একটি লাশ ও দু বোতল কান্ট্রি ।। গৌরাঙ্গ শ্রীবাল


একটি লাশ ও দু বোতল কান্ট্রি
গৌরাঙ্গ শ্রীবাল

মৃত লোকগুলোর সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার নিজেকে পৃথিবীর একমাত্র জীব বলে মনে হয়। আবার জীবিত লোকগুলোর সঙ্গে যখন থাকি নিজেকে মনে করি আমিই পৃথিবীর একমাত্র মৃত লোক। মৃতদের নাড়াচাড়া করতে করতে আমি তাদের লোক হয়ে গেছি। তাদের ছেড়ে যেতে ইছা করে না। বড়িতে টাকা পাঠিয়ে দিই। চাকরিও অনেকদিন হল। একদিন মা বলল,-‘অনি, এবার সংসার কর’।

আমি ‘ভাবছি’ বলে কাটিয়ে দিয়ে চলে এলাম মর্গে। যে যেখানে কাজ করে সেখানকার পরিবেশটাকে নিজের ঘরসংসারের মতো মানিয়ে নিতে হয়। সত্যিই আমি হাসপাতালের মর্গটাকে সংসার মনে করি। প্রতিদিন মৃতদেহ নিয়ে কারবার। তাদের হিসাব রাখি, মর্গের খাতায় লিখে রাখি নামধাম, অনেকটা ঠিক চিত্রগুপ্তের মতো। কাটাছেঁড়াও করতে হয়। খুব বিস্ময় লাগে। যে শরীর এক চড়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে তাকে চিরে ফালা ফালা করে হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, ঘিলু প্রভৃতি বের করে নেওয়া হয়, একটু আহাও নেই, উহুও নেই। প্রথম প্রথম খারাপ লাগত, এখন কিছু মনে হয় না, কারণ চাকরি।

অন্যান্য দিনের মতো এদিনও একটি মৃতদেহ এল। পুলিশে এনেছে। নামধাম কিছু জানা যায়নি। তবে মৃতদেহটি একটি মেয়ের, বিবাহিতা কি অবিবাহিতা জানি না। সারাদিন কেটে
গেল, দেহটির খোঁজ নিতে কেউ এল না। আজ আর পোস্ট মর্টেম হবে না। টেবিল থেকে বডিটাকে তুলে স্টোররুমে ভালো করে ঢুকিয়ে রাখতে হবে। মড়ার আবার যত্ন।

আমি মেয়েটির পায়ে ধরে টেনে নিয়ে যাব বলে একটা হ্যাঁচকা টান দিলাম। টান দিতে বডিটার মুখের উপর থেকে থানটা সরে গেল। দুসন্ধ্যার কিম্ভূত আলোয় ভেসে উঠল মেয়েটার মুখ। আমি চমকে উঠলাম। আমার হাত পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল। মনে হল মেয়েটা আমার চেনা।

কতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকলাম জনি না। পিছনের বট গাছে পেঁচাজাতীয় একটা রাতের পাখি ডেকে উঠল। আমার ঘোর কাটল। বডিটাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে আমার ওয়েটিং রুমে ঢুকলাম। খাটিয়ার তল থেকে একটা কান্টির বোতল বের করে ঢক ঢক করে গিলে নিলাম। আবার
বডিটার পাশে এসে দাঁড়ালাম। আমার বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল কান্না। কিন্তু এখানে কান্না বারণ। আমি তার দেহটাকে কোলপাঁজায় করে তুলে নিলাম। আবার তাকালাম তার মুখের দিকে।

সারারাত না ঘুমিয়ে মেয়েটির দেহের পাশে জেগে রইলাম। দেখতে লাগলাম তার দিকে। কিন্তু কেন? সে আমার কে? তাকে কি ফুলশয্যার রাতে প্রথম দেখব এমন স্বপ্ন ছিল? এ চাকরি পাওয়ার পর থেকে কি আমাদের মধ্যে তৈরি হয় দূরত্ব? জানি না। তবে আবার দুজনে অনেক কাছাকাছি। একজন মৃত, একজন জীবিত। অথবা দুজনেই জীবিত, দুজনেই মৃত। আমার
অনেক কথা মনে হতে লাগল। আবার যা ভাবছি তা নাও হতে পারে, তবু নিঃশব্দের অদ্ভুত অন্ধকারে আমার সুপ্ত বাসনাগুলো জেগে উঠতে লাগল। নিষ্প্রাণ হলেও কী সুন্দর তার দেহ!

আমি মেয়েটির পাশে বসলাম। তারপর একপাশে শুলাম। হাত রাখলাম তার গায়। কাঁপছে আমার সারা শরীর। কিছুক্ষণ নিজেকে স্থির রেখে অর্ধনগ্ন দেহটিতে হাত বোলাতে লাগলাম। সে কোনো উত্তেজনায় সাড়া দিল না, লজ্জায় কুঁকড়ে উঠল না। তার ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া শরীরের স্পর্শে আমার রক্ত গরম হয়ে উঠল। কামনার উত্তেজনায় জেগে উঠল আমার স্নায়ুগুলি। মনে হতে লাগল সে যেন আমাকে ডাকছে। তার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে আমি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি, হয়ে যাচ্ছি উলঙ্গ। তার শরীরের কাছে আরো ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে দেখলাম অদ্ভুত নিস্তব্ধতার ঘোর আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমি নিজেও জানি না। একী কোনো ভূত! এইসময় হয়ত কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটতে পারে।

কিছুই ঘটল না। কীসের একটা ঢক ঢক শব্দে আমি চমকে উঠলাম। মেয়েটির দেহটিকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালাম। কিছুটা দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। ভোর হয়ে গেছে। আমি কী করব ভেবে পেলাম না, কাঁদতে কাঁদতে মর্গের স্টোররুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। আবার এক বোতল কান্ট্রি খেয়ে খাটের উপর লম্বা হয়ে চিত দিকে ধপাস
করে পড়ে গেলাম।

আর কোনোদিন বাড়ি ফিরে গেলাম না। লাশঘরে সংসার পাতলাম। লাশের সঙ্গে উঠিবসি, কথা বলি, সংগম করি লাশের সঙ্গে। লাশেরা গর্ভবতী হয়, জন্ম দেয়। তাদের দেহ থেকে
জন্ম হয় আরো আরও লাশ, যারা আমার ঔরসজাত। তাদের সঙ্গে আমিও লাশ হয়ে বেঁচে আছি। আমার সহকর্মীরা, ডাক্তার ও অন্যান্য লোকেরা আমার দিকে তাকাতে ভয় পায়, এমনকি লাশেরাও।

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...