অভিজিৎ দত্ত এর এক গুচ্ছ কবিতা
আমার কবিতা
তর্জনী, মধ্যমা, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ-- এই তিন প্রকার আঙুলের
সাহায্যে কলম ধরে লেখা শুরু করি।
মুঠোর ভেতরে কোনও প্রলোভন রাখি না
কনিষ্ঠা--- শিশুর দৈবচেতনা তাকে দূরে দূরে রাখি
অনামিকা--- বিবাহগোত্রীয়, আঠালো জিহ্বার প্রত্যাশা
কুহরে কোকিল-কাতরতা, যা নির্বিষ নয় ও নিষ্পণ্ণকামী।
আমি কলম ধরি ঋজু শক্ত হাতে, টপটপ ঘাম পড়ে
লেখার সময় মৃদু ধাক্কায় সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ি
চাই বা না চাই সন্ন্যাস প্রত্যাহত হয় গঠনের চিন্তায়
আহ্বান ক'রে ফেলি অনাহত নাদ ও নম্র বিবমিষা
অজান্তে আমার যৌব লিখিত হয় দেশকালের স্বপ্নে
আমার মধ্যবয়স লিখিত যথা বিরহী চাঁদের নকল
আমার আঙুলে নির্বাক পোড়া-শব্দ নেমে আসে
আমার এলিয়টী-প্রজ্ঞা লিখিত হয় চতুর নিঃশব্দে।
আমাকে অবগত থাকতে হয় সফল অন্ধতা বিষয়ে
জন্মানো ফুলের কুহরে রয় ফুলেদের ঈর্ষা ও পতঙ্গবিষ।
আমার কবিতা মঞ্চে শিশুর ট্রফিদৌড় হতে পারে না;
আমার কবিতা ফুটপাত দখলের মুখর দালাল নয়,
শবের চৈতন্যই আমার কবিতা, ফুটপাতে শুয়ে নক্ষত্র
দেখার আলস্যে ভাত ফোটার গন্ধে উৎকর্ণপ্রবণ ও বিপন্ন
উচ্চভূমি থেকে যাকে ঠিকমতো ঠাহর করা যায় না!
ঘাইহরিণীর বুকপকেট
পলাশমুখর সুদূর শান্তিনিকেতনে আমার প্রেমের নবীন সূর্য ওঠে।
আমার মাতৃভাষা বাংলা, ঘটেছে বর্ণপরিচয়, যে-ভাষায় লেখা হ'ল কথামৃত, গীতবিতান, অক্ষয় মালবেরি, বনলতা সেন, আরণ্যক, অরুণ-বরুণ-কিরণমালা ও দু-খণ্ডের সহজপাঠ।
আমার প্রেমের ভাষা বিশেষভাবে অনুচ্চারিত, যা সম্পূর্ণরূপে গোলাপ-নিয়ন্ত্রিত এবং যাতে করে একসঙ্গে সারা বিশ্বে অনেক যুবতীর কাছে মুহূর্তে পৌঁছে যেতে পারে সকল প্রার্থনা।
আমার ভ্রমণ বলতে বছরে প্লুটোয় দু'দিন জাঁকজমক কাটিয়ে আসা। আমরা নিজেরাই চক্ষুবাহন, আমাদের জন্য অন্য কোনো বাহন বা গুপ্তচর থাকবে না।
এ দেশের রাজনীতি প্লেগবাহিত, সেহেতু এলিয়েনরা সর্বাধিক মাত্রায় গ্রহণ করেছেন আমার রঙিন গুরুমুখী প্রস্তাবসমূহ,
নয়নজলে পা ধোয়াবেন তাঁরা প্রকৃত ধার্মিক, যথার্থ অসফল কবি, লিপিকার ও অন্যান্য রূপদক্ষদের।
