায়,
ভাঙা গোয়ালে মুখ লুকিয়ে গরুগুলি
জাবর কাটতে কাটতে নিজেদের সতীচ্ছদ সেলাই করে,
এসবের গুরুত্ব না দিয়ে
মিছিল এগিয়ে যায়।
বাঁশি
আমার মাথার মধ্যে
যখন-তখন এক বাঁশি বাজে,
সে বাঁশিকে কৃষ্ণবংশী মনে ভেবে
আয়ান ঘোষের বউ কেবলই রান্নায় করে ভুল
চুলা নিভে যায়, ভাত পুড়ে যায়
তেতোর বদলে টক, টকের বদলে শুক্তো
ঝোল ও ঝাল সব গুলিয়ে যায়
খাবার সময় যত গণ্ডগোল।
আমার মাথায় বাঁশি বাজে
রাধার মাথার তার কেটে যায়
জুটিলা-কুটিলা তাকে গার্হস্থ-হিংসার আওতায়
নিয়ে আসে, যার জন্য ঘোষজায়ার এ
মনের অবস্থা সেই কালাচাঁদ তখন গাছের
আড়ালে লুকিয়ে মেয়েদের স্নান করা দেখ।
মথুরার হাটে যেতে যেতে
ঘোষেদের বউ দুধঘোল মাখে গায়
অথচ বাঁশিটি বাজে আমার মাথায়।
দেয়ালের এপাশ-ওপাশ
পাশের কোঠায় কারা যেন থাকে?
মাঝে তিন ইঞ্চির দেয়াল
দু-পাশের প্লাস্টার সমেত পাঁচ ইঞ্চি।
পাশের কোঠায় যারা থাকে
তাদের সহবাসের সময়কালীন শীৎকার ধ্বনি,
কথাগুলি স্পষ্ট না হলেও এ-পাশের কক্ষে আসে
এ-কোঠায় যারা থাকে তাদের অর্ধেক ঘুম ভাঙে
হাঁপানির ঝুঁকা কাশি দেয়াল ভেদ করে ও-পাশে যায়,
যে-পাশে অনেক গল্প মুখে মুখে লেখা হয়।
ও-পাশে কি কেউ জেগে আছে?
থাকে তো থাক না।
আস্তে একটু আস্তে।
কেন যে মরে না?
সাত পুরুষের বংশে বাতি দেবে
যে, তার মুখ দেখার জন্য।
নীলকণ্ঠ
শিব ও সক্রেটিস একই গোত্রের দুজন লোক
দুজনের আবেভাবে দার্শনিকতার ছোঁয়া।
দুজনের পায়ে জুতো নেই,
গায়ে জামা নেই, পরনের
যেটুকু পোশাক এলোমেলো, ময়লা।
ঘর আছে, স্থায়ী বাসস্থান নেই
যেখানে-সেখানে কিছু ছেলেপুলে জড়ো করে
দার্শনিক জ্ঞান দেয়, তরুণের মনে
নতুন নতুন চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটায়,
স্বপ্নের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
অভাবের সংসার অচল, ছেলেপুলে কাঁদে
স্ত্রী-রা প্রতিদিন মাথা মেজাজ গরম করে স্বামীর উপর
শিব আর সক্রেটিস দুজনেই নির্বাক ও
নিঃস্পৃহ স্থবির, যেন তারা এই
সংসার কিংবা এ পৃথিবীর কেউ নয়,
এসবই গভীর মায়া।
দুজনেই পৃথিবীর জন্য
সাপের গরল, হেমলকের তরল নিয়ে
নাড়াচাড়া করতে করতে কণ্ঠে ঢেলে নেয় মৃত্যু।
পৃথিবীর যোনি
পৃথিবীর যোনি দিয়ে ঢুকে গেল পুরুষ মৌমাছি
স্ত্রী-মৌমাছি সঙ্গীদের নিয়ে পৃথিবীর
স্তনে স্তনে খুঁজে ফেরে একফোঁটা মধু।
মধু বড়ো তিক্ত আর মধু বড়ো মিষ্টি
কোন মধু গাঢ় বেশি জানে না এ-সময়ের দিন।
মানুষ জানে কি, জানে বলে তাই
মানুষ নিজের দোষে নিজেই পাগল
পৃথিবীর যোনি দিয়ে জন্ম নিল আর এক পাগল, যদিও
তার ডানা নেই, পাখা নেই
তবুও সে উড়ে উড়ে ঘুরে ফিরে
প্রেমাম্র মুকুলে, ঝরে পড়ে নষ্ট বীজগুলি।
সাত সমুদ্র তেরো নদীর কূলে
ব্যর্থ প্রেমের ফুলে ভরাট হয়ে গেছে কৃষিজমি
জলাশয় ও খেলার মাঠ,
আমাদের বিরহের কথা দিয়ে ঘুণপোকা
কুরুর কুরুর করে কেটে যায় খাট
শ্মশানে যাবার জন্য আজও বেঁচে আছে বাঁশ।
কুসুমের বার্তা
গভীর শীতের রাতে সুতীব্র ঠাণ্ডার হাত থেকে
কিছুটা রেহাই পেতে শুয়ে আছি
ইলেকট্রিক চুল্লির জ্বলন্ত বিছানায়, এত সুন্দর গরম