এক একটি গ্রহ লিখে দেওয়া হবে সমস্ত ভিক্ষুকের নামে। বাদ্যযন্ত্রে আঙুল ছোঁয়ালেই বেজে উঠবে অমৃতগান।
নক্ষত্রের নামে সমস্ত প্রেমিকাদের নতুন নাম রাখা হবে। তাদের জন্য মেঘের ভিতরে অপেক্ষা করবে পৃথক পৃথক সাদা রাজহাঁস। তাদের বলা কথাগুলি অচিরে রক্তিম মলাটে সোনার অক্ষরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাবে। এ-বিষয়ে ক্ষীণকটি, চন্দ্রবদনী, মকরমুখী, পৃথুল-নিতম্বিনী ও ভ্রামরীদের মধ্যে একচুলও ভেদাভেদ থাকবে না।
জন্মদিনে প্রত্যেকের জন্য লিখে দেব ভালোবাসার আর্তি-ভরা মৃত্যুখচিত এক একটি অজর কবিতার বই, যা কেবল সনেটেই লেখা হবে। হে প্রবল প্রেমিকাগণ, আপনারা, আমার ভাষাকে ক্রমশ নিয়ে যাবেন গদ্যভাষার দিকে, মুক্তির দিকে।
যৌথ বসবাসের জন্য একটি নীলরঙা দ্বীপ উচ্চ-সৌর অতলান্তিক থেকে উত্থিত হয়েছে। সেখানে হলুদ সমীরণে সাদা পক্ষীরাজ অপেক্ষা করছে। ইচ্ছানুসারে পরিবর্তিত হবে ঋতু, তার জন্য চাই অনুরাগের আলোড়ন-- রাগ-রাগিণীর মিতায়তনে নিজেকে প্রস্থিত করে দেখুন উচ্চ প্রশাখায় উচিত পুষ্পের সমাহার।
কখনও মৃত্যু হবে না, এমন এক সঞ্জীবনীসুধা ইতোমধ্যেই পান করেছি আমি। প্রেমিকাদের তা লব্ধ হবে শুধুমাত্র চুম্বনে চুম্বনে। হাত বাড়ালেই বন্ধু, মিলবে মেঘপরিদের তৈরি ফ্রি গুঞ্জামালা। হাওয়া বা শূন্যতা নিজেই একটি সফটওয়্যার আপডেটেড কম্পিউটার।
স্বর্গ থেকে পুষ্পরথ এসে মহাজগৎ ঘুরিয়ে আনবে রূপশ্রী প্রেমিকাদের সইসখী সহকারে। অফুরান দ্রাক্ষা ও সুরা মজুত রেখেছে রাক্ষসের ছেলে-মেয়েরা। যে-কোনো যাত্রাই নন্দনযাত্রা--- প্রেমিকারা, বিখ্যাত স্যাডিস্টদের তরফে আপনাদের জন্য ঘাইহরিণীর বুকপকেটে লুকিয়ে রাখা আছে ব্যক্তিগত চিঠি।
কল্পনা আমাদের ধাত্রী। সমস্ত বৃক্ষই কল্পতরু। প্রজাপতিদের আর শুঁয়োপোকা হতে হবে না, তাদের সুরক্ষায় রইবেন বুদ্ধশ্রী প্রজাপিতারা। শুধু মানুষ কেন, সংবাদপত্র না পড়লেও কেউই পিছিয়ে পড়বে না। আপনাআপনিই বর্ধিত মাধুরী প্রকাশ করবে অনাহত যৌবন।
আমার যৌবন আমি একটি কলসে ভরে ভাসিয়ে দিয়েছি অনন্তে। সেটিকে খুঁজে পেতে প্রেমিকাদের সর্ব আকুলতা সোঁদাল ফুলের মতো ঝ'রে ঝ'রে পড়ুক, আমারও একান্ত প্রার্থনা। বিবাহ করব না। চাইলেই বটিকায় গর্ভে ক্ষণেকের মধ্যে জন্মাবে ক্রন্দনরত অজাত শিশুরা।
কথা দিচ্ছি, ক্রমে সমুদয় নির্দায় করবার লক্ষ্যে অবিচল থাকব আমি। ক্ষুধার জগৎ থেকে আমি শুধু আপনাদের নির্বাসন দিতে চেয়েছি। আমাদের অস্তিত্বজুড়ে থাকবে ভিক্ষাভাষার সরলতা।
আমরা যেন গাছেদের ভাষায় গাছেদের কথা বলতে পারি। মাছেদের কথায় মাছেদের কথা বলতে পারি। যেন এই আমি, আপনাদের একমাত্র প্রেমিক, বজ্রবিদ্যুতের ভাষায় আপনাদের জন্য লিখতে পারি একসমুদ্র বর্ষার কবিতা, যাতে মিশে থাকবে বিরহ নয় দুঃখ নয়, শুধু মিলনান্তের শুদ্ধ অসীম ব্যঞ্জনা।
আমিই কৃষ্ণ, রূপের অরূপ, কলির আশ্চর্য চৈতন্য আমিই। আমাকেই পাগল করুন, মরণের মধু দিন মুখে বিকায়ে বিকায়ে বিথরে বিথারে, চকিত ক্বচিৎ ক্বচিৎ চকিত বরণে... আমার বংশী তুলে রাখা আছে বাঁশগাছে, পর্বত হেঁটে এসে আমার কাছ থেকে দীর্ঘ শূল, বরফ ও জটা নিয়ে গেছেন।
হে সুন্দরী যুবতীগণ, আপনারা প্রস্তুত হোন, হৃদি প্রমত্ত হলে, সম্ভব করতে সাদা খামে চিঠি লিখুন নিচের ঠিকানায়, আগামী বসন্তে। খামের ওপরে অনুগ্রহ করে 'ব্যক্তিগত' শব্দটি অবশ্যই লিখতে ভুলবেন না প্লিজ !
প্রেমিকা
যেন সুদূর বিদেশে গেছ, ঘর বহুদিন তালাবন্ধ পড়ে আছে।
টবের গাছগুলি শুকিয়ে পাতা ও পাপড়ি ঝরে গেছে উষ্ণ মাটিতে। ইঁদুরেরা নেই
টিয়ার কঙ্কাল নড়ে উঠে ভিক্ষুকের দোতারায় বেজে ওঠে দেহতত্ত্বের গান
খরগোশগুলো ছাদের ঘেরায় উঠে দেখেছিল পৃথিবীরও অনেক নীচে মানুষের গুপ্ত চলাচল
তারপর অরব প্রার্থনা লিখে রেখে গেছে রাত্রির নক্ষত্রের কাছে।
যেন তুমি পৃথিবীতে ছিলে না কোনোদিন। প্রাচীন নগরীর মতো নিজেকে বিলুপ্ত রেখে
সমুদ্রের পর সমুদ্র পেরিয়ে সূর্যের কাছে গিয়ে অভ্যর্থনাময় দাঁড়াবে। শেষ প্রশ্নের কাছে।
তোমার মুখের রূপের সাধনার মতো পথে প্রান্তরে পৃথিবীর রূপ ও খনিজ পড়ে আছে—
তবু যেন বাতাসে সব কিছু অস্পষ্ট জন্মান্ধ বিলীন হয়ে আছে।
মাগুর
ডেকচিতে মোটা মোটা হাইব্রিড মাগুর ছেড়ে দিয়ে
বাজারে বসে থাকে মেছুনি।
মাগুরেরা গালের দু-পাশে কাঁটা নিয়ে, জলহীন ডেকচিতে
অসহায় নড়াচড়া করে।
মানুষের অসুখ হলে মানুষেরা বৈরাগ্য খোঁজে, কিছুদিন
অব্যক্ত রাখে সবকিছু, অভ্যন্তরে আরাধনাশীল হয়;
যৌন-আঙরাখা ভুলে অগ্নিভ-মননে মানুষ কি কল্পান্তরে যাবে?