এখানে শরীর পুড়ে যায়
মনকে স্পর্শ করে না, তাই
বেরোতে ইচ্ছা করে না।
হয়তো বেরোব না আর
শীত চলে গেলে একবার খোঁজ নিয়ো
বসন্ত এসেছে কি না
কুসুমের বার্তা যদি শুনে থাকো
চিতাভস্ম দু-হাতে উড়িয়ে দিয়ো চৈত্রের বাতাসে।
হলুদ হলুদ ফুল হয়ে ঝুলছি দেখো
অমলতাসের বৃন্ত থেকে।
পাতা
মাঘের পুরোনো পাতাটিকে দেখি:
পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করার সময় তার
এখনো আসেনি, তাই ঝুলে আছে আজ এই
বসন্ত শাখার কোণে, হয়তো হৃদয়ে জমে
আছে আরও অনেক অনেক কথা,
যে কথা সে বলে যাবে— বলে যেতে চায়।
কিন্তু কেউ শোনে না সে-কথা
তাকে এড়িয়ে ফোটে নতুন পাতা,
দখিনা বাতাস আসে, ছুঁয়ে চলে যায়
কোকিল পাখিটা পাশে বসেই ডাকে অথচ
তাকায় না তার দিকে।
ব্যাথিত পাতাটি চুপ করে থাকে,
একদিন ফাল্গুনের ঝড় কচি কচি পাতাগুলি
ছিঁড়ে ফেলে, ঝরে পড়ে
পুরোনো পাতাটি কাঁদে, অশ্রু: ফোঁটা ফোঁটা জল
পিঁপড়ে আসে কান্নার দাগ মুছে দিয়ে
পাতায় পাতায় পাড়ে ডিম।
ফাঁপা শব্দ
শরীরের যন্ত্রাদি সহজে অতি সহজে বোঝার জন্য বাংলা
ভাষায় রচিত দেহতত্ত্বের বই পাঠ করিয়া আসিয়াছি।
পরীক্ষা করার জন্য ঘুমন্ত তোমার বুকে কান পাতি, কিংবা
পাঁজরের অস্থিমধ্যে বাম-হাতের এক আঙুল বসাইয়া
ডান-হাতের আঙুল দিয়া আঘাত করি, অথবা আলতো করে
বুকের উপরে শুধু হাতের চেটোটি চেপে রেখে খুঁজে দেখি
কোথাও আমার জন্য তোমার বুকের মধ্যে কোনো জায়গা আছে
কি-না? বেশ কিছুক্ষণ ধরিয়া সন্ধান শেষে অনুভব করি:
শুধু 'ফাঁপা শব্দ', শুধু ফাঁপা শব্দ ছাড়া আর কিছু নাই, যেন
ডাকিতেছে এক পায়রার ছানা, শূন্যতা কেবল বাজিতেছে
তোমার কোমল বুকে। শ্যামল মুখের দিকে তাকাইয়া থাকি,
এভাবে ক্ষানিকক্ষণ তাকাইবার পর কী হইল জানি না,
সহসা আমার বুক ঠেলিয়া উঠিয়া আসিতেছে কান্না, আমি
হাহাকার করিতেছি, বলিতেছি 'কসুম তোমার মন নাই'।
বাসন্তী রঙের অশ্রু
ছোটো এক নৌকায় কিশোরী দুর্গা
পদ্মবনে ঘুরে ঘুরে ফুল তোলে,
শিশিরে ও জলে ভিজে গেছে তার রং,
হলুদ সবুজ এই রঙের খেলায় মনে হয় যেন
ওইখানে আছে কোনো ঈশ্বরের দেশ,
সব স্বপ্ন, সব সুখ ওখানেই।
নদীর গানের শব্দ ভেসে যায়
দূরে বহুদূরে, বয়ে যায় নারীদের বুকে করে
বয়ে আনা জল আর একান্ত প্রার্থনা,
ভিজে যায় গোলাকার শিলাখণ্ড
ঝরা ফুল বেলপাতা আকন্দের মালা।
কিশোরী দুর্গা পদ্মের পাতা ভরে
বাসন্তী রঙের অশ্রু নিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকে একেলা।
স্বর্গীয় গন্ধ
তার পা থেকে মাথা পযর্ন্ত স্বর্গীয় গন্ধ, বা
শরীরের বাঁকে বাঁকে স্বর্গের অজস্র সিঁড়ি,
প্রতিদিন উঠি-নামি
কিছুটা উঠে গিয়ে বুকের চাপ অনুভব করি
নেমে আসি, নেমে এলে
অসম্পূর্ণ কাজ শেষ হল না দেখে আবার উঠি,
গতকাল যে-যে ধাপ দিয়ে ওঠা শুরু
করেছিলাম সেখানে আজ আর নয়,
অন্য দিক থেকে উঠি
তার উলটো দিক দিয়ে নামি।
উঠতে-নামতে সিঁড়ির সমস্ত
অবস্থান বদলে যেতে থাকে,
অবস্থান যতই বদল হয় তার
গায়ের স্বর্গীয় গন্ধ তত ঘন হয়,
আকাশ শরীর বলে কিছুই থাকে না।