বিবাহের শাক্তভূমি ছেড়ে সন্ন্যাসকল্পের দিকে-- নতুন যাত্রাপথে
ডেকচিতে মোটা মোটা হাইব্রিড প্রলোভন ছেড়ে দিয়ে
বাজারে বসে থাকে মেছুনি।
স্বপ্নের গ্রাফিক্স
যে-পুরুষ অপূর্ব সঙ্গম জানে সে সেই সঙ্গম নিজে-চোখে দেখতে পায় না,
মনে মনে গ্রাফিক্স তৈরি করে; ছবি তুলে রাখে।
ভেবেছে যা, হয় ঠিক তার উলটোটাই:
চলমান ছবির সঙ্গমপুরুষটি শান্তি নয় ভক্তি নয় স্বস্তিও নয়,
বন্ধুত্বময় হাতে, পরিবর্তে সবুজ ঈর্ষা দেবে তাকে।
এমন অকাল প্রীতির বৈভবে, বাহুল্যে, ঈর্ষার গরল মেখে
ক্রমশ সে হয়ে পড়ে নিজের শত্রু, আর তাই
খাল কেটে কুমির ডেকে এনে, অজান্তে, ব্যক্তিগত প্রেমে
নিজেকে বহুগুণিত ক'রে রটিয়ে ফ্যালে সমষ্টির বার্তা।
অনন্যোপায়, প্রথমত, প্রেমের অনুসারী শিল্পে আস্থা রেখে চলার
কৌশল নেয় কিছুদিন;
তারপর অদ্ভুত পাগল হয়ে সারাজীবন ধরে ক্ষুব্ধ প্রেমিকাকে বোঝায়:
ফুলগাছে কাঁটা নয়, আদপে সমস্ত ফুলেরাই আশ্চর্যরকম ফোটে কাঁটাগাছে
বোঝায় সমষ্টির প্রেমে কোথায় নন্দনতত্ত্বের বিশুদ্ধ খোরাক আছে!
কালের অতীত থেকে
নারী ও শিশুর কোমলতার থেকে দূরে
আশ্চর্য সুকঠিন পার্বত্য সংসার পড়ে আছে।
মুগ্ধ দেহবাদের ভেতর থেকেই শুরু হয়েছে
অটল সংসারযাত্রার পথ;
শুরুতে ঘাসে ও শিশিরে ঢাকা, ক্রমে রাস্তা গেছে খুলে
জলে ও পাথরে।
মানুষের ওপর পড়েছে মানুষের অপ্রতিম ছায়া---
পথ সুলক্ষণা, বস্তুত বাকি সকলই শুধু ঘটনা
কালের অতীত থেকে হেঁটে এসে
ছায়াকোমল নারী, প্রস্তরপুরুষ ও শিশুর সামনে পশ্চাতে অন্তরিক্ষে
বহুদূরে পার্বত্য গাল্পিক সংসার প'ড়ে আছে।
নবধারাজলে
নিজেকে চিনব বলে অতঃপর কুয়োয়
নামিয়ে এনেছি মুখ।
এভাবে কি নিজেকে আদৌ চেনা যাবে?
দেখি যে, আমার মুখখানি অস্পষ্ট গভীর সত্যময় কালো--
যা আমি আগে কখনও দেখিনি।
যা সম্ভবত কোনো আয়নাও দেখাতে পারে না।
কুয়োর জল, তুমি সত্যটুকু চেনাবে, এই শর্তে সমর্পিত আমি, লৌকিক থেকে অলৌকিকে।
আমার প্রতিবিম্ব থেকে তুমি চিনে নাও প্রকৃত আমাকে।
নিজেকে চিনব বলে কুয়োর গভীরে নেমেছি।
কেন এনেছি নামিয়ে এই মুখ?
কলঙ্কের আশ্চর্য দীপিত শোভা খুঁজে পাওয়া যাবে
এই মুখে?
ভাঙনের কাল থেকে ঝাঁপ দেয় যে, অরূপের ছলে
কুয়োর আশ্চর্য ভিতরে!
যে-বিম্বিত চাঁদ দেখ তুমি, চুম্বনে কল্পনায় ভালোবাস যাকে,
আসলে তা কলঙ্কেরই আশ্চর্য শোভা, রূপ, ফুটে ওঠে
রাত্রির নবধারাজলে...